ষাট দশকের ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিমান বড়ুয়ার মৃত্যুতে শোকাঞ্জলি

99


ধ্বংস, অবক্ষয়, পতন ও সমূহ বিনষ্টির মধ্যেও অঙ্গুলিমেয় যে ক’জন মানুষ মানবিক চেতনাকে জ্বালিয়ে রেখেছেন আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে, তাদেরই একজন মুক্তিমান বড়ুয়া দীর্ঘ রোগভোগের পর অবশেষে নিজেই নিভে গেছেন আমাদেরকে আঁধারে ডুবিয়ে দিয়ে। মুক্তিমান বড়ুয়ার মৃত্যুর পর সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে তাঁকে পটিয়া থানা ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কমিউনিস্ট পার্টির পটিয়া থানার সাবেক সভাপতি, মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি পরিচয় প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু আমার মতে তাঁর বড়ো পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন মানুষ ছিলেন। জন্মাবধি একজন মানুষকে নিজের সঙ্গে, পরিপার্শ্বের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করে যে জিনিষটা অর্জন করতে হয়, সেটা হচ্ছে মনুষ্যত্ব, যার অর্থ হচ্ছে হস্তপদচক্ষুকর্ণের মনুষ্য নয়; চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতায়, জীবনাচরণে, অন্তরে মানুষ হওয়া। মুক্তিমান বড়ুয়া তেমন মানুষ হয়েছিলেন।
পটিয়া থানার পাহাড় খাঁর দিঘির পাড় প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে যখন অনেক দূরে হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে চরকানাই হাইস্কুলে দাখিল হলাম, তখন আমার জগতটা অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। আমার পথটা ছিলো হুলাইন পেরিয়ে প্রথমে পাঁচরিয়া দিঘি (তখনো ছালেহ-নূর কলেজ হয় নি), তারপর শাহী রাস্তা বা সুজা রাস্তা (ভাগ্য বিড়ম্বিত মোগল রাজপুত্র সুজা নাকি এই পথেই বার্মার পথে পালিয়ে গিয়েছিলেন; অন্যমতে তিনি কর্ণফুলী থেকে পতুর্গিজ জাহাজে চড়ে বার্মা গিয়েছিলেন) দিয়ে সফর আলী মুন্সির হাটের মুখে চরকানাই হাইস্কুল। সেখানে তখন আধ্যত্মিক সাধক নলান্দার হজরত গরীব আলী শাহ (র.) স্বমহিমায় বিরাজমান। সেখানে প্রায় প্রতিদিন মোহাম্মদুর রহমান ডাক্তারের ভাইয়ের ডিসপেন্সারি কিংবা পূর্ব পার্শ্বস্থিত চায়ের দোকানে কখনো লুঙ্গি পরিহিত কখনো বা চীবরহীন গরীব আলী শাহ একটি চেয়ারে উপবেশন করে আপন মনে বিড়বিড় করছেন। কখনো কাউকে কিল থাপ্পর দিচ্ছেন। ডিসপেন্সারির পশ্চিম পাশে ছিলো আমাদের বইয়ের দোকান। স্কুলে গমনাগমনের পথে চোখে পড়তো পাঁচরিয়া দিঘির পাড় ও মুন্সির হাটে বড়োদের জমপেশ আড্ডা।
ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন আসতে আসতে রাজনীতিটা গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিলো। পঞ্চাশের দশকে দু’টি ঘটনায় গ্রামে সাড়া জেগেছিলো-একবার বায়ান্নে, আরেকবার চুয়ান্নতে। চুয়ান্নর ঘটনা আমরা দেখিনি। বাষট্টিতে মার্শাল ল’ উঠতে না উঠতেই প্রবল ছাত্র আন্দোলনে ঝাঁকুনি খেলো শিক্ষাঙ্গণ। গ্রামে তার টেউ খুব একটা উঠে নি। চৌষট্টিতে আরেকটা ছাত্র আন্দোলন হয়েছিলো। সেই আন্দোলন, পাক-ভারত যুদ্ধ, ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনের কথা আগেই বলেছি, ছেষট্টিতে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং ৭ জুনের হরতাল ইত্যাদি ঘটনা শহর ও গ্রামের রাজপথে আন্দোলনের খই ফুটতে থাকে। এমনি সময়ে ছাত্র রাজনীতির পালে হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের হাওয়া জোরদার