সংস্কৃত ভাষার ধ্রূপদি কবি কালিদাস- এর কালজয়ী সৃষ্টি সম্ভার

451

সংস্কৃত সাহিত্যের দিকপাল কবিপতি কালিদাস। প্রাচীন যুগের এই ভারতীয় কবি গুপ্ত সাম্রাজ্য চলাকালিন কোনো একসময় জন্ম গ্রহন করেছিলেন। খুব সম্ভবতঃ ভারতবর্ষ তথা বিশ্ব ইতিহাসে কবি কালিদাসই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সংস্কৃত ভাষার মতো একটি কঠিন ভাষায় তার কাব্যচর্চা জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত অব্যাহত রেখে এই ভাষার সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাকে অমরত্ব দান করেছিলেন। বর্তমান পৃথিবীতে যে ক‘টি ভাষা হারিয়ে গেছে তার একমাত্র কারণ হচ্ছে উক্ত ভাষা সমূহের মধ্যে কোনো কবি সাহিত্যিক জন্ম গ্রহণ না করা । ভাষার কথ্যরূপ থাকলেই কেবল ভাষা টিকে থাকেনা, ভাষার লিখিত রূপের ব্যাপক চর্চা না থাকলে সেই ভাষা কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একসময় পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে সংস্কৃত ভাষার বেশ চর্চা ছিলো এই ভাষায় অনেক পন্ডিত ব্যক্তিও জন্ম গ্রহণ করেছিলো কিন্তু ভাষাটি অপেক্ষাকৃত কঠিন এবং কম মানুষ ব্যবহার করায় ক্রমেই এই ভাষাটি তার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলতে থাকে বর্তমানে বলতে গেলে এই ভাষায় তেমন বেশি লোকে কথা বলেনা। ভারতবর্ষে মাত্র সাতটি গ্রামের সর্বসাকুল্যে পঁছিশ থেকো ত্রিশ হাজার মানুষ সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে। তবে সনতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজা পার্বণে এখনও এই ভাষায় মন্ত্র, শ্লোকাদি উচ্চারিত হতে দেখা যায় আর তাই এই ভাষার লিখিতো রূপ এখনও দৃশ্যমান। দূর অতীতে বিশেষ করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় ব্রাহ্মণদের মুখেই এই ভাষা বেশি উচ্চারিত হতো। কথিত আছে যে কোনো অচ্যুত স¤প্রদায় এই ভাষার চর্চা করতে পারতোনা। ব্রাহ্মণরা আদিম কাল থেকেই ভারতবর্ষে নিজেদের সব মানুষের চেয়ে সেরা মনে করতো আর তাই তারা যা করতো তা অন্যরা করতে পারবেনা বলে মনে মনে অহংবোধ করতেন। আর এই কারণেই ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে এক বিরাট জনগোষ্ঠী সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শি হয়ে ওঠেছিলো। অবশ্য সংস্কৃত ভাষা ছাড়াও তৎকালিন সময়ে ভারতবর্ষে আরো অন্যান্য ভাষাও প্রচলিতো ছিলো।
