সঙ্গীতের কিংবদন্তী শাহনাজ রহমত উল্লাহ্

13

দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে গানের রাজ্যে অবাধে সাফল্যের সঙ্গে বিচরণ করেছেন তিনি। ক্যারিয়ারে মধুঝরা কণ্ঠে কালজয়ী হয়ে আছে যাঁর অসংখ্য গান। দেশাত্মবোধক এবং চলচ্চিত্রের গানে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। তাঁর গাওয়া কালজয়ী দেশাত্মবোধক ওইসব গান এখনো সর্বস্তরের বাঙালির প্রাণ স্পন্দিত করে। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল অদ্ভুত মুগ্ধতা। নিয়মিত চর্চা, অধ্যাবসায় এবং সাধনার প্রতিদানস্বরূপ কণ্ঠ মাধুর্য গুণেই হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের সঙ্গীতের এক কিংবদন্তী। পারিবারিক ডাক নাম তাঁর-শাহীন। সঙ্গীত জীবনের প্রথম দিকে যিনি শাহনাজ বেগম নামেই ছিলেন পরিচিত। তিনি বাংলা গানের বিরল এক কণ্ঠস্বর, শিল্পী শাহনাজ রহমত উল্লাহ্। ইংরেজি ১৯৫২ সাল ২ জানুয়ারি। ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন শাহনাজ রহমত উল্লাহ। তাঁর পিতার নাম এম ফজলুল হক ও মাতা-আসিয়া হক। এক ভাই দেশবরেণ্য সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজ এবং আরেক ভাই জাফর ইকবাল ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের চিরসবুজ অভিনেতা ও জনপ্রিয় গায়ক। বাবার অনুপ্রেরণা আর মায়ের প্রত্যক্ষ তত্ত¡াবধানে একেবারে ছোটবেলায় শাহনাজ এর গানে হাতেখড়ি। বাবা এম ফজলুল হকের উৎসাহ এবং মা আসিয়া হকের অনুপ্রেরনায় শাহনাজকে ওস্তাদ রেখে গান শেখানো শুরু করেন। বরেণ্য এ শিল্পী উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম নেন-ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ এর কাছে। তিনি ওস্তাদ মনির হোসেন, শহীদ আলতাফ মাহমুদের কাছেও গানে তালিম নেন। গজল শিখেছেন উপমহাদেশের কিংবদন্তী গজল স¤্রাট মেহেদী হাসান’র কাছে। পÐিত বারীণ মজুমদারের মাধ্যমে তিনি উপমহাদেশের কিংবদন্তী এই গজল স¤্রাটের সাহচর্য পান। খেলাঘরেও গান শিখেছেন তিনি। ওই সময়টায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দেশের আরেক কিংবদন্তী শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। তাঁরা নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। ছোট্ট বয়সে পরিণত কণ্ঠের কারণে ওস্তাদের পাশাপাশি অন্য অনেকের প্রিয় শিক্ষার্থী হয়ে ওঠেন শাহনাজ রহমত উল্লাহ।
শাহনাজ রহমত উল্লাহ সেই ছোট্ট বয়সে বেতারেও গাইতেন। ছোটবেলা থেকেই শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে ‘নতুন সুর’ সিনেমার গানে নেপথ্যে কণ্ঠ দেন। এরপর বহু চলচ্চিত্রের গানে নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। মূল নাম শাহনাজ বেগম হলেও পরবর্তীতে শাহনাজ রহমত উল্লাহ্ হিসেবেই সঙ্গীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের গানের জগতে অত্যন্ত পরিচিত একটি নাম-শাহনাজ রহমত উল্লাহ। বিশেষ করে দেশাত্মবোধক গানের জন্য সর্বসাধারণের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সাল থেকে টেলিভিশনে গাইতে শুরু করেন। ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশন এর ঢাকা কেন্দ্রের শুরুর দিকেই প্রযোজক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল সৈয়দ। মূলত তাঁরই অনুষ্ঠানে গাওয়া শাহনাজ রহমত উল্লাহ অনেকগুলো গান কালজয়ী হয়ে অগণিত মানুষের মন জয় করেছেন। ১৯৭৩ সাল। ব্যক্তিগত জীবনে সেনা কর্মকর্তা আবুল বাশার রহমত উল্লাহ’র সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শাহনাজ রহমত উল্লাহ। এই দম্পতির এক কন্যা ও এক পুত্র রয়েছে। স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর আবুল বাশার রহমত উল্লাহ একজন ব্যবসায়ী। মেয়ে নাহিদ রহমত উল্লাহ থাকেন লন্ডনে। আর ছেলে এ কে এম সায়েফ রহমত উল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এখন কানাডায় থাকেন। ষাটের দশকে সঙ্গীতাঙ্গণে এসে পাঁচ দশক ধরে গান গেয়ে গেছেন শাহনাজ রহমত উল্লাহ্। একের পর এক দেশাত্মবোধক, চলচ্চিত্রের প্লে­ব্যাক ও আধুনিক গানে মাতিয়েছেন শ্রোতাদের মন।
২০০৬ সাল। বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমত উল্লাহর গাওয়া চারটি গান স্থান করে নেয়। ক্যারিয়ারের পঞ্চাশ বছর পূর্তির পর গান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবেই বিদায় নেন শাহনাজ রহমত উল্লাহ্। ২০০৮ সালের পর থেকে একেবারেই নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিসরূপ ১৯৯২ সালে রাষ্ট্র তাঁকে সম্মানিত করেছেন একুশে পদকে ভূষিত করে। এর আগে ১৯৯০ সালে ছুটির ফাঁদে চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শাহনাজ রহমত উল্লাহ্।
২০১৬ সালে ‘চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’-এর আয়োজনে আজীবন সম্মাননা জানানো হয় গুণী এই শিল্পীকে। এছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার-সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন কিংবদন্তি এই সঙ্গীতশিল্পী। ২০১৯ সাল ২৩ মার্চ। বাংলা গানের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমত উল্লাহ্ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬৫ বছর বয়সে ঢাকার বারিধারায় নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।