সন্তানের সুশিক্ষায় বুনিয়াদি দায়িত্ব অভিভাবকের

23

কমরুদ্দিন আহমদ

মানুষ সামাজিক জীব, সকল সৃষ্টির সেরা। শ্রেষ্ঠ জীবের জীবন যাত্রা শ্রেষ্ঠ হতে হয়। গরু-ছাগল, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গসহ আঠার হাজার সৃষ্টির চেয়ে মানবের কাজকর্ম, জৈবিক ও আত্মিক চাহিদায় স্বতন্ত্র আচরণ থাকা বাঞ্চনীয়। মানুষ নামক শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির কর্মকাণ্ড বর্তমানে অস্তিত্ববাদী, বাণিজ্যিক ও সুদভিত্তিক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্বে মূল্যবোধ বিবর্জিত। মানুষ জীব হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব হারাচ্ছে। এর মূল কারণ পারিবারিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার চর্চা হতে বিচ্যুত হওয়া। সন্তানদের বুনিয়াদি শিক্ষায় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা-সংস্কৃতি হতে দেশের মানুষ অনেক দূরে অবস্থান করছে। মূলত সন্তানের সুশিক্ষার মৌলিক দায়িত্ব অভিভাবক তথা মা-বাবার।
বিবেক বুদ্ধির জোরে মানুষ সৃষ্টি জগতে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত। মানুষ তার ইচ্ছার স্বাধীনতাকে পুঁজি করে বিবেকহীন ও কুবুদ্ধির আশ্রয়ে ব্যক্তিক ও জৈবিক স্বার্থে হারিয়ে ফেলছে ‘আশরাফুল মাখলুকাতে’র বৈশিষ্ট্য। প্রত্যেক জীব তার বংশ বিস্তার করে। মানুষ এবং জ্বিনও তার ব্যতিক্রম নয়। পৃথিবীর সর্বশেষ ও একত্ববাদী আধুনিক ধর্ম ইসলাম পৃথিবীর মানব জীবন সম্পর্কে এমন নির্দেশনা দেয় যে, একমাত্র মানুষ ও জ্বিনজাতি ছাড়া পরকালে অন্যকোন জীবের পুরস্কার কিংবা শাস্তির বিধান নেই। জ্বিন ও মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার ব্যাপকতা প্রদান করে আল্লাহ। পৃথিবীর ভালো কাজের পুরস্কার এবং ধর্মীয় ভাবে নিষিদ্ধ কাজের বিপরীতে শাস্তি তথা বেহেস্ত-দোজখ, স্বর্গ-নরকের ব্যবস্থাও রেখেছেন। ইহকালীন জীবন অবসানের পর পরকালীন জীবনে পদার্পণের বিশ্বাস মানুষকে নৈতিক হতে বাধ্য করে। বেহেস্ত-দোজখ, স্বর্গ নরকের ধারণা প্রায় সকল ধর্মে আছে। পৃথিবীর কোন ধর্মীয়শিক্ষা মানব সন্তানকে অনৈতিকতা শিক্ষা দেয় না। ব্যক্তিগত ও সামাজিক মানুষের কল্যাণ কামনা সকল ধর্মের মূলমন্ত্র। মানব কল্যাণের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার নামে প্রকৃত ধর্মহীনতা সত্যিকার মানব কল্যাণ, শ্রেয়নীতি ও মূল্যবোধ সংরক্ষণের রক্ষাকবজ হয়ে ওঠে না। যে কারণে পৃথিবীব্যাপী মানব সৃষ্ট তথাকথিত মানবকল্যাণের প্রবক্তারা পৃথিবীর মানুষের শান্তি, তথাকথিত মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার নামে সমগ্র বিশ্বকে অশান্ত নরকযন্ত্রণায় নিপতিত করেছে।
