সন্তোষ গুপ্ত

7

 

ঝালকাঠি জেলার রুনসী গ্রামে ১৯২৫ সালের ৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে একজন সাংবাদিক, কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট ছিলেন। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের সাংবাদিকতা জীবনে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিংবদন্তি এই কলমযোদ্ধার জন্মদিনে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি। সন্তোষ গুপ্ত ছেলেবেলায় বাবা-কাকাকে হারান মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে। তাঁর মা কিরণবালা তাকে অনেক কষ্টে মানুষ করেন। হিন্দু বিধবাদের আচার-আচরণ মানলেও তিনি ছিলেন প্রগতিশীল। স্বামীহারা হবার পর থেকে কিরণবালাকে দীর্ঘকাল একবেলা আহার করতে হয়েছে। হিন্দু বিধবা হিসেবে বিকেলে খই বা রুটি খাওয়ার অবস্থাও তার ছিল না। ১৯৪৪ সালে সন্তোষ গুপ্ত চাকরি পাওয়ার পর তিনি রুটি ও ফল-মূল খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ছেলেবেলায় বইপড়ার প্রচÐ নেশা ছিল সন্তোষ গুপ্তের। একবার একনাগাড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৪৪টা কবিতা মুখস্থ বলে তিনি তাঁর শিক্ষক মহেন্দ্রবাবুকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি তাঁকে ‘সঞ্চয়িতা’ ও ‘চয়নিকা’ উপহার দিয়েছিলেন। সন্তোষ গুপ্ত কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আইজি প্রিজন অফিসে ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেশভাগের সময় সন্তোষ গুপ্ত অপশন দিলেন পূর্ববঙ্গকে। কারণ তার দেশের বাড়ি ছিল বরিশাল। কলকাতায় থাকতেই সম্পর্ক ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। ঢাকায় এসেও প্রথম সুযোগেই যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। কারা বিভাগের আইজির অফিসে সন্তোষ গুপ্তের পোস্টিং হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই দমননীতি নেমে আসে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর এবং গ্রেফতার হন সরদার ফজলুল করিম, রেলশ্রমিক মো. আবদুল বারী, সন্তোষ গুপ্ত এবং তাঁর মা। পার্টির মধ্যে অনুপ্রবেশকারী পুলিশি চরের বিশ্বাসঘাতকতায় সন্তোষ গুপ্তের বাড়ি (যা ছিল ঢাকা জেলার হেড কোয়ার্টার) শেষ হয়ে যায়। জেলখানায় তাকে দেখে আইজি প্রিজন ভীষণ অবাক হয়ে বলেন, ‘তোমাকে ভুল করে ধরে এনেছে। আমি তোমার রিলিজের ব্যবস্থা করছি।’ সন্তোষ গুপ্ত বলেন, ‘ভুল হয়নি। পুলিশ ঠিক লোককেই ধরেছে।’ এরপর তিনি তিনবার জেল খাটেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর ১৯৫৭ সালে ‘দৈনিক সংবাদে’ যোগদান করেন। তিনি ‘দৈনিক আজাদে’ও কাজ করেছেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসনের শুরুতেই তাকে আবার গ্রফতার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতায় ন্যাপের মুখপত্র ‘নতুন বাংলা’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে সন্তোষ গুপ্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বিভাগে কর্মরত ছিলেন। এমনকী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংবাদের ‘সিনিয়র সহকারী সম্পাদক’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সন্তোষ গুপ্ত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু এবং পরে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার হত্যার পর স্বাভাবিকভাবে অসা¤প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেন। বাংলাদেশের বামপন্থীরা স্ব-উদ্যোগে এগিয়ে আসবেন কামনা করেন তিনি। এ প্রশ্নে বামপন্থীদের সংকীর্ণতা দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাই বলে যৌবনের ক্ষুরধার যে বিশ্বাস নিয়ে পথচলা শুরু করেছিলেন; সেই বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হননি কোনো দিন।
লেখালেখির মধ্যে পাঠকমহলে সমাদৃত ছিল সন্তোষ গুপ্তের লেখা ‘অনিরুদ্ধের কলাম’। এছাড়াও কবিতা, শিল্পকলা, চিত্রকলা, রাজনীতি, সাহিত্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ১৪টি বই লিখেছেন। দেশের সব জাতীয় দৈনিকে তার বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ, কলাম ও সমালোচনামূলক নিবন্ধ ছাপা হয়। মৌলিক কবিতা ছাড়াও শেলীর কবিতা আর শেক্সপিয়রের সনেট অনুবাদ করেছেন। যার মধ্যে অনেকগুলো ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় লুট হয়ে যায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- ‘ইতিহাসের ঝর্ণাধ্বনি’, ‘অনালোকে আলোকস্তম্ভ’, ‘ইতিহাস আমাদের দিকে’, ‘সমাজতন্ত্রের অন্য ইতিহাস’, ‘স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে’ প্রভৃতি। সন্তোষ গুপ্ত সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য একুশে পদক, শেরেবাংলা পদক, মাওলানা তর্কবাগীশ পদক, জহুর হোসেন স্মৃতি পদকসহ বিভিন্ন পদক লাভ করেছেন। সন্তোষ গুপ্ত ২০০৪ সালের ৬ আগস্ট মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। সূত্র: বাংলাপিডিয়া