সত্য-ন্যায়ের আন্দোলনে প্রাণশক্তি ইমাম হোসাইন

7

সাইফুল ইসলাম চৌধুরী

‘কাতলে হোসাইন আসল মে মারগে ইয়াজিদ হ্যায়, ইসলাম জিন্দাহ হোতা হায় হার কারবালা কে বাদ’। অর্থাৎ ইমাম হোসাইনের নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে ইয়াজিদেরই মৃত্যু ঘটেছে; ইসলাম প্রতিটি কারবালার পর পুনরুজ্জীবিত হয়। মুখে মুখে সমাদৃত এ সত্য উক্তি কারবালার দর্শনকে শানিত করে। মহাকবি আল্লামা ইকবালের এ পঙ্কিটি কারবালায় বিজয়ী ও পরাজিত শক্তিকে অ্যাড্রেস করে। পরিষ্কার জানিয়ে দেয় ইমাম হোসাইনই (রা.) বিজয়ী। বিজয়ী হোসাইনের অগ্রজ ইমাম হাসান (রা.)। বিজয় হোসাইনের গর্বিত পিতা বেলায়তের সূর্য মাওলা আলীর (রা.)। সফলতার সৃষ্টি হোসাইনের রতœগর্ভা জননী খাতুনে জান্নাত মা ফাতেমা (রা.)-এর জন্য। বিজয় হোসাইনের নানিজান আল্লাহর সালাম পাওয়া সৌভাগ্যবতী খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর। বিজয়ধ্বনি হোসাইনের নানাজান ইমামুল আম্বিয়া নুরনবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর দান। বিজয় হোসাইন খান্দানের। বিজয় শুধু ৬১ হিজরি সালে নয়। এ বিজয়ের সূচনা নীল গগন সৃষ্টির আগে। মালিকে হাক্বিকি মহান আল্লাহ জীব সৃষ্টির বহুকাল আগে সযতেœ নুরে মুহাম্মদি (সা.)-কে সৃষ্টি করে বিজয়ের বার্তা দিয়েছেন; অসত্য যত প্রখর হবে, সত্যের সূর্যোদয় তত নিকটতম হবে।
ত্রিভুবন বিজয়ী প্রিয় মুহাম্মদ (সা.)-এর শাহজাদার নাম ইমাম হোসাইন। বিজয়ী নানার জয়ী দৌহিত্র ইমাম হোসাইন। ‘ হোসাইন’ নিছক কোনো নাম নয়; বরং নাম ‘ হোসাইন ’ রহমতের মালিকের দেওয়া জান্নাতি সুঘ্রাণ। হোসাইন সাধারণ কোনো আরোহী নন; বরং হাবিবুল্লাহ (সা.)-এর নুরানি কাঁধে আরোহীর নাম। মোস্তফা (সা.)-এর নুরানি ঠোঁটের চিহ্ন অঙ্কিত শরীরের নাম ইমামে আলী মকাম। ইমাম হোসাইন একটি বিপ্লব, নবজাগরণ ও সফল আন্দোলনের নাম। যে আন্দোলন ৬১ হিজরির ১০ মহররম কারবালার প্রান্তর থেকে চূড়ান্তভাবে শুরু হয়ে চলমান আছে আজ অবধি। চলবে কিয়ামততক। দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, মাদক, ধর্ষণ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ইমাম হোসাইন নিঃসন্দেহে তেজোদ্দীপ্ত প্রেরণা। অভিশপ্ত ইয়াজিদের হাতে বায়াতের (আনুগত্য) অফার অগ্রাহ্য করে তার দুঃশাসন, স্বৈরাচারনীতি, অনৈসলামিক কর্মকাÐ, ব্যভিচার, ঘৃণিত পদক্ষেপ ও গর্হিত অপরাধের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের নাম ইমাম হোসাইন। ইমামে হোসাইন ধৈর্যের ইস্পাত-দৃঢ় সুউচ্চ মিনারের নাম। ইমাম হোসাইন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান পাঠ ধৈর্যের অনুশীলন। মহান আল্লাহর ঘোষণা- ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আ-মানুছতাঈনু বিসসাবরি ওয়াসসালাতি; ইন্নাল্লাহা মাআসসাবিরিন। ধৈর্যই ইমাম হুসাইনের প্রধান ভূষণ। সে ধৈর্যের পাহাড়ের সামনে খোদার দ্বীন বাঁচাতে নিজের শক্তি আব্বাস আলমদারের দুই হাত কর্তিত নিথর দেহ; নিজের বুকের ধন আলী আকবরের রক্তাক্ত নিশ্চুপ শরীর; আদরের ভাই, ¯েœহের ভাতিজা ও ভাগিনাদের রক্ত¯œাত নিস্তব্ধ জিসিম; নবীবাগের নিষ্পাপ গোলাপ ছয় মাসের শিশু আলী আজগরের বিষাক্ত তীর বিদ্ধ নিষ্প্রাণ নুরানি শরীর; কন্যা সৈয়দা সকিনার তৃষ্ণার্ত শুকনো মুখ; স্ত্রী শাহরবানুর সন্তান হারানো বোবাকান্না; বোন জয়নাবের শোকাভিভূত চেহেরা; হোসাইন শিবিরে স্বজন হারানো গগনবিদারি আর্তনাদ ইমাম হোসাইনের সবরের পর্দায় একটুও আঘাত হানতে পারেনি। তৃষ্ণার্ত প্রাণে একটাই ভরসা নানাজান রহমাতুল্লিল আলামিন অমিয় সুধা হাউসে কাউসার নিয়ে অপেক্ষায় আছেন!
