সংবাদপত্রের প্রতি মানুষের আস্থা কমে এমন সংবাদ কাম্য নয়

20

মুহাম্মদ এনামুল হক মিঠু


সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। কেউ কেউ জাতির দর্পনও বলেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের সংস্কার, জাতি গঠন এবং গণতন্ত্রের উন্নয়নে সংবাদপত্রের ভুমিকা অনস্বীকার্য। সরকার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সকল সাংগঠনিক কাঠামো, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সকল অন্যায়, অসঙ্গতি, অনিয়ম ও দুর্নীতি তুলে ধরা, গঠনমূলক সমালোচনা করে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক ও সংশোধনের সুযোগ সৃষ্টির বড় হাতিয়ার সংবাদপত্র। তাই সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের আলাদা কদর রয়েছে সমাজে ও রাষ্ট্রে। তাই বলে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকরা নিজেদের ইচ্ছেমত অনৈতিকতার আশ্রয় নিয়ে দেশের সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে সঙবাদ প্রচার বা প্রকাশ করবে-তা হতে পারে না। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, দুনিয়ার কোনো সরকারই ত্রুটিমুক্ত নয়। এমনকি পৃথিবীর অনেক মিডিয়া, পত্রিকা প্রকাশ্যে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমর্থন করে, সেটিও দোষের কিছু নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে। আমার মনে আছে আমাদের একদম ছোটকালে বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষ ইত্তেফাক পড়ত। তারপর নব্বই দশকের শুরুতে হঠাৎ করে আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ এবং জনকণ্ঠ এসে ইত্তেফাকের বাজার দখল করল নতুন ধরনের সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে। তারপর বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে জনকণ্ঠের জনপ্রিয়তা চলে গেলো প্রথম আলোর কাছে। গত প্রায় আড়াই দশক ধরে প্রথম আলো বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারা প্রায়শই সরকারের সমালোচনামূলক সংবাদ পরিবেশন করে আসছে। তবু যেহেতু কিছুটা হলেও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেছে, মানুষ তাদের পত্রিকা কিনেছে, পড়েছে। কিন্তু ২০০৬ সালে সেনাশাসিত সরকার আসার পর প্রথম আলোর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিরোধী অবস্থান পরিষ্কার হতে থাকে। তারা ইউনুসের ক্ষমতা দখলের ব্যর্থ চেষ্টায় সবসময় সমর্থন দিয়েছে, সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগের যেকোনো ব্যর্থতায় বিএনপির অন্যায্য দাবি-দাওয়াকেও।
বাসন্তী ষড়যন্ত্রের পুনরাবৃত্তি কার পরিকল্পনায়? কিন্তু গত ২৬ মার্চ ২০২৩ তারা যা করেছে তা অগ্রহণযোগ্য, অন্যায়। সাভারে স্মৃতিসৌধের গেট ধরে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলের ছবিসহ উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’। প্রথম আলো উল্লেখ করে এই কথাটি বলেছে সাভারের দিনমজুর জাকির হোসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী, বিএনপি-জামায়াত পন্থী লোকজন এতে ব্যাপক খুশি হয় এবং এই সংবাদ ও ছবিটি অনলাইনে ছড়াতে থাকে। আমরা যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসি, আমাদের স্বাধীনতায় উদ্বেলিত হই, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে আনন্দের অবগাহনে ভেসে যাই, তাদের কাছে এই সংবাদটি ভালো লাগেনি। আমরা জানি সারা দুনিয়াতে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষকে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে ভালো থাকবার জন্য, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। আমেরিকা ও ন্যাটো বনাম রাশিয়া-চায়না, এই ধরনের একটি বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সব দেশ ভুগছে এটা আমরা জানি ও মানি।
মিথ্যা সংবাদ তৈরি করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে কারা? এই সংবাদের বিষয়বস্তু নিয়ে তাই আমাদের অনেকের মনে সন্দেহের উদ্রেক না হলেও খারাপ লেগেছে সংবাদ প্রকাশের ধরণ ও এর উদ্দেশ্য নিয়ে। ঠিক আমাদের স্বাধীনতা দিবসের দিনই যখন কেউ কেউ, কোন কোন প্রতিষ্ঠান আমাদের স্বাধীনতার অর্জনকে খাটো করে, প্রশ্নবিদ্ধ করে, তখন সেটি সহজভাবে মেনে নেবার অবকাশ থাকে না। তাই প্রথম আলো দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধীতা করলেও আমাদের স্বাধীনতা দিবসের দিন তাদের এই ধরনের সংবাদ ও ছবি প্রকাশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে মনে হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার আগে একই রকম উদ্যোগ নিয়ে বাসন্তী নামের এক মেয়ের গায়ে মাছ ধরার জাল ধরিয়ে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। আমরা যখন বড় হচ্ছি তখনও অনেকে এই সংবাদ বিশ্বাস করত, আমাদেরও তাই বলেছে। যেহেতু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিরাই দূর্বল সেনাশাসক ও রাজনৈতিক দলের উপর ভর করে দেশ চালিয়েছে, তারা এসব মিথ্যাচার উন্মুক্ত হতে দেয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাসন্তীকে নিয়ে মিথ্যাচার প্রকাশ হয়, কিন্তু ততদিনে আমরা আমাদের জাতির জনককে হারিয়েছি।
