শ্রী হৃদয় রঞ্জন সেন

30

 

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্বাধীনতা সংগ্রামী জ্ঞানতাপস হৃদয় রঞ্জন সেন ১৯১০ সালে পটিয়া থানার ধলঘাটে প্রখ্যাতে সেন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব নবীন চন্দ্র সেন, ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ সরকারের বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলায় জেলা স্কুল ইন্সপেক্টর ও ধলঘাট হাইস্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। শ্রী সেন স্কুল জীবনে, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অসাধারণ মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। ১৯২৮ সালে তিনি ধলঘাট হাই স্কুল থেকে উচ্চতর প্রথম বিভাগে জেলা বৃত্তি প্রথম শ্রেণী নিয়ে মেট্রিক পাস করেন এবং পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৩০ সালে প্রথম বিভাগে বৃত্তিসহ আইএসসি পাস করেন এবং ১৯৩২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বিএসসি পাস করেন। এর পরবর্তী সময়ে ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি নৃবিজ্ঞানে দ্বিতীয় স্থান দখল করে (দ্বিতীয় শ্রেণি প্রথম স্থান)। উল্লেখ্য যে, তিনি ব্রিটিশ আমলে পূর্ববঙ্গের প্রথম নৃবিজ্ঞানের এমএসসি পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় তিনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অনুশীলন দলের একজন সংগঠক ও নেতা ছিলেন। কলকাতা থাকা অবস্থায় কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলখানায় দীর্ঘদিন কারাদন্ড ভোগ করেন। প্রখ্যাত সংগ্রামীদের মধ্যে তার সাথে যারা ছিলেন তারা হলেন বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী, দীনেশ দাশগুপ্ত, যতীন্দ্র মোহন রক্ষিত, পুলিন দে, মতি চক্রবর্ত্তী ও আরও অনেকে। তিনি শিক্ষক জীবনে পাকিস্তান আমলে পাহাড়তলী রেলওয়ে হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর সব বিষয়ে অসাধারণ পান্ডিত্য ছিল। ১৯৬২/৬৩ এর সময়ে তাঁর এটমস ফর পিচ প্রবন্ধ খুব সমৃদ্ধ ও সমাদৃত হয়। রাজনীতি সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর অগাধ পাÐিত্য ও সুবক্তা ছিলেন। তাঁর পুত্রদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্র নাথ সেন বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন প্রকৌশলী ছিলেন। দ্বিতীয় ছেলে কবিন্দ্র নাথ সেন পিডিবি চট্টগ্রাম বিভাগীয় চীফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং এ প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তাঁর পেশা থাকা অবস্থায় পুরো বাংলাদেশে সুনাম অর্জন ও শ্রেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাঁর তৃতীয় ছেলে সৌরেন্দ্র নাথ সেন ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে চকবাজারের চন্দনপুরায় ডা. সমির উদ্দিনের বাসার সামনে যে তিন জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনের গাড়ীর উপর যারা হামলা করেছিল তাদের একজন। যারা ঐ অপারেশনে ছিলেন গ্রæপ কমান্ডার মাহবুব আলম এবং ফজলুল হক ভূইয়া।
শ্রী সেনের ছোট ছেলে স্বপন সেন চট্টগ্রামের রাজনীতি ও সংস্কৃতি আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত আছেন। শিক্ষাবিদ হৃদয় রঞ্জন সেন এর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যারা ছিলেন, তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমান কায়সার তাঁর বোন বিদেশে অবস্থানকারী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রথম ছাত্রী প্রখ্যাত ডাক্তার রিনা খান। এক সময় ডাকসুর সহ-সভাপতি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজনীতিবিদ ডক্টর ফেরদৌস আহমদ কোরেশী। প্রাক্তন মন্ত্রী বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সভাপতি নুরুল আলম, মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান ডাক্তার মাহফুজুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা ডক্টর গাজী সালাউদ্দিন, চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির প্রাক্তন সভাপতি এডভোকেট সালাউদ্দিন হায়দার। আগরতলা ষড়যন্ত্রের অন্যতম আসামী জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জননেতা বিধান কৃষ্ণ সেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্রালয়ের সমাজতত্ত¡ বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ডক্টর ওবাইদুল করিম, চট্টগ্রাম জাসদের অন্যদের প্রতিষ্ঠাতা সাবের আহম্মেদ আজগরী বিদেশে অবস্থারত প্রফেসর ডক্টর আনিসুর রহমান, প্রেসক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি মোহাম্মদ ইদ্রিচ। প্রখ্যাত ডা. বিশেষজ্ঞ নুরুল ইসলাম, প্রখ্যাত ডা. আঞ্জুমান আরাসহ আরও অনেকেই। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে ছিল মৌলানা ভাষানী, বিশ্বস্ত সহকর্মী প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা ন্যাপের কেন্দ্রীয় প্রতিস্ঠাতা নেতা বজরুর সাত্তার, প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা এলএ চৌধুরী, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা সীতানাথ দাশ, শিক্ষাবিদ চন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী, শিক্ষাবিদ শরদিন্দু দত্ত, আওয়ামী লীগ নেতা মতিলাল চৌধুরী।
পাকিস্তান আমলের কর কমিশনার জয়নাল আবেদীন এবং প্রখ্যাত ডা. ক্যাপ্টেন কামরুজ্জামান। শ্রী সেন ব্যক্তিগত জীবনে অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার মূর্তপ্রতীক ছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র আমরা যদি সম্পূর্ণ কায়েম করতে পারি তাহলে তার প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন হবে। ১৯৭১ সালে ২৯ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার জীবনে বহু ছাত্রকে বিনা বেতনে অধ্যাপন করেছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ আমরা যদি সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে তাঁর আত্মা শান্তি পাবে। -সংকলন