সংক্রমণ বাড়ছে বাড়ছে উদ্বেগ

9

দেশে করোনা সংক্রমণের গ্রাফ ফের উর্ধ্বমুখী। গত এক সপ্তাহে সংক্রমণ শতকরা গড়ে ৬০ ভাগ বেড়েছে। গেল ডিসেম্বরের শুরুতে দেশে করোনা সংক্রমণ ছিল স্বস্তিদায়ক। কিন্তু মাসের মাঝামাঝি থেকে বাড়তে শুরু করে সংক্রমণ। এছাড়া ইউরোপ-আমেরিকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়া করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনও শনাক্ত হয়েছে দেশে। এ পর্যন্ত দেশে ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ জন।
গত বছর ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার পর টালমাটাল ছিল দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। হাসপাতালে রোগীদের ভিড়, অক্সিজেন সংকটসহ নানা পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে মানুষকে। এদিকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের আতঙ্ক। আগামী তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশেও ওমিক্রনের সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞর। তাই পরিস্থিতি সামল দিতে জোর পদক্ষেপের তাগিদ দিলেন তারা। খবর বিডিনিউজ/ বিবিসি বাংলা।
আগামী মার্চ-এপ্রিলে আবারও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে পারে এ আশঙ্কায় ইতোমধ্যে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এদিকে দেশে গত কয়েক দিন ধরে রোগী শনাক্ত বাড়তে থাকার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় এই সংখ্যা ৬৭৪ জনে পৌঁছেছে। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে দৈনিক শনাক্তের হার ৩ শতাংশ ছাড়াল তিন মাস পর। এর আগের দিন শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে চার জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, একদিনে এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল সর্বশেষ গত ৬ অক্টোবর, সেদিন ৭০৩ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ার খবর এসেছিল।
নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৮৭ হাজার ১৪০ জনে। তাদের মধ্যে ২৮ হাজার ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এতদিন ধরে শনাক্তের হার তিন শতাংশের নিচেই ছিল। এক সময় নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী শনাক্তের হার দুই শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছিল। ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে আবার তা বাড়তে শুরু করে।
গত নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের শনাক্ত হওয়ার পর থেকে পুরো বিশ্বেই আবার সংক্রমণ বাড়ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্তত ১০৬টি দেশে পৌঁছে গেছে ওমিক্রন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এ ধরনটিরই প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে এখন।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১০ জনের মধ্যে ওমিক্রনের সংক্রমণের তথ্য দেওয়া হয়েছে সরকারিভাবে। তবে কেবল বিদেশ প্রত্যাগতদের ক্ষেত্রে নমুনা থেকে ভাইরাসের জিনবিন্যাস বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলে দেশের ভেতরে এই নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারের চিত্র এখনও স্পষ্ট নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত এক সপ্তাহে দেশে মোট ৩ হাজার ২১৩ জন কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা আগের সপ্তাহে ছিল ২ হাজার ১৭০ জন। অর্থাৎ, এক সপ্তাহে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ।
আর ওই সাত দিনে মারা গেছেন আরও ১৭ জন। আগের সপ্তাহে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১২ জন। অর্থাৎ, এক সপ্তাহে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে।
পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে এবার : ইউরোপ ও আমেরিকায় এই মুহূর্তে আবারও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বাড়ছে। আর এর পেছনে রয়েছে ভাইরাসটির নতুন ধরন ওমিক্রন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে দেশে এখনো পর্যন্ত অমিক্রন শনাক্ত হয়েছে ১০ জনের শরীরে।
সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেছেন আগামী তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশেও ওমিক্রনের সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
কেন তারা এমন ধারণা করছেন – তা ব্যাখ্যা করে ডা. আলমগীর বলেন, আমাদের অঞ্চলে এখনো ডেল্টা বেশি – কিন্তু ওমিক্রন সেটা সারপাস করে যাবে। গত দুই বছর আমরা যেটা খেয়াল করেছি ইউরোপ আমেরিকায় ছড়ানোর তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে সেটি আমাদের এদিকে আসে।
ওসব দেশে অনেক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা থাকলেও যে অসুখের ইনকিউবেশন পিরিয়ড থাকে – সেগুলো ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ঠেকানো যায় না। আসাটা দেরি করানো যায় মাত্র। যখন ওদিকে কমতে শুরু করবে, তখন আমাদের এদিকে হয়ত বাড়বে।
তিনি আরও বলছেন, শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস দ্বারা যেসব বৈশ্বিক মহামারি হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে তার সবগুলো সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছে।
তবে ডা. আলমগীর মনে করিয়ে দেন যে এ অঞ্চলে ওমিক্রনের সংক্রমণ বেড়ে আবারও করোনা ভাইরাস তার ধরন পরিবর্তন করবে কি না – সেই আশঙ্কার কথা ভুলে গেলে চলবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন করোনা ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা কার্যক্রম কতটা এগিয়েছে তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে এবছরের প্রবণতা কেমন হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. রোবেদ আমিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এবছরের জুন মাসের মধ্যে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশকে টিকা দেয়া শেষ করতে চায় বাংলাদেশ।
আমরা আশা করছি এই মাসে যে কর্মসূচি চলে তাতে এক মাসেই চার কোটির মতো টিকা দেয়া হবে। দুই দিন আগেও আমারা প্রায় দুই কোটি টিকা হাতে পেয়েছি। তাই টিকার স্বল্পতাও নেই।
তিনি জানান, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ ইতিমধ্যেই প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছে। দুটি ডোজই পেয়েছেন ৪০ শতাংশের মতো।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক করোনা ভাইরাস ভ্যাক্সিন আপডেট বলছে দুই ডোজ টিকা দেবার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরাও পাবেন বুস্টার ডোজ : করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি এবং যারা শারীরিকভাবে অসুস্থ, তাদেরও কোভিড টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সদস্যদের সঙ্গে এক আলোচনায় এ কথা জানান।
তিনি বলেন, যাদের কোমরবিডিটি আছে, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে আছেন, তারা বুস্টার নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে বয়স কোনো বাধা হবে না।
গত ২৮ ডিসেম্বর দেশে করোনা ভাইরাসের বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী এবং করোনা ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় সম্মুখসারিতে থাকা ব্যক্তিরা বুস্টার ডোজ পাচ্ছেন। তাদের মধ্যে যাদের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর ছয় মাস পার হয়েছে, তাদেরই তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে।
খুরশীদ আলম বলেন, যাদের করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি বেশি, তাদের বুস্টার ডোজ নেওয়া উচিত।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কোভিড টিকার সুরক্ষা দুর্বল হয়ে আসায় বাড়তি আরেক ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে, যাকে বলা হচ্ছে বুস্টার ডোজ।
দেশে এখন প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ফাইজার, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোফার্ম এবং সিনোভ্যাকের টিকা দেওয়া হচ্ছে। তবে বুস্টার ডোজ হিসেবে ফাইজার, মডার্না অথবা অ্যাস্ট্রাজেনেকা দেওয়ার সুপারিশ করেছে ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল কমিটি-নাইট্যাগ।
চট্টগ্রামে নতুন শনাক্ত ২৩ জন : চট্টগ্রামে গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৪৬৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২৩ জনের শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে চট্টগ্রামে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৬৮১ জন। তবে এ সময় চট্টগ্রামে করোনায় কারো মৃত্যু হয়নি। এই পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনায় মারা গেছে ১ হাজার ৩৩২ জন। গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।