হয়ে ওঠে। পটিয়ায়ও ছাত্র রাজনীতির ফুল ফুটলো। যারা এই ফুল ফোটালেন, তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ছিলেন মুক্তিমান বড়ুয়া। তারও আগের কথা। ৬২ সালে হাবিলাসদ্বীপ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করলেন এক্সট্রা অর্ডিনারি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র পরবর্তীকালে চট্টগ্রামের কিংবদন্তী ছাত্রনেতা এসএম ইউসুফ, ৬৩ সালে মুক্তিমান বড়ুয়া, হুলাইনের আনোয়ার হোসেন খান এবং সম্ভবত চরকানাইর আনোয়ার, মনসার-পরবর্তীকালে টিকে গ্রুপের চেয়ারম্যান শিল্পপতি আবু তৈয়ব, অনতিপরবর্তী দক্ষিণ হুলাইনের নুরুল আমিন ও আমজুরহাটের নুরু ভাই। এসএম ইউসুফ শহরে গিয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হলেন, মুক্তিমান বড়ুয়া সদ্য স্থাপিত পটিয়া কলেজে, অন্যদিকে গৈড়লার অনিল লালা, পটিয়ার আনোয়ার, ফতেনগরের অ্যাডভোকেট বদিউল আলমের ভাই চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম খালেদও (মোচ সিরাজ) পটিয়া কলেজে ভর্তি হলেন। হয়তো বছর খানেক পরে কিংবা সমসময়ে পটিয়ার শামসুদ্দিন আহমদ, আবু ছৈয়দ কি কম, আহমদ নূরকেও দেখা যায় পটিয়া কলেজে ক্লাস করতে। এরা পটিয়া থানায় ষাট দশকে ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তন করেন। অন্ত-পঞ্চাশ এবং আদি-ষাট-এর মধ্যবর্তী সময়ের বড়ো ছাত্রনেতা ছিলেন হুলাইনের নাসির সাহেব। তিনি কানুনগোপাড়া কলেজের ভিপি কিংবা জিএস ছিলেন। আমাদের এলাকায় শক্তিশালী সংগঠন ছিলো ছাত্র ইউনিয়নের এবং সেটার জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্ব মুক্তিমান বড়ুয়ার।
ছাত্র ইউনিয়নের অ্যাক্টিভিস্ট অনেকেই ছিলেন কিন্তু মুক্তিমান বড়ুয়ার মতো সার্বক্ষণিক রাজনীতি আর কেউ করতেন বলে মনে হয় না। আমরাও প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন করি। মনসার নুরুল ইসলাম, নাসিরুদ্দিন চৌধুরী (আমি), বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী প্রকৌশলী ইউসুফ চৌধুরী, চরকানাই স্কুলের আরো ক’জন ছাত্র যে স্কুলে ঢুকতে না ঢুকতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন তা’ ওই পূর্বসূরি ছাত্রনেতা মুক্তিমান বড়ুয়ার প্রভাবেই। তাঁকে আমাদের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম গুরু বললেও অত্যুক্তি হয় না। আমাদের সময়ে এবং অনতিউত্তরকালে হুলাইন, মনসা, চরকানাই, হাবিলাসদ্বীপ, লড়িহরা, মুকুটনাইট, লাখেরা-এই এলাকাসমূহে ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হয়েছেন এবং ছোট ছোট সভা-মিছিলে অংশগ্রহণ করে রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছেন এমন বহু ছাত্র ছিলেন। কিন্তু এতদিন পর তাদের নাম আমি মনে করতে পারছি না। তবুও যে ক’জনের নাম পড়ছে, তাদের নাম বলছি চরকানাই স্কুলে আমাদের শিক্ষক লাখেরার অশ্বিনী বাবুর পুত্র ও আমাদের সিনিয়র সমীর বড়ুয়া (অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা), রাজকৃষ্ণবাবুর কন্যা নিবেদিতা বড়ুয়া (অবসরপ্রাপ্ত কাস্টম কর্মকর্তা); চরকানাই’র ইসহাক, হুলাইনের নুরুল আলম, আবুল কাশেম, রফিক, দক্ষিণ হুলাইনের নূরুল আলম, গৈড়লার ফজল ও মুসলিম, পাইরোলের নজরুল ইসলাম, মনসার আলী নূর, আহমদ নূর, এয়াকুবদন্ডীর ইসহাক ও লড়িহরার আবুল হাশেম। এসব এলাকা ছাত্র ইউনিয়নের উর্বর প্রজনন ক্ষেত্র হওয়ার একটা ঐতিহাসিক কারণ নিহিত আছে। সেটা হলো-বিপ্লবী ঐতিহ্যের ধারক হাবিলাসদ্বীপের কৃষক নেতা ধীরেন দাশ, মনসার