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ করুণ দৃশ্য অন্তরকে ভেঙে চুরমার করে দিলেও ঈমানি শক্তিতে বলিয়ান ইমামে হোসাইন একটুও সাহস হারাননি। রক্ত¯œাত ফোরাততীর সেদিন হু হু করে কেঁদেছিল নবী বংশের পবিত্র রক্ত বুকে মেখে। আকাশ বাতাস বৃক্ষলতা হোসাইন শোকে মাতম করেছিল সেদিন। আসমান ও জমিনবাসী কিয়ামত সন্নিকটে ভেবে ভীতসন্ত্রস্ত। এ হৃদয়বিদারক দৃশ্য নাড়া দিয়েছে ইতিহাসবিদ গিবনের জ্ঞানে। তাই তিনি বলেছেন, ওহ ধ ফরংঃধহঃ ধমব ধহফ পষরসধঃব ঃযব ঃৎধমরপ ংপবহব ড়ভ ঃযব ফবধঃয ড়ভ ঐঁংধুহ রিষষ ধধিশবহ ঃযব ংুসঢ়ধঃযু ড়ভ ঃযব পড়ষফবংঃ ৎবধফবৎ.অর্থাৎ সেই দূরবর্তী যুগে ও পরিবেশে ইমাম হোসাইনের মৃত্যুর শোকাবহ দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের হৃদয়ে, সমবেদনার সঞ্চার করবে।
ইতিহাসবিদ ইবনে জারির তাবারির মতে, রক্তপাত বন্ধের দৃঢ় হৃদয়ে ইমাম হোসাইন ইয়াজিদ বাহিনীকে অসাধারণ তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন। ইমামকে মদিনায় ফিরে যেতে দেওয়া হোক কিংবা পার্শ^বর্তী যেকোনো সীমান্তে যেতে দেওয়া হোক অথবা ইয়াজিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য তাকে দামেস্কে পাঠানো হোক। তার সঙ্গে তিনি (ইমাম) বোঝাপড়া করে নেবেন। এতে সারা মিল্লাতের কল্যাণ নিহিত। কিন্তু ইবনে জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে নির্লজ্জ আদেশ দেয়। সত্যের জীবন্ত উদাহরণ ইমাম হোসাইন ঘৃণাভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। এ প্রসঙ্গে উইলিয়াম মুর বলেন, ডবষষ যধফ রঃ নববহ ভড়ৎ ঃযব টসধুুধফ যড়ঁংব, রভ ঃযব ঢ়ৎধুবৎ যধফ নববহ ধমৎববফ ঃড়. অর্থাৎ ইমাম হোসাইনের সংলাপের এ অনুরোধ যদি মেনে নেওয়া হতো, উমাইয়াদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনত।
সেদিন ইমাম হোসাইন অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে সত্যান্বেষণীদের অন্তরে চিরজীবী হয়ে গেছেন। আপাতদৃষ্টিতে ৬১ হিজরির শাহাদতে কারবালায় কেউ কেউ ইয়াজিদের বিজয় দেখলেও বোদ্ধামহল ঘুণাক্ষরে হোসাইনের পরাজয় দেখছেন না। বরং সেদিন চূড়ান্ত বিজয়ের রাজমুকুট ইমাম হোসাইনের রক্তাক্ত নুরানি শিরেই দিচ্ছেন তারা। ঐতিহাসিকদের মতে, কারবালার ট্র্যাজেডিতে সাময়িক জয়লাভ ইয়াজিদ তথা উমাইয়া বংশের জন্য ছিল মূলত পরাজয়ের নামান্তর। কারবালার প্রান্তে নবী পরিবারের মর্মান্তিক, গগনস্পর্শী শাহাদতের দৃশ্য সারা দুনিয়ার বিবেচক মানুষের কাছে ইয়াজিদকে বানিয়েছে খলনায়ক। মানুষ এমনভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে যে, প্রায় ১৪০০ বছরেও কোনো মা তার ছেলের নাম ইয়াজিদ রাখেননি।
ঈমান-ইসলামের সেতুবন্ধন ইমাম হোসাইন। দ্বীনের বাস্তব নির্যাস ইমাম হোসাইন। সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ কতই না উত্তম বলেছেন, ‘শাহ আস্ত হোসাইন, বাদশাহ আস্ত হোসাইন। দ্বীন আস্ত হোসাইন, দ্বীন পানাহ আস্ত হোসাইন। সারদ্বাদ নাদ্বাদ, দাস্ত দ্বারে দাস্ত ইয়াজিদ। হাককা কে বিনা লা ইলাহা আস্ত হোসাইন।’ পৃথিবীর যে প্রান্তে অন্যায়ের অন্ধকার নেমে আসবে, সে প্রান্তে হোসাইনি সূর্যোদয় অন্ধকার বিনাশীবে। জুলুমের দাবানল যতই ভয়াবহ হোক, হোসাইনি বারিধারার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করবেই। পৃথিবীর দেশে দেশে সত্যের পক্ষে অপ্রতিরোধ্য শক্তির অন্তরালে এক একজন ইমাম হোসাইন বাস করে বলে, আজ পর্যন্ত সব যৌক্তিক আন্দোলন সফল হয়েছে। আদর্শের প্রতীক হোসাইন। দুনিয়াবাসীর স্থির বিশ্বাস ন্যায় ও ত্যাগের সুউচ্চ মিনার নন্দিত ইমাম হোসাইন। আর শয়তানের আপডেট ভার্সন হলো নিন্দিত ইয়াজিদ।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও ইসলামী বক্তা