পরবর্তিতে অবশ্য ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণদের একাধিপত্যের পতণ ঘটেছিলো কিছু অত্যাবশ্যকীয় সামাজিক কারণে। তৎকালিন ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে এতোবেশি সামাজিক সীমারেখা টেনে দিয়েছিলো যে, যা সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে যৌক্তিক কারণে ভাঙ্গতে বাধ্য হয়েছিলো। কবি কালিদাস ঠিক এমনই একটি সংস্কৃত ভাষার পরিমন্ডলে বড় হয়েছিলেন এবং তিনি কাছ থেকেই দেখতে পেরেছিলেন সংস্কৃত ভাষাভাষী মানুষদের সুখ- দুঃখের বিভিন্ন ঘটনাবলি। আর এইসব ঘটনাবলির দৃশ্যকাব্যগুলোই তার সংস্কৃত কাব্য এবং নাটক গুলোতে পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতপক্ষে কবি কালিদাসের প্রাথমিক জীবন তেমন সুখকর ছিলোনা তিনি ছিলেন অক্ষর জ্ঞানহীন, তবে তিনি ছিলেন দেখতে বেশ সুন্দর। কথিত আছে যে কালিদাসের সময় গুপ্ত সাম্রাজ্যে এক তেজস্বী রাজকত্যা বসবাস করতেন। এই নারী কথায় কথায় বিতর্কে জড়াতেন রাজ্যের বিদগ্ধ সব জ্ঞানী মানুষদের সাথে। অবলিলায় যুক্তি তর্কের জাল বিছিয়ে পরাজিতো করতেন তাবড় তাবড় রাজসভায় থাকা পান্ডিত্য চাহির করা শিরোমণিদের। রাজকত্যার দিন যাচ্ছিলো এভাবেই। পন্ডিতরা রাজকত্যার এধরনের অপমান অপবাদ সহ্য করতে না পেরে সবাই এক হয়ে ধরে আনলেন এক অনিন্দ্যসুন্দর রূপবান পুরুষকে। যিনি ছিলেন এসব পন্ডিতদের মতে একেবারেই গন্ডমূর্খ। কেননা তারা দেখেছিলেন এই বোকা মানুষটি যে ডালে বসেছিলেন সেই ডালকেই কেটে ফেলতে। অতএব তারা রাজকত্যাকে জব্দ করতেই একেবারে শিখিয়ে পড়িয়ে রাজসভায় নিয়ে আসলেন এমন বোকাসোকা এলজন মানুষকে। রাজকত্যা নিয়ম অনুযায়ি পরীক্ষা নিলেন তার পান্ডিত্যের। পুরুষটি আঁড়াল থেকে পন্ডিতদের বলে দেয়া কথা সহজেই উৎরে গেলেন অহংকারি রাজকত্যার পরীক্ষায়। অতঃপর রাজকত্যার ইচ্ছায় শুভ পরিণয় সম্পন্ন হলো রাজকীয় মর্যাদায়। কিন্তু শেষরক্ষা হলোনা। ফুলশয্যার রাতে রাজকত্যা ধরে ফেললেন পন্ডিতদের চাতুরী। কূটকথা, ব্যঙ্গ আর অপমান করে সেরাতেই রাজ প্রাসাদ থেকে বের করে দিলেন বোকাসোকা মানুষটিকে। রাগে, ক্ষোভে দুঃখ নিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে বদ্ধ পরিকর বোকাসোকা মানুষটি নদীতে ঝাঁপ দেয়ার প্রাক্কালে দেখা পান তার আরাধ্যা দেবীর এবং তিনিই রক্ষা করেন ভক্তের প্রাণ। সেদিন প্রাণে বেঁচে যাওয়া বোকাসোকা মানুষটিই হচ্ছেন পরবর্তিকালের সংস্কৃত সাহিত্যের অমর কবি কালিদাস। কালী ঠাকুরের আরাধনা করতেন বলেই তিনি কালীর দাস কালিদাস। কোনো কোনো সংস্কৃত পন্ডিতদের মতে কালিদাস সরাসরি সরস্বতী দেবীর আশির্বাদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন বিধায় এমন গন্ডমূর্খ মানুষটি হঠাৎই ক্রমেই জ্ঞানী মানুষে পরিণতো হয়ে ওঠেছিলেন। মূলতঃ উক্ত ঘটনার পরই কালিদাস পুরো বদলে যান। লাভ করেন অসাম্য কবিত্ব শক্তি। পরবর্তি সময়ে দেশ ও কালের সীমা অতিক্রম করে তার কবিত্ব প্রতিভা বিশ্বসাহিত্যে একটি স্বতন্ত্র আসন অর্জন করে নেয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় কবি কালিদাসের জন্মও জনপদ নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্নের এখনও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। বিষয়গুলো আজও অনুসন্ধিৎসা সাপেক্ষেই রয়ে গেছে। কবি কালিদাসের জন্ম ও জীবন নিয়ে পন্ডিতদের মতবিরোধ ভবিয্যতে মিটবে কীনা আমাদের জানা নেই, কিন্তু তার চির দিব্যমান সংস্কৃত সাহিত্যেগুলো যুগে যুগে যে মানুষকে জ্ঞানের পথ দেখাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সংস্কৃত সাহিত্য জগতে কাব্য, নাটকসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে নিজের শ্রেষ্টত্বের প্রমাণ রেখে গেছেন কবি কলিদাস। সংস্কৃত
সাহিত্য মুখ্যত দৃশ্যকাব্য এবং শ্রব্যকাব্য এই দুই ভাগে বিভক্ত। “দৃশ্য শ্রব্যত্ব ভেদেন পুন কাব্যং দ্বিধাদ্মধম…”।
কালিদাস যেমন এধরনের অপূর্ব সব শ্রব্যকাব্য রচনা করে গেছেন তেমনি অন্যদিকে মাত্র তিনটি নাটক ও চারটি কাব্য রচনা করে সংস্কৃত সাহিত্যের নিজের নাম অমর করে গেছেন। ১- মালবিকামিত্রম ৩ – বিক্রমমোর্বশীয়ম ৩- অভিজ্ঞান শকুন্তলম – কবি কালিদাস রচিত এই তিনটি দৃশ্যকাব্য নাটকের নায়ক- নায়িকারাই তৎকালিন সময়ের ওপরের তলার মানুষ। নায়ক রাজা সব নাটকেই। নাটকের এসব নায়করা সৎবংশজাত, ধীরোদা ও বহুগুণে গুণান্বিত পুরুষ। নায়িকারাও কোথাও আশ্রম কন্যা, কোথাও রাজকন্যা ত্রিভূবনজয়ী রূপের অধিকারিণী, আবার কোথাও নায়িকা দেব সভায় নর্তকি আর সুরসভায় অমর আনন্দের অধিকারিণী।
এইসব নায়ক- নায়িকাদের নিয়েই প্রেমিক কবি কালিদাস উপরোক্ত তিনটি প্রেমের নাটক রচনা করেছেন।
নাটকগুলোতে কালিদাসের প্রেম কোথাও অরুণরাগে রঞ্জিতো, বসন্তের রক্তিমরাগে রঞ্জিতো, কখনও বিরহের করুণবাণীতে বিধূর কখনওবা মিলন- আনন্দের মধূর মদির। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় কালিদাস রচিতো উপরোক্ত নাটকগুলো বিষয় বৈচিত্র্য, হৃদয়ে রাগ অনুরাগ, আবেগে উচ্ছ্বলতায় ত্যাগে, সংযমের দ্বগ্ধতায় মানুষের মনের রঙ তার অনুপম ভাষায় ও অনিন্দ্য শব্দভান্ডারে অনুকরণীয় উপমায় নিবিড়ভাবে এঁকেছেন আর তাই কালিদাস বলেই হয়তো নাটকের নায়ক- নায়িকারা আমাদের কাছে অচেনা হয়ে থাকেনা। রচনার চিত্রময়তায় নাটকের চরিত্রগুলোর জীবন দোলায় আমাদের অজান্তেই দোলতে থাকি আমরা। ঠিক এখানেই অকালস্রষ্টা কবি কালিদাসের নাটক রচনার পারঙ্গমতা। আর একারণেই কবি কালিদাস মানুষের মনে স্থায়ি আসন লাভ করেছে। ‘ঋতুসংহার’, ‘মেঘদূতম’, ‘রঘুবংশম’, ও ‘কুমারসম্ভব’- এই চারটি কাব্য রচনা করেছেন কবি কালিদাস। তার এই সৃষ্টিসম্ভার পরবর্তি কালে বাংলা সাহিত্যকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলো। ‘মেঘদূত’ কাব্যটিকে সংস্কৃত পন্ডিতরা বর্ষাকাব্য, বিরহকাব্য ও গীতকাব্য হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। প্রাচীনকালে বর্ষা আরম্ভ হওয়ার আগেই প্রবাসিরা ঘরে ফিরে আসতেন। কেননা তখন বর্ষা মানেই কর্মহীন জীবন সেসময় বাণিজ্যও চলতোনা। সেই বর্ষা ও তার বিরহগাঁথা নিয়ে মন্দ্রাকান্তা ছন্দে রচিতো মেঘদূত কাব্যটিতে কবি কালিদাস তার অসাধারণ কাব্য প্রতিভায় ফুটিয়ে তুলেছেন এক নির্বাসিতো যক্ষের প্রিয়াবিরহ।