ট্রেড ইউনিয়ন নেতা চৌধুরী হারুনুর রশিদ, ন্যাপ নেতা এ এন এম নুরুন্নবী, কৃষক নেতা আবদুল মালেক ও পেটান শীল (ইয়া মোচওয়ালা পেটানের মনসার টেকে একটা হেয়ার কাটিং সেলুন ছিলো। অসহযোগ আন্দোলনের সময় গঠিত সংগ্রাম কমিটিরও কর্মকর্তা ছিলেন পেটান), গৈড়লার আহমদ হোসেন পোস্ট মাস্টার, আবদুস সালাম মাস্টার, উজিরপুরের শ্রমিক নেতা এম এ মালেক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ আমাদের এলাকায় প্রগতিশীল রাজনীতির একটা বাতাবরণ আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছিলেন। ধীরেন দাশ, চৌধুরী হারুন ও এমএ মালেকের বাহ্যিক পরিচয় যাই থাকুক না কেন, তারা আসলে কমিউনিস্ট ছিলেন এবং কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন তখনো ভাগ হয়নি।
এসএম ইউসুফের জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হওয়া এবং হুলাইনে ছালেহ-নূর কলেজের প্রতিষ্ঠা-এই দুই কারণে আমাদের এলাকায় ছাত্রলীগের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এসএম ইউসুফ ছাত্রলীগের কর্মী সৃষ্টির জন্য নানা উপায়ে চেষ্টা চালান। ততদিনে ৬ দফার আন্দোলন, আগরতলা মামলা বাতিল এবং বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। অচিরেই গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, আগরতলা মামলা বাতিল হয়, বন্দীরা একে একে মুক্তিলাভ করে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন এবং স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। জাতীয় রাজনীতিতে যখন বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠে, তারই বিপুল প্রভাবে পশ্চিম পটিয়ায়ও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ভরা জোয়ার আসে। পটিয়া ছাত্রলীগের দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, মুসলিম লীগের মাস্তান-গুন্ডাবাহিনী, পুলিশের রাইফেলের গুতো আর লাঠির বাড়ি খেয়ে, হুলিয়া মাথায় নিয়ে, কখনো বা জেল খেটে যারা পটিয়া থানায় ছাত্র রাজনীতির সূচনা করে তাকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার অভিমুখে পরিচালিত করেছেন, তাদের মধ্যে ইস্পাতের ন্যায় ধারালো একটি উজ্জ্বল মনিরত্নস্বরূপ ছিলেন মুক্তিমান বড়ুয়া।
তাঁর পরিবারটি ছিলো প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় পুষ্ট একটি আলোকিত পরিবার। তাঁর বাড়িটি ছিলো প্রাগ্র্রসর চেতনার মানুষের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল, নিরাপদ ঠিকানা। বস্তুত ৫নং হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়ন তথা পশ্চিম পটিয়ায় স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের রাজনীতি মুক্তিমান বড়ুয়ার বাড়িকে (সাধারণ্যে অশ্বিনী মাস্টারের বাড়ি হিসেবে পরিচিত) ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। যে পাঁচরিয়ার দিঘি ছিলো পশ্চিম পটিয়ার রাজনীতির তীর্থস্থান, সেই দিঘিটিরও মালিক ছিলেন মুক্তিমান বড়ুয়ার পরিবার। ফলে পশ্চিম পটিয়ার রাজনীতির হৃৎপিন্ডে অবস্থান করে মুক্তিমান বড়ুয়া হয়ে উঠেছিলেন তার প্রধান রূপকার।
মুক্তিমান বড়ুয়ার সঙ্গে আমার একটি বিশেষ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো ৬৯ সালে, যখন নব প্রতিষ্ঠিত হুলাইন ছালেহ নূর কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে তাঁর পিসতুতো ভাই বিপ্রদাশ বড়ুয়া তাঁদের বাড়িতে বাস করতে আসলেন। আমি এই কলেজের প্রতিষ্ঠাবর্ষের ছাত্র। আমার অধ্যাপকরাও প্রায় সবাই সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে আসা তরতাজা তরুণ। শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ জে এল দে মহোদয় (তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় স্কুল (কলেজ) পরিদর্শক। নব্য কলেজটিকে দাঁড় করাবার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে বয়োবৃদ্ধ জ্ঞানী মানুষটাকে অবসর থেকে ডেকে আনা হয়েছিলো।) এবং উপাধ্যক্ষ বিভ‚তিভ‚ষণ ভট্টাচার্য-এই দুজনই ছিলেন প্রবীণ অধ্যাপক। বিভ‚তি বাবু সম্ভবত শুরুতে উপাধ্যক্ষ ছিলেন না, ইংরেজি বিভাগের প্রধান এবং শিক্ষকদের মধ্যে সিনিয়র ও স্টাফ কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ আমাকে অধ্যাপক বিপ্রদাশ বড়ুয়ার কাছে নিয়ে গেল এবং তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য গেলাম মুক্তিমান বড়ুয়ার বাড়িতে। সে বাড়িতে আমার একজন সহাধ্যায়ী ছিলো, ওর নাম ঝর্ণা বড়ুয়া। বিপ্রদাশ বড়ুয়া ক্লাসের বাঁধা সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে যা বলতে পারতেন না, তাঁর মামার বাড়িতে একলা আমার কাছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেসব বলে যেতেন, আমি গোগ্রাসে গিলতাম। জীবন, জগৎ, ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, সমাজ, মানুষ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি আমার পুরাতন সব বিশ্বাস ভেঙে চুরে আমাকে নতুন চেতনায়, নবতর বিশ্বাসের ভ‚মিতে দাঁড় করিয়ে নবজীবন দান করলেন। আমাদের এই আলোচনা চললো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। ৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আলোচনার ধারা অবিচ্ছিন্ন, অব্যাহত ছিলো। প্রায় প্রতিদিনই আমি যেতাম, থাকতাম অনেক রাত অব্দি। বাড়ির সবার সঙ্গে দেখা হতো। মুক্তিমান বড়ুয়ার সঙ্গে তো হতোই, তাঁর বড় দুই ভাই, ছোট দুই ভাই মিলটন (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) ও নিউটন, যারা তাঁকে ‘ঠাকর্দা’ বলতো। তাঁদের দেখাদেখি আমিও মুক্তিমান বড়ুয়াকে ‘ঠাকুর্দা’ বলতে শুরু করেছিলাম। মনে পড়ে মুক্তিমান বড়ুয়ার সঙ্গে উনাইনপুরা ও সাতবাড়িয়ায় দু’জন ভন্তের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছিলাম। শহরে তাঁর এক পিসি ছিলো আফিমের গলিতে, আরেক পিসি বৌদ্ধ মন্দির সড়কে। তিনি আমাকে সেখানে নিয়ে যেতেন। তারপর একাত্তরে আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলাম বিপ্রদাশ বড়ুয়ার সঙ্গে। মুক্তিমান বড়ুয়াও ভারতে গিয়ে ন্যাপ কমিউনিস্ট, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেন।
স্বাধীনতার পর আমি জাসদে যোদ দিয়ে সমাজতন্ত্রের ধারায় রাজনীতি আরম্ভ করলে মুক্তিমান বড়ুয়া আমার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তারপর পঁচাত্তরে আমি গ্রেফতার হয়ে গেলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। তিন বছর পর যখন জেল থেকে বেরিয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আমি সাংবাদিকতায় যোগ দিই, তাঁর সঙ্গে আবার আমার যোগাযোগ হয়। শেষ জীবনে তিনি আমাকে দিয়ে একটা কাজ করিয়ে নেন। তাঁর আগ্রহে মাস্টার বিপিন বড়ুয়া, যিনি আমাদের ইউনিয়নের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তাঁর ছোট্ট একটা জীবনীগ্রন্থ আমি সম্পাদনা করি। প্রকাশনার ব্যয়ভার বহন করে তাঁর ছোট ভাই মিলটন বড়ুয়া। আমার ঠাকুর্দার পারলৌকিক শান্তি কামনা করি।
