সতর্কতা ঠেকাতে পারে বজ্রপাতে প্রাণহানি

5

তুষার দেব
গ্রামীণ জনপদে কৃষিকাজসহ জনজীবনে ধাতব যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং অসেচতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন না করার কারণেই চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে বজ্রপাতে প্রাণহানি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়াকেও বজ্রপাতে প্রাণহানি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। বজ্রপাতে প্রাণহাণির ঘটনা শহরের চেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদেই বেশি ঘটছে। আক্রান্তদের বেশিরভাগই পেশায় কৃষক ও জেলে। সর্বশেষ গত রবিবার কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও পেকুয়া এবং চট্টগ্রামে বাঁশখালী উপক‚লে বজ্রপাতে নিহত চারজনই পেশায় জেলে ছিলেন। বজ্রপাতের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণহানি ঠেকাতে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ছাড়াও সতর্কতা ও সচেতনতা তৈরির উপরই বেশি গুরুত্বরোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৯ জুন কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় বজ্রপাতে তিনজনের প্রাণহানি ও ২ জন আহত হয়েছেন। ওইদিন দুপুর ১২ টার দিকে কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরং ইউনিয়নে চোল্লাপাড়ায় এবং দুপুর একটার দিকে পেকুয়ার মগনামা ইউপির শরৎঘোনা এলাকায় এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন পেকুয়ার রমজান আলী (৪৫), কুতুবদিয়ার জেলে ইমতিয়াজ হোসেন (২৫) ও মো. করিম (৩৫)।
এদের মধ্যে পেকুয়ার রমজান আলী মাছ ধরতে বিলে যান। এ সময় বজ্রাঘাতে তিনি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। আর সাগরে মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় কুতুবদিয়ার উপক‚লবর্তী চোল্লাপাড়ায় সাগরপাড়ে ফিশিং ট্রলার সংস্কারের কাজ করছিলেন কয়েকজন মাঝি। দুপুর ১২ টার দিকে বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হলে ট্রলার মেরামত কাজে থাকা চার মাঝি আহত হন। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে কুতুবদিয়া হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক ইমতিয়াজ ও করিমকে মৃত ঘোষণা করেন। আক্কাস ও রমিজ নামে আহত দু’জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
একইদিন ভোরে বাঁশখালী উপক‚ল থেকে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে দিনার আলী (২৫) নামে এক জেলে প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত দিনার আলী বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনা চার নম্বর ওয়ার্ডের মুক্তিযোদ্ধা মৃত কাশেম আলীর ছেলে। ভোরে দিনার আলীসহ পাঁচজন একসাথে ফিশিং বোট নিয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে রওনা দেয়। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ বজ্রপাতে দিনার আলী ফিশিং বোটেই মারা যান। তিনি ওই ফিশিং বোটের মাঝি ছিলেন। জেলেরা তাকে মৃত অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে আসেন। চলতি মাসের কেবলমাত্র গত তিনদিনেই (১৭-১৯ জুন) চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৫ জন।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে গত ১১ বছরে দুই হাজার আটশ’ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বজ্রপাত। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে যাদের জীবন-প্রদীপ নিভে গেছে, তাদের বেশিরভাগই আক্রান্ত হওয়ার সময় খোলা মাঠ কিংবা বিল-হাওরে হয় কৃষিকাজ নয়তো মাছ আহরণ করছিলেন। এর মধ্যে বিগত ২০১১ সালে বজ্রপাতে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১, ২০১৩ সালে ১৮৫, ২০১৪ সালে ১৭০, ২০১৫ সালে ২২৬, ২০১৬ সালে ৩৯১, ২০১৭ সালে ৩০৭, ২০১৮ সালে ৩৫৯, ২০১৯ সালে ১৯৮ এবং ২০২০ সালে ২৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর গতবছর অর্থাৎ ২০২১ সালে বজ্রপাতে মানুষের প্রাণহানি আগের যে কোনো বছরের রেকর্ড অতিক্রম করে। ওই বছর দেশে বজ্রপাতে প্রাণ গেছে ৩৬৯ জনের।
দেশের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের প্রণীত প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ধসের মত ঘটনাগুলো আগে থেকেই তালিকাভুক্ত ছিল। বজ্রপাতে প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার বিগত ২০১৬ সালে এটাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। বজ্রপাতজনিত জানমালের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সারা দেশে তালগাছ রোপণসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু তাতে বজ্রপাতে মানুষের প্রাণহানি খুব একটা কমেনি। বর্তমানে সরকার বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের মত ‘বজ্রপাত আশ্রয়কেন্দ্র’ করার পরিকল্পনা করেছে। ৪৭৬ কোটি টাকার ওই প্রকল্প মূলত দেশের বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বজ্রপাতবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ডিজাস্টার ফোরামের সমন্বয়কারী মেহেরুন নেসা ঝুমুর পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের দেশে বজ্রপাতের ঋতু ও এলাকাভিত্তিক ভিন্নতা আছে। যেমন বর্ষা মৌসুমের আগের সময়টাতে দেশের হাওর এলাকায় বেশি বজ্রপাত হয়। বর্ষাকালে সারা দেশেই কমবেশি বজ্রপাত হয়, আর বর্ষার শেষে দেশের পাহাড়ি এলাকায় বেশি বজ্রপাত হয়। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিনা, সেটা খতিয়ে দেখা জরুরি। তা না হলে প্রকল্পের কার্যকর সুফল অর্থাৎ বজ্রপাতে প্রাণহানির মিছিল ঠেকানো যাবে না।