শ্রাবণের ঝরে পড়া

91

গ্রামটির নাম রূপসাপুর। চারদিকে সাগরের অথৈ নীলিমা। মধ্যখানে একটা বিস্তৃত চর। রূপোলি চাঁদের আলোয় কোন এক প্রেয়সী ভবতরে খুঁজে পেয়েছিল তার রূপসীকে। ছিন্নবিন্ন এ জলনগরে সে নতুন শহর গড়ে তার নামকরণ করেছিল রূপসাপুর। সেখানে বাস করা লোকেরা প্রায় সবাই জেলেবৃত্তি ধারণ করে।
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যখন সাগর পানি ভরভর হয় তখন এ গাঁ টি প্রায়সয় বানের জলে ডুবু ডুবু হয়ে বসে। লোকজনের আহা কি হাহাকার! তবে জীবন-মৃত্যুর অসম খেলায় তাদের থোড়াই কেয়ার। দিন এনে দিন খাওয়ার লোক তারা। কোনদিন উনুনে হাড়ি চড়ে তো কোনদিন চড়েনা।
মাছ মেরে শহরতলীতে বেচে এসে দু-চার পয়সা যা মেলে তাও হরিশচন্দ্রের পানশালায় ভেসে যায়। তাই অধিকাংশেরই ঘরে ঠিকঠাক দুবেলা হাড়ি উনুনে চড়েনা। নারী-শিশুদের কোলাহল আর চেঁচামেচিতে সরগরম হয়ে যায় এককালের এই নির্জন দ্বীপটি।
জানা যায় যে এক সময় দক্ষিণের রাজাদের রোষে পতিতদের এখানে বনবাসে পাঠিয়ে দিতেন। জায়গাটি তখন আরো বেশি ভয়ংকর, আরো বেশি গভীর জঙ্গলে ঠাসা ছিল। লোকজনের কোলাহল বেড়ে গিয়ে এখন কিছুটা যুতসই হয়ে উঠছে। তাও কেউকেউ এখনো রাত করে বাড়ি ফিরলে ঘাটে কি অদ্ভুততুরে সব পশু দেখতে পায়। একবার তো ছমির উদ্দিনের ছোট মেয়েটাকে কিনা কি যেন গলা টিপে মেরে ফেলে রাখে রূপসাপাড়ে। সকালে সবার কি চেঁচামেচি! মা ছাড়া মেয়েগুলো নিয়ে ছমিরউদ্দিন বুড়ো বড় অভাব-কষ্টে দিন কাটাত।
পরের নৌকায় গিয়ে মাছ ধরত। তাতে দু-চার আনা যায় পেত পুরোটাই বড় মেয়ে শ্রাবণের হাতে দিত। অবশ্য যখনি প্রয়োজন পড়ত পাওয়া যেত। সে নাকি পুরোই হয়েছে তার মার মতন। নিরেট সাংসারিক মেয়ে। ছমির উদ্দিন গল্প করে,
– শ্রাবণটা এক্কেবারে তার মার লাহান হয়াছে। হের মাও এই মাপের ছিল।
শুনে মোটামুটি ভালোই লাগলো ইদ্রিস মাঝির। তবে কড়া শর্ত হলো। ছেলে তার একেবারে প্রিন্সের মতন । কাজকামেও যথেষ্ট পারদর্শী। গ্রামে থাকেনা। থাকে চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রামের একটা জায়গায় কাম করে। এই ধান কাটা,গাছ কাটা, আলু খেত বেগুন খেত করার কাজ আরকি। তাও সে এ গ্রামে একটা নামডাক কুড়িয়েছে, সে শহরের মানুষ। তাই ইদ্রিসের এককথা ছেলেরে বিশ হাজার টাকা নগদে দিতে হবে।
ছমিরউদ্দিন কিছু বলেনা। এত টাকা সে পাবে কয় তাও ভাবেনা। রোজ সকালে পান্তা আর শুকনো মরিচ যে লোকের নিত্য ভরসা তার জন্য বিশ হাজার টাকা! একটা ছোটখাটো পাহাড়ের সমান। সে তাও মনেপ্রাণে চায় মেয়েটারে একটা জোত করতে। এদিকে মেয়ের বয়সের পারদও তো আর বসে নেই, চরচর করে বেড়ে চলেছে। অনেক কথার ম্যারপ্যাঁচ কাটিয়ে দশ হাজার পর্যন্ত একটা দফারফা হলো। একদিন আষাঢ়ের রাতে বিয়েটা হয়েই গেল শ্রাবণের। বিয়ের দিন ছমির উদ্দিনের আহা কিযে কান্না। বৌ মরার দিনেও সে এতো কাঁদেনি। কারণ তার অগাধ আস্থা ছিল মেয়েটির উপর। বরযাত্রীরা চলে গেল। বাড়ি ভর্তি লোকজনও খালি হয়ে গেল।
শ্রাবণের তখন শুরু। রাত তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার । অমাবস্যার রাত বোধহয়। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। জেলেপাড়ার কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই। নিস্তব্দ রাত্রি। হঠাৎ ছমির উদ্দিনের পায়ের কাছে কি যেন একটা কামড় দিল। রাতের বাড়াবাড়িতে সে দেখতেও পেলনা। মাগো বলে গগন বিদারী চিৎকার করে উঠে ।
পাশের ঘর থেকেই লতা জেগে উঠে। দৌড়ে আসে, অন্ধকারে পা দিয়ে বসে সাপের লেজে। ঘুরেই সাপটি তার পায়েও দংশন করে বসে। মুহুর্তেই সেও চিৎ হয়ে পড়ে। অধিকে ততক্ষণে ছমিরউদ্দিনের নাক-মুখে ফেনা চলে আসে। পরাণ পাখি উড়াল দেওয়ার বেশিক্ষণ যেন নেই। একরাত্রির তোপে মরে যায় দু দুটো তাজা প্রাণ। অথচ কারুর সে খবর রাখার গরদ নেই। পরদিন সন্ধ্যায় মতলব মাঝি সাগরের ঢেউয়ে একটা মৃত গলিত নারীদেহ দেখে শনাক্ত করে এটি তো শ্রাবণ! সে ছমিরউদ্দিনের কানে সে খবর পৌঁছাতে এসে দেখে সেও নেই। কেউ নেই। তখনো ঝুমঝুম বৃষ্টি নামে একনাগাড়ে।
চোখের কোণে জমিয়ে রেখেছি
কতক ফোটা নোনা জল,
শ্রাবণ এলে ছুটিয়ে দেব ঝরবে
অনর্গল।