শ্রীলংকায় সর্বাধিক বিধ্বংসী আত্মঘাতী হামলা : মানবতার জন্য অশনি সংকেত

74

ধর্ম কোনো অ্যাজেন্ডা নয়, অ্যাজেন্ডা হলো আধিপত্য ও শৃঙ্খল প্রতিষ্ঠা। কে না জানে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম, কোনো জঙ্গি মুসলমান হতে পারে না। মানুষ হত্যা করে আর যা হোক, ইসলামের কোনো উপকার করা যায় না। আল্লাহর সান্নিধ্যও লাভ করা যায় না। নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলা যেমন কোনো খ্রিষ্টান সম্প্রদায় করেনি, করেছিল এক সন্ত্রাসী, তেমনি শ্রীলংকার কলম্বোর হামলাও মুসলামনদের কাজ নয়, সন্ত্রাসীদের কাজ। সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই।
গত ২১ এপ্রিল শ্রীলংকার গির্জা ও হোটেলসহ কয়েকটি স্থানে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৩৫৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত পাঁচ শতাধিক, যদিও সর্বশেষ তথ্যে শ্রীলংকা কর্তৃপক্ষ নিহতের সংখ্যা ২৫৩ এবং আহতও আরও কিছুটা কম বলে দাবি করেছেন এবং আগের তথ্য নাকি ভ’ল ছিল। যা হউক আমরা সেই সংখ্যা নিয়ে বিতর্কে যেতে চাই না।
তামিল টাইগারদের সাথে দীর্ঘদিন গৃহযুদ্ধের পর এই দেশটিতে এটিই সবচেয়ে বড় ঘটনা। গত এক দশকে এবারের ঘটনায় বিদেশি নাগরিক নিহত হয়েছে ৪০ জন, আহত ৩০ জন। বিশেষ একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে লক্ষ করে যে দানবীয় ঘটনা ঘটেছে তা নজিরবিহীন নারকীয়তা। এটি বহু জাতির সমাজব্যবস্থায় বড় ধরনের আঘাত নিঃসন্দেহে শ্রীলংকার ইতিহাসে মুসলিম-খ্রিষ্টান দাঙ্গার কোনো উল্লেখযোগ্য নজির নেই। কিন্তু গরিষ্ঠ বৌদ্ধরা বারবার খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের ওপর সহিংস আক্রমণ চালিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারে কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষুর রোহিঙ্গাদের এবং শ্রীলংকায় মুসলমানদের ওপর আক্রমণ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অথচ শ্রীলংকার মুসলমানেরা কখনো কোনো সহিংসতার জন্ম দেয়ার উদাহরণ নেই।
বোমা হামলাকারীরা যদি রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠান, প্রমোদভবন, বৌদ্ধ মন্দির প্রভৃতি টার্গেট করে আক্রমণ চালাত তাহলে এক ধরনের হিসাব-নিকাশ করা যেত। কেন হামলাকারীরা খ্রিষ্টানাতংকে আক্রান্ত হলো ? এর কারণ কী ? তাদের অস্থিরতার কারণ শ্রীলংকার রাজনীতি না বিশ্বরাজনীতি ? মুসলমানেরা লংকার উন্নয়ন ও সামাজিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে রেখেছে অগ্রণী ভ‚মিকা। হাতেগোনা কিছু উগ্রপন্থী রয়েছে যাদের অস্তিত্ব সব সম্প্রদায়েই রয়েছে। ২১ এপ্রিলের ঘটনায় ন্যাশনাল তৌহিদ জামাতের কথা মিডিয়া টেনে এনেছে। কিন্তু যারা এখনো বর্ণবাদী হামলার শিকার, তারা হঠাৎ কেন এই হামলা চালাবে ? কোনো কারণ ছাড়াই মুসলমানদের আক্রমণ করা হয়। তাদের দোকান ও ঘরবাড়ি লুট করা হয় এমনকি পবিত্র মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। বাইরের কোনো শক্তি হঠাৎ রাজনৈতিক মঞ্চে আবিভর্‚ত হয়ে যেন লংকার রাজনীতিকে পরিচালিত ও কলুষিত করছে। বিভক্তি, ঘৃনা এবং নৃতাত্ত্বিক বন্ধনকে ছিন্নভিন্ন করাই যেন মূল উদ্দেশ্য, বৌদ্ধরা মনে করে, শ্রীলংকা শুধু বৌদ্ধদের দেশ এবং এখানে খ্রিষ্টান ও মুসলমানেরা বহিরাগত। সুতরাং এ দেশে তারা থাকতে পারবে না, আবার আরএসএস বলে থাকে ভারতে থাকতে হলে হিন্দু হয়েই থাকতে হবে। মুসলমানদের সাগরে নিক্ষেপ করা হবে ইত্যাদি।
প্রশ্ন আসে, বোমা হামলাকারীরা ২১ এপ্রিল সিনামনগ্রান্ড থেকে কিংসবেরিতে আক্রমণ চালালো কিন্তু ভারতের মালিকানাধীন তাজ সমুদ্র হোটেলে হামলা হলো না। ভারতীয় মিডিয়া শ্রীলংকার মিডিয়ার চেয়ে চৌকসভাবে কভারেজ দিয়েছে এ ঘটনার। ভারতীয় ‘র’ লংকার কর্তৃপক্ষকে দু’সপ্তাহ আগেই নাকি সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কে অবহিত করেছে। হামলাকারীরা প্রসিদ্ধ ক্যাথলিক চার্চ আক্রমণ করেছে কিন্তু সন্ত্রাসীদের টার্গেট থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় হাইকমিশন নিরাপদ ছিল। এ অবস্থায় মনে হয় খুবই বিচক্ষনতার সাথে হিসাব-নিকাশ করে সব আক্রমণ সাজানো হয়েছে। এটা কোনো কাচা হাতের কাজ হতে পারে না। মাত্র কুড়ি মিনিটেই অপারেশন শেষ। মনে হয়, আক্রমণকারীরা বেশ প্রশিক্ষিত এবং এদের পেছনে চৌকস মাস্টারমাইন্ড রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অঙ্গুলি তোলা হচ্ছে, অর্থাৎ ন্যাশনাল তৌহিদ জামায়াত, তাদের সাথে অনেক বিদেশির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ মনে করছে।