দেশের বিরুদ্ধে এইসব ষড়যন্ত্র রুখতে হবে : বাংলাদেশ যেই সময়টাতে বিশ্ব মানচিত্রে উন্নয়নের এক অনন্য নিদর্শন, ঠিক তখন প্রথম আলো কেন এই সংবাদটি প্রকাশ ও প্রচার করল সেটি যখন ভাবছি, সেই মুহুর্তে এই সংবাদটি যে সর্বৈব মিথ্যা সেটি উন্মোচন করেছেন আইনজীবী ও সাংবাদিক নিঝুম মজুমদার। তার সাথে ভিডিওতে একাত্তর টিভির তুখোড় সাংবাদিক ফারজানা রূপাকেও দেখেছি। তারা সবুজ নামের সাত বছরের বালকটিকে খুঁজে বের করেছেন যাকে প্রথম আলোর সাংবাদিক জাকির হোসেন নাম দিয়ে, পরিকল্পিতভাবে সাভারের স্মৃতি সৌধের গেটে ফুল হাতে দাঁড় করিয়ে একটি কাল্পনিক উদ্ধৃতি সাজিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে। এই সংবাদ শুধুমাত্র তাদের অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছিল এবং জনমত এই সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকলে তারা এর শিরোনাম পরবর্তীতে পাল্টে দেয়।
জাকির হোসেন বলে কেউ নেই, প্রথম আলোর সংবাদ সর্বৈব মিথ্যা : নিঝুম মজুমদার ও ফারজানা রূপা সবুজের বাসায় গিয়ে সবুজ ও তার মায়ের সাথে কথা বলেন। কথা বলেন পাড়া-প্রতিবেশীসহ অনেকের সাথে। তারা তার সরাসরি ভিডিও করে সেটি স্বচ্ছতার জন্য উন্মুক্তও করেছেন। সেখানে সবুজের মা তার ছেলেকে নিয়ে এ ধরনের সংবাদে বিস্ময় প্রকাশ করেন। জানান যে তাদের সামর্থ অনুযায়ী তারা ভালো খাওয়া দাওয়া করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে সবুজের পক্ষে এই ধরণের বক্তব্য দেয়া যে অসম্ভব তা তার সাথে আলাপচারিতাতেই প্রকাশিত হয়। প্রথম আলো মূলত তার কাছে কোন বক্তব্যই চায়নি। তাকে দশ টাকা ও হাতে ফুল ধরিয়ে স্মৃতিসৌধের গেটে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে চলে যায়। প্রথম আলোকে এ বিষয়ে একাত্তর টিভির পক্ষ থেকে জিজ্ঞেস করলে তাদের পক্ষে সাজ্জাদ শরীফ জানান ছবিটি প্রকাশের ১৭ মিনিটের মাথায় তারা আবার সরিয়ে ফেলেন। রাষ্ট্রবিরোধী এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকুন : প্রথম আলোর এই মিথ্যা সংবাদ আমাদের ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। তাদের সাংবাদিক এই কাজ নিজ থেকে করেছেন নাকি এর পেছনে অন্য শক্তির প্ররোচণা আছে তা খুঁজে বের করা দরকার। উল্লেখ্য এখন যদিও প্রমাণিত হয়েছে এই সংবাদটি মিথ্যা, তবুও এটি এমন ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে যে অনেকে এটি বিশ্বাস করবে এবং যারা এটি ছড়াতে সাহায্য করেছে তারা আরও নানাভাবে এটি যে আসলে সঠিকই ছিল তা প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। এই বিষয়টি কোনভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিঝুম মজুমদার ও একাত্তর টিভিকে ধন্যবাদ দিই, ধন্যবাদ দিই ফারজানা রূপাকে এই মিথ্যা সংবাদটি তুলে ধরার জন্য। সংবাদপত্র সরকারের বিরুদ্ধে লিখবে, তাতে আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু তাদের অবস্থান যখন মিথ্যাচারের মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে উৎখাত করা এবং আমাদের স্বাধীনতা দিবসের দিন আমাদের স্বাধীনতার যৌক্তিকতাকে মিথ্যা ছবি দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করা, তখন আমরা সেই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারি না। বাঙালি জাতি এসব মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক সংবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। স্যোসাল মিডিয়ার এ যুগের এদেশের মানুষ এখনও ঘুম থেকে উঠে পত্রিকায় প্রথম চোখ বুলায়। পত্রিকা না পড়ে অনেকে সকালের নাস্তাও গ্রহণ করেন না। সংবাদপত্রের প্রতি মানুষের যে আস্থা এবং সাংবাদিক সমাজের প্রতি যে সম্মান তা যেন অব্যাহত থাকে সেই উদ্যোগ সাংবাদিকদের নিতে হবে। সংবাদপত্র হোক প্রতিবাদের কন্ঠস্বর, তবে যেন দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের মুখপাত্র না হয়- সে দিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
লেখক : প্রাবন্ধিক