জন্মের পর মানবসন্তান অন্যান্য জীবসন্তানের চেয়ে দুর্বল ও অসহায় থাকে। তারা নিজে নিজে মায়ের দুধের বাট পর্যন্ত খুঁজে নিতে পারে না,অথচ গরু-ছাগলের বাচ্চারা ময়ের ওদর থেকে বের হবার পর নিজের চেষ্টায় দাড়িয়ে দুধের বাট খুঁজে নিতে পারে। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে মা ও বাবার দায়িত্ব যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি শিশুকাল হতে সন্তানকে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে মানবীয় গুণাবলীর দিকে ধাবিত করাও মা-বাবার অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বিশেষ করে যারা এই পৃথিবীর জীবনের পরে আখিরাতে বিশ্বাসী তারা মুমিন মুসলমান হিসেবে তাদের জন্য নিজের সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা ফরজ। ফরজ এই জন্যে যে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর হাদিস অনুসারে সন্তান হলো মা-বাবার জন্য ‘আলমে বরজখ’ (কবরের জীবন) ও আখেরাতের তথা শেষ বিচারের দিন মহাসংকটের সময় মুক্তির অন্যতম সহায়ক শক্তি হবে পুণ্যময় সন্তান। যদি সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয় এবং মাবাবার পাপ মুক্তির জন্য দোয়া করার যোগ্য হয়। পবিত্র হাদিসে উল্লেখ রয়েছে যদি কোন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার (পৃথিবীতে ভালোকাজ ও মন্দকাজ করার) সকল ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি বিষয় মৃত (নর-নারীর) ব্যক্তির উপকারে আসে। (বলাবাহুল্য মৃতব্যক্তি কারো উপকার করতে সক্ষম হয় না) তিনটি কাজ পৃথিবীতে করে যেতে পারলে সে কাজের পূণ্যে মৃতব্যক্তির কবরে (তথা পুণ্যের খাতায়) যোগ হয়ঃ
১) জীবদ্দশায় পৃথিবীতে ছদকায়ে জারিয়া তথা প্রবহমান পুণ্য কাজ ( মসজিদ মাদ্রাসায় অর্থদান, মানুষের উপকারে রাস্তাঘাট তৈরি করা, কোন মানুষের উপকারে সহযোগিতা করা ইত্যাদি) করে থাকে। ২) পুণ্যজ্ঞান অর্জন, (মানব কল্যাণে কোরআন হাদিস ও ইসলামী জ্ঞান অর্জন করে মানুষকে সৎ,পুণ্য ও কল্যাণের পথ দেখানোর জ্ঞান) যে জ্ঞান পৃথিবীতে মানুষ পরম্পরায় অব্যাহত থাকে। ৩) পুণ্যময় সন্তান পৃথিবীতে রেখে যাওয়া। যে সন্তান আল্লাহর কাছে মাবাবার পাপকার্য মোছনের জন্য দোয়া করার যোগ্য হয়। এই হাদিস অনুসারে পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে কাজ করা ও জ্ঞান বিতরণ করার পাশাপাশি সুশিক্ষিত সৎ ও আল্লাহর অনুগত সন্তান পৃথিবীতে রেখে মৃত্যুবরণ করার গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রত্যেক মুলমানকে নিজ নিজ সন্তানদের ধর্মীয় সুশিক্ষা প্রদান করা ফরজ বা আব্শ্যক কাজ।
মানুষ জন্মের পর পারিবারিক পরিমণ্ডলে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা না পেলে দেশের প্রচলিত শিক্ষার মাধ্যমে সুশিক্ষিত হবার কোন নিশ্চয়তা নেই। কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সঠিক, সৎ ও নৈতিক নাগরিক তৈরির পর্যাপ্ত সিলেবাস পড়ানো হয় না। ফলে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবার পর এদেশে অধিকাংশ নাগরিক অসৎ, দুর্নীতিপরায়ন, খারাপ চরিত্রকে সাথে নিয়ে আত্মকেন্দ্রিক ভোগবিলাসের ইহ-লৌকিক জীবন অতিবাহিত করায় অব্যস্থ হয়ে পড়ে। আপরের কল্যাণ চিন্তা না করে বরং অপরের সমূহ ক্ষতি করে নিজের আখের গোছানোর জন্য তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এজন্য এদেশে বিচিত্র অপরাধকর্ম, অবৈধ মাদক সেবন, জুয়া, দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ অনৈতিক কর্মকাণ্ড লাগামহীন ভাবে চলছে।