আরো প্রশ্ন হলো, সতর্ক করার পরও, কেন সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ? তাহলে কোনো ঘটনা ঘটলেও এত প্রাণহানি হতো না।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তদন্তটিম করা হবে, প্রেসিডেন্ট বিশেষ তদন্ত দল গঠন করেছেন, কেন সতর্ককতা পাওয়ার পরও অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সেটি বের করার জন্য, কলম্বোর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি শুধু অস্থির নয়, উদ্বেগজনকও বটে। মনে হয় বিভিন্ন শক্তিশালী খেলোয়াড় এখন উত্তপ্ত মঞ্চে অবস্থানরত, এর মধ্যে এ ধরনের রক্তবন্যার ঘটনা শুভ উদ্বেগের নয়, সরকার ও সেনাবাহিনীতে এর প্রতিক্রিয়া মারাত্মক কোনো মোড় নিতে পারে। এক মন্ত্রী টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘কোনো কোনো ইল্টেলিজেন্স কর্মকর্তা ঘটনা সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু কেন যথাসময়ে অ্যাকশন নেয়া হয়নি। এই বার্তা পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করে তুলেছে। এত লোকজন মারা যাওয়ার পর ঘটনা তদন্ত করে কী হবে ? শ্রীলংকা যখন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, তখন ধরে নেয়া হয়েছিল মুসলিম বিরোধী মারাত্মক অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনা যেকোনো সময় ঘটতে পারে, মুসলমানদের এমন এক স্থানে দাঁড় করানো যাতে তারা সমাজে দিশেহারা হয়ে যায়। টাকার বিনিময়ে অনেক ‘খেলোয়াড়’ পাওয়া যায় সর্বত্র। এসব সন্ত্রাসীর কোনো দেশ, ধর্ম নেই ; কোনো মানবতা বা দেশপ্রেম নেই। তারা অর্থের বিনিময়ে যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে। হোতারা অনেক দূরে বসে এসব অপারেটরকে দিয়ে ঘটনা ঘটাতে পারে এবং অপর কোনো পক্ষকে দায়ী করতে পারে। ইসরাইল শুরু থেকেই ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সবাই জানেন যে ইসরাইল মোসাদের সহায়তায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।
ওয়াকিবহাল মহল জানেন, গত তিন দশকে ইউরোপে যেসব হামলা হয়েছে তার পেছনে রয়েছে ইসরাইল, পশ্চিমা মিডিয়া এবং আমেরিকা-ইসরাইল ওয়ার মেশিন ওসব আক্রমণের জন্য মুসলমানদের দায়ী করেছে। এর মধ্যে একটি হলো হিজাব বা বোরকা। তাছাড়া পার্ক বা রাস্তায় নামাজ পড়া। আজান দেয়া, হালাল খাবার, টুপি-দাড়ি এসব নিয়ে কত মানুষ পশ্চিমে প্রতিদিন হেনস্থা হচ্ছেন, তার ইয়ত্তা নেই। মিডিয়ায় সব দোষ মুসলমানদের, বলা হয় ‘সন্ত্রাসী’।
দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান, আফগানিস্তান, এমন কি ভারতেও ইসলামপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা এত বড় আকারের সন্ত্রাসী হামলা ঘটলে অনেকেই খুব একটা অবাক হতো না ; কিন্তু শ্রীলংকার ঘটনায় অধিকাংশ লোকই অবাক হয়েছে। কারণ, গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেশটিতে মোটের ওপর শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল। তাছাড়া শ্রীলংকার মুসলমানরা সংখ্যালঘু, তামিল হিন্দুদের চেয়েও তারা সংখ্যায় কম, তাই শ্রীলংকায় সেরকম থাকার কথা নয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ লিখেছেন, শ্রীলংকার হামলাগুলো আইএসের ইতিহাসে সর্বাধিক বিধ্বংসী আত্মঘাতী হামলা এবং হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য বড় ধরনের লজিস্ট্রিক সমর্থন প্রয়োজন হয়। যথেষ্ট পরিমাণে মিলিটারি গ্রেড বিস্কোরক পদার্থের প্রয়োজন হয়। এরকম শক্তিশালী বোমা তৈরির জন্য ছোটখাটো কারখানার প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ শ্রীলংকার হামলাগুলোর পেছনে বেশ বড়, শক্তিশালী ও সুদক্ষ একটা সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক কাজ করছে।
সিরিয়ায় চ‚ড়ান্ত পতনের পর আইএসের এখন আর কোনো কেন্দ্রীয় ঘাঁটি নেই। কিন্তু সংগঠনটির কর্মীরা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দুনিয়ায়। শ্রীলংকার হামলা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ভাবনার বিষয়। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, উদ্বেগের কিছু নেই- এরকম ভাবলে ভুল করা হবে যদিও পুলিশের কার্যক্রম প্রশংসনীয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট