সত্তরে ময়ুখ বন্দনা

311

কবির কবিতার তখন চাষ-বাসের বয়স মাত্র একদশক (১৯৬৫-৭৫)। আর তখন থেকেই তাঁর শিল্পকর্মের ওপর তী² দৃষ্টি পড়লো বোদ্ধা পাঠক-বিশ্লেষকের। আলোচনায়-সমালোচনায় আলোড়িত হতে থাকে তাঁর কবিত্ব শক্তি। সময়কাল ১৯৭৫। কবির প্রিয় শিক্ষক ও কবিতার সূ² বিশ্লেষক আবু হেনা মোস্তফা কামাল তরুণ কবি ও কবিতা বিষয়ক সেমিনারে লিখিত প্রবন্ধে বলেন-‘ময়ুক চৌধুরীর কবিতার ভাষা সুরেলা, উপমা সতেজ, বক্তব্য ঋজু। —-বিপর্যন্ত মূল্যবোধ এই কবিকে বিচলিত করেনি, বরং ঐতিহ্যয় সন্ধানে ময়ুখ চৌধুরীর এই অভিযাত্রা রীতিমতো দুঃসাহসিক। তাঁর সাফল্য পরিমাপ করার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’ ১৯৭৫ থেকে ২০১৯। এই দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় বাংলা সাহিত্যের এই খুরধার বোদ্ধা বিশ্লেষকের মূল্যায়ন এবং মন্তব্য আরো বহুগুণে পল্লবিত। আজ ময়ুখ চৌধুরীর সৃষ্টিশীলতা আরো শানিত-শৈল্পীক এবং অব্যাহত আছে দুঃসাহসিক অভিযাত্রায়।
ময়ুখ চৌধুরীর কবিতার সাথে আমার যখন প্রথম পরিচয় ঘটে তখনো স্কুলের সীমানা অতিক্রম করিনি। পরবর্তীতে তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক: তিনি শিক্ষক-আমি সেই শ্রেণিকক্ষের এক অযোগ্য ছাত্র তিনি কবি-আমি তাঁর কবিতার মোহন এক পাঠক। সমকাল-সমাজ ও রাজনীতির দুষিত বাতাস থেকে নিজের শরীর-মনকে বাঁচিয়ে রেখে তিনি সর্বদা সাধারণের মাঝে অসাধারণের সন্ধানি ও ধ্যানি বলে হয়তো নিজেও সবার মাঝে অসাধারণত্বে পরিণত হয়েছেন। সৃজনশীলতার আয়ুষ্কালও কামনায়! অর্ধশতবছর অতিক্রান্ত। সংখ্যার দিক থেকে অনেকের মতো দৌঁড়-ঝাঁপ না দিলেও গুণগত উৎকর্ষতায় এগিয়েছেন অনেকটা পথ। বরাবরই তিনি সংখ্যায় নয় গুণবিচারী। ১৯৬৫ সাল থেকে কবিতার চাষাবাদে নি¤œ কবির ধারাবাহিক প্রকাশনায় চোখ রাখলে তা খানিকটা অনুমেয়। প্রথম কাব্য গ্রন্থ: ‘কালো বরফের প্রতিবেশী’ প্রকাশ : ১৯৮৯, রচনাকাল : ১৯৭০-১৯৮৮। ‘অর্ধেক রয়েছি জলে, অর্ধেক জালে; প্রকাশ : ১৯৯৯, রচনাকাল : ১৯৭৪-১৯৯৮। ‘তোমার জানালায় আমি জেগে আছি চন্দ্রমল্লিক্য: প্রকাশ: ২০০০, রচনাকাল : ১৯৭১-১৯৯১। ‘প্যারিসের নীল রুটি; প্রকাশ : ২০০১, রচনাকাল : ১৯৭৬-১৯৯১। ‘আমার আসতে একটু দেরি হতে পারে; ‘প্রকাশ : ২০০২, রচনাকাল : ১৯৭২-২০০২। ‘পলাতক পেন্ডুলাম; প্রকাশ : ২০১৫। ‘ক্যাঙ্গারুর বুকপকেট; প্রকাশ : ২০১৬। ‘পিরামিড সংসার; প্রকাশ: ২০১৭। ‘জারুল তলার কাব্য; প্রকাশ ২০১৮, রচনাকাল : ১৯৭২-২০১৭। ‘ডানহাতের পাঁচটি আঙ্গুল’ একত্রে পাঁচ কাব্যগ্রন্থের পুন: প্রকাশ ২০১৬। উল্লেখ্য কবির প্রস্তুতি পর্বের পাঁচ বছরের সৃষ্ট কবিতাগুলো কোথাও গ্রন্থভুক্ত হলো কিনা অজানই থেকে গেলো।
জীবনচলার পথে নানা কারনে বাঁকবদল ঘটে। এতে কবির সৃষ্টিশীলতার ও প্রভাব পরে, গতি শ্লত হয়। কবি ময়ুখ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও কখনো কখনো তাই হয়েছে। সত্তর, আশি, নব্বই এর দশকে ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা ছাড়া চট্টগ্রামে কোন লিটলম্যাগ, কবিতাপত্র, প্রকাশিত হতো না, সেটা যতই ক্ষুদ্র কিম্বা অতি সাধারণ হউক। কারণ তিনি এসব পত্রিকা সম্পাদককে সম্মান এবং ভালবাসায় চোখে দেখতে অভ্যস্থ ছিলেন। একুশ শতকের শূন্য দশকে এসে কবিতা রচনার ক্ষেত্রে কবিকে কেন যানি খানিকটা ক্লান্ত মনে হলো। কবিতার ঘরে বাইরে কিম্বা বারান্দায় কবিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর প্রিয় পাঠকদের মাঝে হাহাকার দেখতে পেলাম। ইতোমধ্যে ২০০৫ সালে নুরুল আবসার সম্পাদিত সাহিত্য সাময়িকী ‘ষোলকলা’ প্রথম বর্ষ, শ্রাবণ সংখ্যা হাতে পেলাম। চোখে আইকে গেলো। কারণ অনেকদিন পর ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা ‘প্রাক্তন বারান্দা। কবিকে কিছু বলার সুযোগ পেলাম যেন। ‘ষোলকা’র ওপর বিস্তারিত লিখে ফেলি। ফিচার পাতায়। কবির অংশটি এখানে তুলে ধরতে চাই-‘ষোলকলার মলাট বিহীন উদম শরীরে লেপেট আছে এ-অঞ্চলের শিল্প সাহিত্যের চিরচেনা কবি ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা।—-ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা ‘প্রাক্তন বারান্দা’তে বর্ষা আসে, তবে প্রকৃতিতে নয়, স্বপ্নের ঘোরে। তাইতো তাঁর কাছে বালিশের ঋড়ন্ত তুলো হয়ে যায় আগন্তুক মেঘ। অনেকদিন পর যেন তাঁর কবিতার আবার স্বাদ পেলাম নতুন করে। ইদানীং পত্রিকার পাতা উল্টালে ময়ুখের কবিতা চোখে পরে না। আর একসময় তাঁর কবিতার ছাড়া অন্তত চট্টগ্রামে কবিতার পাতা হতো না। হয়তো বা তিনি ইদানীং কবিতার চাষাবা ছেড়ে দিয়েছেন, যেমন ছেড়েছেন এই শহর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হয়তো এখন তাঁর দিন কাটে পাঠদানে, অবসর যায় সংসার সাজাতে আর রাত গভীরতর হয় স্বপ্নের ঘোরে। অতপর পাঠকতো তাঁর কবিতা থেকে বঞ্চিত হবার কথাই। এই শূন্যতার মাঝেও ‘প্রাক্তন বারান্দা’ দিয়ে পাঠকের স্বাদ মেটানোর জন্য ‘ষোলকলা’ ধন্যবাদের দাবিদার’। (নতুন সাহিত্যের কাগজ বর্ষা¯œাত ষোলকলা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, দৈনিক পূর্বকোণ, ৬ অক্টোবর ২০০৬)। আজ ৬ অক্টোবর ২০১৯-এ ও কবিকে নিয়ে কিছু লিখতে বসলাম। কিছু যা কাকতালিয়া তো বটেই।
চাটগাঁ শহরের মানুষেরা কিন্তু কবিকে একেবারে অবজ্ঞা করেননি। এই শহরের মানুষগুলো অতটা কৃপন নন। তাই তো কবির পঞ্চাশ বসন্তে এই শহরের মেলা বসেছিল কবিতার কাগজে। কবিও কবিতাপ্রেমী মানুষ রাশেদ রউফ-এর সম্পাদনায় সূচনা সংখ্যা কবিতার কাগজে (২২ অক্টোবর ১৯৯৯) হাট বসেছিল কবি ময়ুখ বন্দনায়। নানা জন, নানা দৃষ্টিকোণে কবিকে পাল্লায় তুলে পরিমান করার চেষ্টা করেছেন। এতে অন্তত কবির কিছুটা তুষ্টিতো ছিলো। কবিতার বাঁক বদলের কবি বলে খ্যাত কবিও কবিতার সমালোচক এজাজ ইউসুফীর মূল্যায়নে সেদিন কবির নানা মাত্রিক বিষয়-আসয় স্থঅন পেলেও বিশেষভাবে বলতে চেয়েছে -‘নানা বিষয়ের প্রতি আকৃষ্টতা সত্তে¡ও বলা যায়, ময়ুখ চৌধুরীর কবিতার প্রধান ঝোঁক প্রেম আর নারীর প্রতি। রোমান্টিক প্রবণতার কারণেই তাঁর কবিতায় নারীর অবয়বে দেশ ও সমাজের নানা চিত্রাবলী পরিস্ফুট হতে দেখি। ভাষার মোহন চাতুর্যে তিনি অবলীলায় বলতে পারেন-
‘ও মেয়ে বালিকা নয় বালিকার চেয়ে কিছু বেশী
ও মেয়ে যুবতী নয় যুবতীর চেয়ে কিছু বাম’
এ ধরনের রসপূর্ণ হেঁয়ালী তাঁর অধিকাংশ কবিতায় উপজীব্য। অন্তর্গত রোমান্টিকতাকে প্রকাশ করতে গিয়ে অপরাপর কবিদের মতো তাঁকে হাপিত্যেশ করতে হয় না। বরঞ্চ রোমান্টিক চেতনাই তাঁর কবিতায় হামলে পড়তে চায়।’ (ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা: খয়েরী মানুষের মানাই, কবিতার কাগজ)।
কবি ময়ুখ চৌধুরীর প্রতি সাধারণের অভিযোগ তিনি কখনো অহংকারী, কখনো অভিমানী, কখনো তীর্যক, কখনো বা পলায়কারী। কিন্তু আমার কাছে তিনি কঠিনে কোমলে, সরলে-ব্যক্তিত্বে, আবেগে-বাস্তÍবতায়, নির্ভরতায়-বিস্ততায় পরিপূর্ণ এবং শুদ্ধতম এক মানুষ’। একদিন বাংলা বিভাগের একুশতম ব্যাচের বেশ কজন সহপাঠি হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ছুটলাম। উদ্দেশ্য ফেলে আসা প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় বিভাগ এবং প্রিয় ক্যাম্পাসের একটু সানিদ্ধ পাওয়া। স্যার তখন বিভাগের চেয়ারম্যান। সভাবতই একটু বেশি ব্যস্ত। কিন্তু না; হঠাৎ ক’জন প্রাক্তন ছাত্রদের কে পেয়ে সে কী উচ্ছ¡াস। বললেন, দাপ্তরিক কাজ আপাদতত বন্ধ। শিক্ষক, ক্যাফেতে আপনাদেরকে নিয়ে আজ্ঞা হবে। দু’ আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট চেপে ধরে বললেন-আমার বুক পকেট আজ ভারী, আপনারা যার যা-যা খেতে ইচ্ছে করে খেতে পারেন। সেদিন আমাদের আরো বার্তা পাওনা ছিল-ভাষা বিজ্ঞানী মনিরুজ্জামান স্যার এবং তাঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে অনেকগুলো। দৃষ্টি, যে ছবি আজও কথা বলে এ্যালবামের পাতা উল্টালে। চলার পথে নানা ঘটনায় স্যারকে নতুন করে চেনার সুযোগ হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ‘বাঙলা সম্মিলন ২০০৮। আমরা গুনে গুনে বত্রিশটা বাস নিয়ে ডিসি হল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সকাল বেলা প্রবেশ করি। সারাদিনের অসংখ্য স্মৃতিকে যখন পেঁছনে ফেলে পড়ন্ত বিকালে কোলাহলমুখর ক্যাম্পাসকে নিরব-নিথর করে সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের পেটের ভিতর ঢুকে পরি, তখনও আমি গাড়ির জানালা দিয়ে দেখতে পাই, আমাদের প্রিয় শিক্ষক ময়ুখ চৌধুরী সকলকে বিদায় জানিয়েও ধীরগতিতে চলন্ত বাসের পাশে রাস্তায় বিষন্ন মনে অন্যমনস্ক হয়ে নিথর দাড়িয়ে আছে, যেন তাঁর নাঁড়িছেড়া আপনজন আবার কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। আমার মনে ভয় জেগেছে অন্যমনস্ক হয়ে পড়া স্যারের গায়ে কোন চলন্ত বাসের ধাক্কা লাগে কি না? কিন্তু না! পরক্ষনে দেখতে পেলাম তাঁর সহকর্মী ও সহধর্মীনি তাঁকে বাহু-বন্ধনে আবদ্ধ করে আবাসিক ক্যাম্পাসের দিকে পা রাখলো। আমাদের গাড়িগুলোও গতি বাড়িয়ে স্মৃতি বিজড়িত সেই ক্যাম্পাসকে পেঁছনে ফেলে ছুটতে লাগলো। আর আমার চিত্তপটে জেগে ওঠলো- অনেকের থেকে এতো সতন্ত্র, এতো ধারালো, বাকপটু, অহংকারী’ মানুষটির এতো আবেগ, এতো আন্তরিকতা এতোদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল।
কবিও কবিতার সাহসী সমালোচক সিদ্দিক আহমেদ কবি ময়ুখের পঞ্চাশতম জন্মদিনের খোলা চিঠিতে দৃঢ়ভাবে বলতে চেয়েছেন ‘কবির সাহস থাকা চাই। এমন লাজ-শরমহীন প্রেম প্রকাশ কবির মানায় না। সোজা কবিতা কুমারীর বাসভবনে গিয়ে হামলা দিন। আর চাবি দিয়ে দরজা খুলে ফেলুন। আর কবিতাকে খুলে খুলে দেখুন-আর আমাদেরকে কবিতার শরীর গঠনের যাবতীয় ব্যাখ্যা দিন’ কবির একটি কবিতায় সমালোচক সিদ্দিক আহমেদ কবির বেদনাবোধ ওপলব্ধি করেছেন। কবি কবিতা কুমারীর দরজার সামনে গিয়ে প্রার্থনা করেছেন একটু আশ্রয়ের জন্য-
স্বপ্ন ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই আনিনি
কবিতা তোমার ঘরে জায়গা হবে? বালিশ ছাড়াই
যুগল পংক্তির মতো উঁচু-নিচু শুয়ে থাকতে চাই।
এখানে সিদ্দিক আহমেদের ভাবনার জগৎ থেকে একটু সরে এসে যদি ভাবা যায়- কবি কবিত্য কুমারীর কাছে একটু প্রার্থনা কিম্বা আশ্রয়ের জন্য উপনিত হননি। কবি সেই কবিতাটির অন্তরনিহিত ভাবের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন। যেভাবে সুকান্তের অমর কবিতা-
‘কবিতা তোমায় দিলাম ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূণিমার চাঁদ যেন জ্বলসালো রুটি।’
এখানে কবি সুকান্ত কবিতাটিতে জীবন খুঁজে পাননি বলে সেই কবিতার জীবনকে ছুটি দিয়েছেন সত্য, কিন্তু কবিতাকে নয়। কবিতা নির্বাসিত হবর জিনিস নয়। কবিতার নিপুন কারিগর ময়ুখ চৌধুরী ও কবিতা কুমারীর কাছে নতজানু হতে আসেননি। এই নতজানু কবিতাটির ভাবের অন্তরেই হিনীত, কবিতাতে নয়। খোলা চিঠির শেষাংশে এসে সিদ্দিক আহমেদের ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা সম্পর্কে চুড়ান্ত মন্তব্য-‘এত মন্দ শব্দ নিয়ে খোলা চিঠি রচনা করার পরও বলতে চাই বাংলা কবিতাকে প্রতিনিধিত্ব করবা ক্ষমতা আপনি অর্জন করেছেন।’ (ময়ুখ চৌধুরীকে খেঅলা চিঠি, কবিতার কাগজ)। অপরদিকে সিদ্দিক আহমেদের জ্ঞানের গভীরতাকে শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার সাথে আত্মস্থ করতে পেরেছেন বলেই ময়ুখ চৌধুরী সেই খোলা চিঠির দেড় দশক পরে এসে ‘সিদ্দিক আহমেদ সম্মানা স্মারক’ গ্রন্থে এভাবে মূল্যায়ন করেন ‘আমি ভক্তি এবং বিনয়কে কিঞ্চিত সন্দেহের চোখে দেখি তার কারণ হচ্ছে। অভিনয় জিনিসটা সবচেয়ে বেশি মানিয়ে যায় বিনয়ের মধ্যে। সিদ্দিক আহমেদ বিনয়ী নন, যেহেতু তিনি অভিনেতা বা নেতা নন। তিনি প্রকাশ্য বলেই বিশ্বাস যোগ্য, আর বিশ্বাসযোগ্য বলেই গ্রহণ যোগ্য। আমি এই ধরনের অহংকারকে পছন্দ না করে পারি না। যেহেতু আমি বুঝি সিংহের গর্জনের উৎস কোথায়। যে সমাজে অধিকাংশ মানুষ বিক্রি হওয়ার জন্য উম্মুখ হয়ে আছে, সেই সমাজে, নিঃশ্বতার গৌরবে উদ্দীপ্ত একজন মানুষকে সম্মান জানানো দরকার। যার আত্মসম্মানবোধ নেই, তাকে সম্মানিত করা যায় না।
ময়ুখ বন্দনা
তবুও আমরা করি। জানি, সম্মাননার সম্মান রক্ষা করার জন্য বেশি লোক পাওয়া যাবে না। তাই বলে একেবারে পাওয়া যাবে না। তাতো নয়। ঐ তো লোকটা- পায়ে হেঁটে যাচ্ছে বলে বেশি দূর যায়নি- তাই দেরি করলে তিনি সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে যাবেন।
সিদ্দিক আহমেদকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অন্যরা যেখানে দশ/বারো পৃষ্ঠায় আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে ময়ুখ চৌধুরী দশ/বারো লাইনে যা প্রকাশ করলেন, তার তুলনা তিনি নিজেই। যে কোন পাঠক মাত্রই ময়ুখের এই লেখাটি একবার দু’বার নয়, বার বার পড়ে নিতে মন চায়। আর সে কারণেই পুরো লেখাটি একানে উদ্ধৃত করলাম। ময়ুখ চৌধুরী শুধু কবিতার ক্ষেত্রে নয়, গদ্যের ক্ষেত্রেও যে প্রতিনিধিত্ব করবার ক্ষমতা রাখেন তাও তিনি প্রমাণ করতে পেরেছেন অল্পতেই। উল্লেখ্য, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে (১৯৭৮-১৯৮৩) ‘ঊনিশ শতকের নবচেতনাও বাংলা কাব্যের গতি প্রকৃতি’ (প্রকাশকাল ১৯৯৬) গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে বোদ্ধা পাঠক মহলে আলোড়িত হয়। গ্রন্থটির প্রেক্ষাপটে এক শতাব্দি হলেও এই বিশাল পটভ‚মিকে গবেষক ১৩৬ পৃষ্ঠার গ্রন্থে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন। গবেষকের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল কাব্যধারার গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা। গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায় এসে তিনি মূল বিষয়ের অবতারণা করেন। ‘কাব্য চিন্তায় বিচিত্রমুখী দ্ব›দ্ব ও তার পরিনাম’- এ অধ্যায়ে এসে ধ্যানী, ময়ুখ চৌধুরী কাব্য ভাবনার বিচিত্রমুখী দ্ব›েদ্বর স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন একটি ছকের মাধ্যমে। আর সমালোচক ময়ুখ চৌধুরীর স্বাতন্ত্র ও মৌলিকত্ব পাঠক সমাজ এখানেই খুঁজে পায়।
বাংলা সাহিত্য প্রাজ্ঞ আলোচকের এবং গঠনমূলক সমালোচকের অভাব রয়েছে। ময়ুখ চৌধুরী এক্ষেত্রে আরো ব্যাপক ভ‚মিকা রাখতে পারতেন। গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি প্রথম প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। আবু হেনা মোস্তফা কামালের তত্ত¡াবধানে (১৯৭০) আধুনিক যুগের কবি স¤্রাট শামসুর রহমানের প্রথম কবিতা বিষয়ক গবেষণা ‘শামসুর রহমান একজন আধুনিক কবি’।
এছাড়াও আছে তার কিছু চিন্তাশীল প্রবন্ধ ও কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ ‘কবিতা ও তার পাড়া-প্রতিবেশি’ শীর্ষক একটি রচনা- যা ‘খোলা জানালায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে পাঠকের নজরে আসে। এসব রচনাবলী নিয়ে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থও প্রকাশের কথা রয়েছে। মূলত কবি খ্যাতির চাপে অনেকটা চাপা পরে আছে একজন গবেষক সাহিত্য-সমালোচক ময়ুখ চৌধুরী। অনেকের শিল্পসত্তায় সৃজনশীলতা ও মননশীলতা এ দুয়ের দ্ব›েদ্ব যেকোন একটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আসে। তবে একটু চোখ ফোরালে দেখা যাবে, বাংলা সাহিত্য উভয় ক্ষেত্রে সমান দক্ষতার চাপ রয়েছে এমন প্রতিভা ও কিছু কিছু রয়েছে। আর এই কম সংখ্যাবাদের মধ্যে ময়ুখ চৌধুরীও একজন। কয়েকটি ছোট গল্প লিখেও তিনি প্রমাণ করেছেন কথা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তিনি এক নিপুর কারীগড়।
আজ মনে পরে, নব্বই-এর দশকের শুরুতেই আমার এই শিক্ষক একদিন এম.এ ক্লাসে বলেছিলেন- আমি চাইলে যেকোন কিছু হতে পারতাম- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা। কিন্তু না ? আমি হতে চেয়েছি একজন বাংলার শিক্ষক-তাই হয়েছি। হ্যাঁ! আজ মিকি শতাব্দ পর এসে আমার মন বলছে তিনি একজন সফল এবং জনপ্রিয় অধ্যাপক। দুটি বিশ্লেষণ একসাথে খুব কম শিক্ষকের ভাগ্যে আসে। সাগরের সেদিনের কথাটির সত্যতা খুঁজে পাই তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যেও। তিনি কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার যা চান ইচ্ছে করলে হতে পারেন। যা বাংলা সাহিত্যে গুটিকতেক লেখকের ক্ষেত্রে বলা সম্ভব। ব্যক্তিজীবনে স্পষ্টভাষী মানুষটির ব্যক্তিসত্তা ও শিল্পসত্তাকে আসলে বিচ্ছিন্নভাবে দেখবার কোন অবকাশ নেই। তাঁর সমগ্র জীবনাচরণটায় যেন অন্যরকম, অন্য ধাছে গড়া। উল্লেখযোগ্য কোন জাতীয় > ৪র্থ পৃষ্ঠায় দেখুন