মানুষ সাধারণ কোন জীব নয়, বাকশক্তি সম্পন্ন মেধাভিত্তিক শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মহাবিশ্বের অন্যান্য জীবের মতো মানুষও বংশ বৃদ্ধি করে। মানুষের বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়া সাধারণ জীবজন্তু হতে আলাদা। মানুষের যৌনচর্চায় শালিনতা বজায় থাকে। খোলাস্থানে মানুষ যৌনসঙ্গম করে না, যারা করে তাদের প্রকৃত মানুষেরা মানুষ নামের হায়ওয়ান হিসেবে চিহ্নিত করে। মানুষ ছাড়া গরু-ছাগল, বাঘ-সিংহসহ সকল জীবজন্তু তাদের যৌনকর্মের ফসল হিসেবে সন্তান প্রসব করে। তাদের সন্তানের জন্য কোন শিক্ষালয় নেই। মানুষসহ সকল জীবের সন্তানদের জন্মগত কিছু সংস্কার থাকে। এগুলো সৃষ্টির সকলজীব প্রাকৃতিক ভাবে অর্জন করে। রতি, হাস, শোক, ক্রোধ, ভয়, ঈর্ষা, জুগুপ্সা ও বিস্ময় অন্যান্য জীবের মতো মানুষেরও আছে। প্রাকৃতিক এই স্বভাবগুলো হতে মানবসন্তানকে মানবিক মানুষ হিসেবে তৈরি করার জন্য যুগে যুগে আল্লাহ মানুষকে শালীন জৈবিক ও ধর্মীয় সুশিক্ষা প্রদানের জন্য নবী রাসূলদের প্রেরণ করেছেন। আধুনিক মানবমেধা মানবসন্তাদের সুশিক্ষার জন্য শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষালয় সৃষ্টি করে মানব সন্তানদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মানব সন্তানদের জন্মগত ও প্রাকৃতিক ভাবে প্রাপ্ত পশুত্ব স্বভাবসমূহ নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা-দীক্ষা-পরিবেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে। মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলার জন্য সুশিক্ষার কোন বিকল্প নেই। আধুনিক শিক্ষা প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত না হয়েও মানবসন্তান নানা উপায়ে সুখি স্বাচ্ছ্ন্দ্য জীবন যাপন করতে পারে। ‘সকলের তরে সকলেই আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ (অপরের কল্যাণের জন্য)। এমন মূল্যবোধ অর্জনে মানব সন্তানদের ত্যাগের শিক্ষায় উজ্জীবিত করে, মানবতাবাদী করে তোলাই প্রকৃত সুশিক্ষা। এশিক্ষা খুব কম মানুষই প্রাকৃতিক ভাবে পেতে দেখা যায়। পৃথিবীতে নবী ইব্রাহিমই একমাত্র মানব সন্তান যিনি নিজস্ব বুদ্ধি বিবেচনা চর্চা করে সঠিক সত্য পথ সন্ধানের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ মানুষে রূপান্তরিত হয়েছেন। তাঁকে মুসলিম জাতির পিতা বলা হয়।
সাধারণত সুশিক্ষার অর্জনের প্রথম ধাপ পারিবারিক পরিবেশ ও মা-বাবার দেয়া শিক্ষা। জীবনের সত্য,সুন্দর, নীতি, সততা এবং ভালোমন্দের পার্থক্য মা-বাবাকেই আপন সন্তানদের শিখাতে হয়। দেশের প্রত্যেক পরিবারের অভিভাবকদের সন্তানের সুশিক্ষার প্রতি আগ্রহী হওয়াই কর্তব্য। শিশুবয়সে সন্তান যেন কোন মন্দ স্বভাব ও অভ্যাসে অভ্যস্ত না হয় এ বিষয়ে মা-বাবা উভয়কে সচেতন ভাবে জীবনযাপন করতে হয়। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। মা-বাবার ভালো ও মন্দ আচরণ শিশুরা অনুকরণ করে। তাই পরিবারে মা- বাবাকে কথাবার্তা, আচার-আচরণ, সত্য-সুন্দর বাক্য চর্চায় মনোনিবেশ করতে হয়। যাতে শিশুবয়স হতে সন্তান মিথ্যা,প্রতারণা, চুরি, অশ্লিল বা মন্দবাক্য পরিবার হতে শিখতে না পারে এমন পরিবেশ শিশুর জন্য নিশ্চিত করতে হয়। সন্তান কৈশোরে উপনীত হলে স্কুলে নিয়মিত সঠিক সময়ে যাচ্ছে কি না এবং স্কুল হতে সময় মত বাড়ি ফিরছে কি না, সব খবর অভিভাবকদের রাখা জরুরি । অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন স্কুলে পাঠিয়ে দিলে তাদের দায়িত্ব শেষ, বাকিটা শিক্ষকরা দেখবেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীরা সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা থাকে। দিনের অধিকাংশ সময় নিজ নিজ সন্তান কিভাবে সময় কাটায় সে সম্পর্কে অভিভাবকদের খবরাখবর রাখার দায়িত্ব বেশি। অভিভাবকরা তাদের সন্তানেরা কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কোন অপরাধ জগতের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে কি না তার যথাযথ খবরাখবর না রাখার কারণে অধিকাংশ কিশোর-যুবক বিপথগামী হচ্ছে। ফলে দেশের কিশোর-যুবকেরা অধিক মাত্রায় মাদকাসক্ত ও অপরাধ প্রবণ হয়ে পড়ছে। শহর ও গ্রামের সচেতন অভিভাবকদের অধিকাংশ তাদের সন্তানদের বৈষয়িক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে প্রাণপণ মরিয়া হয়ে চেষ্টারত। কিন্তু বৈষয়িক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তাদের যে প্রচেষ্টা তাতে সন্তানেরা অধুনিক শিক্ষায় চৌকস হয়ে উঠলেও নৈতিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে। এর কারণে অধিকাংশ প্রজন্ম বৈষয়িক ভোগবিলাসের নিশ্চয়তার লক্ষে নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে উঠছে। অভিভাবকদের জীবনে হালাল উপার্জন ও নৈতিক-মানবিক চিন্তার চর্চা না থাকায় সন্তানরা শিক্ষিত হলেও সুশিক্ষিত হচ্ছে না। হচ্ছে সাধারণ জীবের মতো বৈষয়িক, অনৈতিক তথাকথিত সাফল্যের জীবনমুখি। এদেশের অধিবাসীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ মুসলিম। আর মুসলিম সন্তানদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান মা-বাবার জন্য ফরজ। আধুনিক উচ্চশিক্ষা নফল বা ঐচ্ছিক। এদেশের অভিভাবক সমাজ তাঁদের সন্তানদের সুশিক্ষার ব্যাপারে খুবই উদাসীন। তাঁরা সন্তানদেরকে জৈবিক সাফল্য অর্জনের বিষয়ে যতটুকু সচেতন, ধর্মীয় ও নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কোন চেষ্টাই করছে না। এদেশের অভিভাবকরা সন্তানদের ডাক্তার, প্রকৌশলি, উকিল-ব্যারিস্টার, সরকারী প্রশাসনের ক্যাডার বানাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কিন্তু মানুষ বানাতে কোন সময় দেন না। দেশে নগর হতে গাঁও-গেরাম পর্যন্ত সবখানে পারিবারিক সুশিক্ষার কোন আগ্রহ অভিভাবক সমাজে নেই বলেই তাদের সন্তানেরা নামাজ, রোজা, কোরআন পাঠ ইত্যাদি বিষয়ে অধিকাংশ নারী-পুরুষ অজ্ঞ হতে দেখা যায়। হালাল, হারাম, বৈধ অবৈধের বালাই এ কারণে দেশ হতে প্রায় নির্বাসিত। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বুনিয়াদি নৈতিক ধর্মীয় শিক্ষায় গড়ে তোলার কার্যকর পদক্ষেপ নিলে তবেই দেশে সৎ ও যোগ্য নাগরিক সৃষ্টি হবে।

লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