মুক্তিমান বড়ুয়া পটিয়া কলেজ থেকে আই.কম ও কানুনগোপাড়া কলেজ থেকে বি.কম পাস করে রেলওয়েতে চাকরি নেন এবং হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। পটিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের বিতর্ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন পটিয়া থানা শাখার সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীকালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দক্ষিণ জেলার ছাত্র বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি গণতন্ত্রী পার্টির কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টিপ্রচার সংঘ, চট্টগ্রাম অঞ্চলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
মুক্তিমান বড়ুয়ার পিতা অশ্বিনী রঞ্জন অশ্বিনী বড়ুয়া শিক্ষানুরাগী ও সমাজদরদী ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তিনি পাঁচরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শুধু যে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তা নয়, তিনি বিনা বেতনে ঐ স্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। এরপর থেকে তাঁকে সকলে অশ্বিনী মাস্টার হিসেবে ডাকতেন। পাঁচরিয়া গন্ধকুটি বিহার, পাঁচরিয়া অজন্তা পালি কলেজ, পাঁচরিয়া পল্লী মঙ্গল সমিতি, হিন্দুদের গদাধর আশ্রম প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ডে জড়িত থেকে তিনি সেগুলোর সুষ্ঠু পরিচালনা ও উন্নয়নের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন।
১৯৪৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষে হাজার হাজার বাঙালি যখন অর্ধাহার-অনাহারে মারা যাচ্ছে তখন তাঁর দ্বিতীয় সন্তান দ্বীপ্তিমান বড়ুয়া জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু পুত্রসন্তানের পিতা হওয়ার আনন্দ তাঁকে আপ্লুত করতে পারেনি। বরং নিরন্ন মানুষের হাহাকার শুনে কেঁদে উঠেছিলো মানবতাবাদী অশ্বিনী বাবুর প্রাণ। অশ্বিনী বাবু তাঁর গোলার ধান অল্পটুকু নিজের পরিবারের জন্য রেখে, বাকি ধান দিয়ে ৩ দিন পর্যন্ত এলাকার অনাহার পড়িত, বুভূক্ষু লোকদের খাবার দিয়েছেন। তিনি কমিউনিজমে বিশ্বাস করতেন বলে কমিউনিস্টদের লঙ্গরখানার জন্য চাঁদা দিয়েছেন এবং চাঁদা সংগ্রহ করেছেন।
আপসহীন ব্যক্তি কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না। ন্যায়বিচারক হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন এই নীতি মেনে চলতেন। অন্যায়কারীদের শাসন করতেন।
প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেত্রী বিপ্লবী কল্পনা দত্তের নির্বাচনী কাজে তিনি এলাকায় বলিষ্ঠভাবে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় থেকে এলাকায় তিনি কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচিতি পান। ফলে ইউনিয়ন বোর্ড ও ইউনিয়ন কাউন্সিলে সরকার মনোনিত সদস্য হিসেবে অনেকবার তাঁর নাম বাদ পড়ে। তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার, ১৯৭৩ ও পরবর্তী সময়ে চৌধুরী হারুন-অর-রশিদ এর নির্বাচনে তিনি ও তাঁর পরিবার অংশগ্রহণসহ অনেক সাহায্য ও সহযোগিতা করে। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত যত আন্দোলন হয়েছে প্রতিটি আন্দোলনে তার পরিবার ও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তার ঘরে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের অবাধ যাতায়াত ছিল।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ সাংবাদিক