> ৩য় পৃষ্ঠার পর
পুরস্কার কবিকে এখনো স্পর্শ না করলেও এ ব্যাপারে তাঁর নেই কোন অনুসূচনা বা ক্ষোভ।
কবির সবকটি কাব্যগন্থের শিরোনামেই রয়েছে এক শৈল্পিক মাদকতা ও কৌশল। আর এই মাদকতার জালে আটকে যায় আমার দু’চোখ একুশের গ্রন্থমেলায় হাজারো বই- এই স্তূপে কবির এ পর্যন্ত শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘জারুল তলার কাব্য’-এ। (প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি-২০১৮)। বইটি হাতে নিয়ে কবি এবং কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম দেখে বুকের বাম পাঁজরে মোচন দিয়ে ওঠলো। সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যান থেকে নিমিশেই মন উড়াল দিলো সেই সিকি শতাব্দ আগের ফেলে আসা ক্যাম্পাসে। শুধু আমি নই, সাথে থাকা বন্ধ নাজমুল টিটো এবং নিজাম ও বইটির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কারণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই জারুল তলায় তাদেরও সকাল-দুপুর কেটেছে চঞ্চল হরিণের মতো। বইটির প্রথমে নাম দেওয়ার কথা ছিল ‘জারুল তলা’। কোশলী কবি বইটিও উৎসর্গ করেন এভাবে-
একদিন জারুল তলায়
যারা এসেছিল
যারা আসছে
যারা আসবে
এই জারুল তলায় যাওয়া-আসার খেলা চলতে থাকলেও বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে কবি স্বয়ং সেই ১৯৬৯ সাল থেকে আজ অবধি জারুল তলাতেই রয়ে গেলেন। এখানো তিনি দূর থেকে অবলোকন করেন-
দুপুর বেলার একটু পরে
জারুল ফুলের বৃষ্টি পরে
উষ্ণ চায়ের কাপে
এ গ্রন্থটিকে কবির প্রায় অর্ধশত জীবনের গল্প-ভালোবাসা ভালোলাগা বিদ্যমান। জারুল তলার প্রেম বিরহের বাঁধভাঙা আড্ডা আর পদভারে মুখরিত তরুণ-তরুণীদের যেন তীর্থস্থান ছিল আছে থাকবে। জারুল তলার কাব্য কোন সাধারণ কাব্য গ্রন্থ নয়। এটি এক মহাকাব্য। আর এই মহাকাব্যের মহানায়ক কবি নিজেই। ১৯৭২ সালে জারুল তলার কবি লিখেন-
নীলিমা, তোমাকে আমি যেটুকু দিয়েছি ভালোবাসা
একবার ধরা দাও, প্লিজ
আমি অহংকারী আকাশটা মেপে দেখে আসি
আবার সে কবি ২০১৭’তে এসে সেই জারুল তলায় কাব্য লিখেন-
সব কিছু পারতে হবে কেন
যত দূর পারো হেঁটে যাও।
নিজেকে আবার ফিরে পেতে
মাঝে মাঝে নিজেকে হারাও।
যতদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায় থাকবে, জারুল তলা থাকবে, ততদিন ভালোবাসার সুখ স্মৃতি ও প্রবাহমান থাকবে জারুল তলার কাব্যে। ‘জিরো-পয়েন্ট টু ইনফিনিট’তে কবি বলেন-
ইস্টিশনের অল্প দূরে অন্যরকম তরী
জারুল তলার তরুণ ছায়ায় থমকে গেছে ঘড়ি।