মুলতঃ সংস্কৃত ভাষায় রচিতো প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ কাব্য শুদ্ধ বিরহকে অবলম্বন করেই কবি কালিদাস এই কাব্যটি রচনা করেছিলেন। কর্তব্য অসচেতনতায় প্রভুর অভিশাপে যক্ষকে রামগিরি পর্বতের বিজন আশ্রমে নির্বাসিতো হতে হয়। সেখানে বসেই আষাঢ়ের প্রথম দিনের নববর্ষার মেঘ দেখে তারই মাধ্যমে অলকাপূরীর প্রাসাদে তার বিরহী প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠানোর জন্য মনঃস্থির করেন। অসাধারণ ভৌগলিক বর্ণনা, অববদ্য চিত্রকল্প আর কাব্য প্রতিভার মুন্সিয়ানার চূড়ান্ত নিদর্শন কবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’। অনেকেই কবি কালিদাসকে ইংরেজ সাহিত্যিক শেক্সপিয়ারের সাথেও তুলনা করেন কারণ শেক্সপিয়ারের মতো খুব কম সংখ্যক নাটক এবং কাব্য রচনা করেই কালিদাস আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তাছাড়া শেক্সপিয়ারের প্রতিটি নাটকে যেমন রাজা বাদশারা ছিলো, কালিদাসের নাটকেও তেমনটি দেখা যায়। উল্লেখ্য যে ইংরেজি সাহিত্যের জনপ্রিয় সাহিত্যিক শেক্সপিয়ার মাত্র ৩৭টি নাটক রচনা করেই বিশ্ব সাহিত্যকে যুগ যুগ ধরে শাসন করে আসছেন। সত্যিকথা বলতে কী, এখনও ভাবতে অবাক লাগে জীবনের শুরুতে অক্ষরজ্ঞানহীন এবং চালচুলোহীন একজন মানুষ পরবর্তি সময়ে কি অপরিসীম নিষ্ঠা ও তপস্যায় একের পর এক কালজয়ি সৃষ্টি।
কল্পনার ব্যাপকতা, শিল্পরূপময়তা ও অর্থের গভীরতায় তার রচনাকে বিশ্ব সাহিত্যে এক অন্যমাত্রা দান করেছেন। কাব্যে ভিন্ন ছন্দের প্রয়োগেও কবি কালিদাসের নৈপুণ্য অতুলনীয়। জীবনধর্মিতা, বিষয়ানুক‚ল পরিবেশ, ঘটনা প্রবাহের গতিশীলতা এবং সর্বোপরি সুখবোধ্যতাই কারণেই মনে হয় মানুষ কালিদাসকে মহাকবির অভিধায় ভূষিতো করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কবি কালিদাস প্রাচীন যুগের একজন অনন্য মননশীল কাব্য প্রতিভা সম্পন্ন মেধাবি সাহিত্যিক ছিলেন, যার প্রতিটি কাব্যে ছিলো প্রকৃতি ও মানুষের সুনিপুণ উপস্থিতি। কালিদাসের ক্ষুরধার লেখনি সহজেই তৎকালিন সময়ের মানুষকে আলোড়িতো করতে পেরেছিলো। তৎকালিন সমাজের শেখড়ের সাথে মিশে গিয়ে জ্ঞানের সর্বোচ্চ শাখায় অবস্থান করে কালিদাস একের পর এক রচনা করতে পেরেছিলেন কিছু অসাধারণ সাহিত্য, যে সাহিত্য আজো বিশ্ব সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ হয়ে সাহিত্যপ্রেমীদের মাঝে জ্ঞানের আলো বিতরণ করে যাচ্ছে ।