সংশোধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বিধি পর্যালোচনা

87

সময়ে সময়ে চাকুরীর নিয়োগ বিধি, পরিবর্তন সংশোধন পরিমার্জন পরিবর্ধন করে যুগোপযোগী করে নিতে হয়। বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কার্যপরিধি অনুযায়ী গ্রেড নির্ধারণ করা হয়। একই সাথে সরকার, চাকুরীতে অনেক বিভাগীয় পদে পদ মর্যাদা, কার্যপরিধি, শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী গ্রেড পরিবর্তন করেছেন এবং করছেন। সাধারণত সেই পরিবর্তন হয়ে থাকে যোগ্যতা বাড়িয়ে উচ্চ ধাপে নিয়ে আসা। যেমন পুলিশ বাহিনীর সৈনিক পদে আগে ৮ম শ্রেণি পাশ হলেও এখন এসএসসি পাশ, এমএলএসএস পদে আগে ৫ম শ্রেণি হলেও এখন ৮ম শ্রেণি পাশ। এমনকি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বা বিসিএস ক্যাডার নিয়োগে আগে ছিল স্নাতক ডিগ্রী হলেও এখন মার্স্টাস ডিগ্রী। এই রকম অনেক চাকুরীতে গ্রেড পরিবর্তন করে, বা গ্রেড পরিবর্তন না করে শিক্ষাগত যোগ্যতা পরিবর্তন আনা হয়েছে। একই ভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালায়ও সময়ে সময়ে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক নিয়োগে এমন একসময় ছিল ৮ম শ্রেণি পাশ। এরপর পর্যায়ক্রমে এসএসসি, এইচএসসি, এবং বর্তমানে পুরুষ মহিলা শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্নাতক ডিগ্রী করা হয়েছে। চাকুরীতে বয়স, গ্রেড, শিক্ষাগত যোগ্যতা, বেতনভাতা, স্কেল ইত্যাদি সাধারণত পরিবর্তন করে, পরবর্তী ধাপে বা উচ্চ ধাপে নেয়া হয়ে থাকে; যা নিম্ন ধাপে আনা অস্বাভাবিক ও অসম্ভব। অসম্ভব বলছি এই জন্যে আগে সরকারি চাকুরীতে নিয়োগে বয়স সীমা ছিল ২৭ বছর, এখন ৩০ বছর করা হয়েছে, এবং ৩৫ বছর করার প্রস্তাব রয়েছে।
অনেক ডির্পাটমেন্টে অনেক পদ, দ্বিতীয় শ্রেণি হতে ১ম শ্রেণিতে, আবার তৃতীয় শ্রেণি হতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হয়েছে, কিংবা গ্রেড পরিবর্তন করে উচ্চ ধাপে আনা হয়েছে। একই সাথে শিক্ষাগত যোগ্যতাও উপর দিকে আনা হয়েছে। এই পরিবর্তন অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অস্বাভাবিক ও অসম্ভব হবে যদি বয়সসীমা ৩০ থেকে কমিয়ে ২৫ বছর করা হয়। ৯ম গ্রেড (২২০০০) থেকে নামিয়ে ১০ম গ্রেড (১৬০০০) স্কেল করা হয়, কিংবা এসএসসি পাশ কমিয়ে ৮ম শ্রেণি পাশ করা ইত্যাদি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবারের শিক্ষক নিয়োগ ’১৯ বিধিমালায় প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে, বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে সেই অসম্ভবকে স¤ভব করা হয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬৫% প্রমোশন দেয়া হয় সহকারি শিক্ষক থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে। আর ৩৫% নিয়োগ দেয়া হয় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হবার পর। এই ৩৫% নিয়োগের ক্ষেত্রে আগে বয়সসীমা ছিল ২৫ বছর থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত, আর শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল মাস্টার্স ডিগ্রী; সুনিদ্দির্ষ্ট অর্থাৎ ৩ বছর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্নাতক ডিগ্রী। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষকদের বেতন স্কেল কয়েক ধাপ উত্তীর্ণ করা হয়েছে, তৃতীয় শ্রেণি হতে দ্বিতীয় শ্রেণি করা হয়েছে। বিসিএস নন ক্যাডার থেকে এই পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কোন প্রকার ব্যাখ্যা ছাড়া, কয়দিন আগে অর্থাৎ ৯ এপ্রিল, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০১৯’ জারি করে প্রধানশিক্ষক নিয়োগ যোগ্যতা শীতিল করা হয়। এখানে এই বিধিমালায় সহকারি শিক্ষক নিয়োগ ক্ষেত্রে পুরুষ মহিলা উভয়ের জন্যে দি¦তীয় শ্রেণির স্নাতক পাশ বা সম্মান শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ, বেশ কিছু ভালো ও যুগোপযোগী সংশোধনী আনা হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে এই বিধি মালায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংশোধন করে, মাস্টার্স ডিগ্রী থেকে কমিয়ে স্নাতক ডিগ্রীতে নামিয়ে আনা হয়, বয়স ৩৫ বছর থেকে কমিয়ে ৩০ বছরে আনা হয়। অথচ গত দেড় দুই দশক থেকে শিক্ষার মান নিয়ে নানান ধরণের প্রশ্ন উঠেছে, চাকুরীতে বয়সসীমা ৩৫ করার প্রস্তাব রয়েছে। তা সত্তে¡ও কেন এইরূপ সংশোধনী আনা হল আমার বোধগম্য নয়। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার আগে নিশ্চয় কোন কারণ ছিল, কিন্তু কারণসমূহ যথাযথ প্রকাশ করা হয়নি বা সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়নি।
কোন প্রকার আলোচনা বা যাচাই বাছাই ছাড়া, তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত কেবল শিক্ষা বিষয়ে নয়, যে কোন বিষয়ে মঙ্গল বয়ে আনে না। কয়দিন আগে বলা হল, ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত কোন প্রকার আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা থাকবেন। আবার ১ম সাময়িক পরীক্ষা শুরুর নির্ধারিত তারিখের তিন চার দিন আগে বলা হল, প্রাথমিকে শিক্ষার্থীর সকল পরীক্ষা হবে বিদ্যালয় ভিত্তিক, যা এতদিন উপজেলা কেন্দ্রীক হয়ে আসছে। এখন এই রকম, যখন যেমন তখন তেমন সকল প্রকার সমন্বয়হীন সিদ্ধান্ত, প্রাথমিকে নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমনিতেই শিক্ষকসহ প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলে মনে করে, তারা কোন না কোন ক্ষেত্রে তুলনামূলক বৈষম্যস্বীকার হচ্ছে। যেমন শিক্ষকেরা মনে করে অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে ডিপ্লোমা পাশ করে ২য় শ্রেণি কর্মকর্তার স্কেল দেয়া হচ্ছে, কিন্তু প্রাইমারীতে আরো উচ্চতর ডিগ্রী ও ডিপ্লোমা থাকার সত্ত্বেও কেন তা নয়? আবার কর্মকর্তারা মনে করে, আমাদের দেশে গরুছাগল হাঁসমুরগী, মাছগাছ সহ অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে, অথচ শিশু শিক্ষার বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি অংশ প্রাথমিক শিক্ষা, সেই প্রাথমিক শিক্ষা কেন ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভূক্ত নয়। এই রকম অনেক সমস্যা ও সিদ্ধান্ত মানসম্মত শিক্ষা অর্জনের পথে অন্তরায়। তাই বিষয়সমূহের দিকে আশু দৃষ্টি প্রদান জরুরী। অন্যথায় প্রাথমিক শিক্ষা ‘হ য ব র ল’ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।