শিল্প সৌন্দর্যের বিচারেও ‘জারুল তলার কাব্য’ কবির এক অনবধ্য সৃষ্টি। কবির এই জন্ম মাসে বাতিঘরের প্রিয়মুখ সঞ্চয়ের কাছে জানতে চাইলাম- জারুল তলার কাব্যের চাহিদা কেমন ? সঞ্চয় সভাবসুলভ হাসিতে যা বলল- বুকে আসা জাগলো পাঠভ্যাসের এই ক্লান্তিকালে এসেও কবির কবিতাকে খুঁজতে আসে পাঠক।
কবির জন্মদিনে আমি বার বার ফিরে আসি তাঁর ‘জন্মরাতে’ কবিতায়। যতই পাঠ করি ততই মোহগ্রস্ত হই। খুঁজে ফিরি কবি জন্মদিনে আর কোন কিবতা লিখেছেন কিনা ? না- সত্তরতম জন্মদিনে এসেও আমার চোখে পড়েনি। আসলে কবি লিখছেন না, তা নয়! লিখতে পারছেন না। ‘জন্মরাতে’ জীবনে একবারেই লিখা যায়। অঙ্কের হিসেব করে দেখলাম, কবির সেদিন ছিল একত্রিশতম জন্মদিন। সম্ভবত কবি পরভাসে। আসেপাশে নেই কোন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং আপন প্রকৃতিও। টেবিলের ওপর পরে আছে রবীন্দ্রনাথের জটিল গবেষণা কর্ম চালিয়ে যেতেই হবে, কারণ হেনা স্যারের আদেশ, অমান্য করা যাবে না। জন্মদিনের কবিতা সৃষ্টির জন্য বুকের গহীনে যে আলোড়ন প্রয়োজন। যে হীনশীতল পরিবেশ দরকার সেটি সৃষ্টি হয়েছি কবি হৃদয়ে। সেরাতে ‘জন্মরাতে’ আসলেই সকলের জন্মদিনের কবিতা। পাঠকও আর একবার পড়ার জন্য পুরো কবিতাটি-
আজ আমার জন্মদিন মনেই ছিল না
সারাটা দুপুর এখানে-ওখানে ঘুরেছি
আমাকে পকেটে একটা বলপেন গুঁজে দিয়ে কেউ বললো না-
ঐধঢ়ঢ়ু নরৎঃযফধু….
সামান্য জ্বরে কপালটা পুড়তে পুড়তে উঠোনের মতো প্রশান্ত হয়ে উঠেছিল
নোংরা উঠানে শিওলি গাছের মতো
একটি হাতও ছিলো না তপ্ত ললাটে
জ্বরের ভেতর থেকে জিরাফের মতো গ্রীবা উঁচিয়ে
দেখে নিচ্ছিলাম
২২-এ অক্টোবর আর ফ্যানের বাতাসে অস্থির ক্যালেন্ডারকে।
আজ সারাদিন
আমার দরজার টোকা দিয়ে কেউ বললো না-
‘না তুমি একা নাও’।
আজ এই বিদেশি অন্ধকারে
আজ এই সমস্ত রাত্রিভর
আমি নিজেই মোমবাতির শিখার মতো জ্বলতে থাকবো,
দেখি শেষ পর্যন্ত কোন প্যাঁচা এসে বলে কি না,-
‘বাতিটা নেভাও, আমি কষ্ট পাচ্ছি।’
(জন্মরাতে/কালো বরফের প্রতিবেশি)
শরতের কোন এক সকল, দুপুর কিম্বা বিকেল বেলায় কাশফুলের মতো শুভ্রতা নিয়ে কবি হয়ে মর্তালোকে আসেন ময়ুখ চৌধুরী। শহর চট্টগ্রামেই মধ্য বিশ শতকে জন্ম নেওয়া ময়ুখ চৌধুরীর জন্ম বেড়ে ওঠা এবং যাপিত জীবন সবেই এই শহর এবং শহর তলিতেই। আর এখানেই কবির সব দুঃখ-গøানী ও ক্ষোভ। আমার বিশ্বাস, তাঁর সব গুণাবলী এক সময় চাপা পরে গেলেও তিনি সত্তর নয়। শত-সহ¯্র বছর বেঁচে থাকবেন একজন কবি হয়ে। এই চট্টগ্রাম থাকে কিছুই দিতে পারেনি বটে,- তবে একজন কবি বানিয়েছেন। চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে কবির সত্তরতম জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।