শ্রমিকের একটি দাবি না মানায় ঘটনার সূত্রপাত?

27

বাঁশখালীর গন্ডামারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শ্রমিক অসন্তোষের মূলে ছিল দশ দফা দাবি। শ্রমিকদের দেয়া দশ দফা দাবির মধ্যে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ একটি দাবি না মানার কারণেই শ্রমিকরা ক্ষিপ্ত হন। আর সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্থানীয় একটি পক্ষ ইন্ধন যুগিয়েছে। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যে কারণে পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলি চালালে পাঁচ শ্রমিক মারা যায়। এ ঘটনার পর থেকে শ্রমিকরা প্রকল্প এলাকা ছেড়ে যে যার গন্তব্যে চলে যায়।
গত শনিবারের ঘটনায় পুলিশ ও প্রকল্প কর্তৃপক্ষের দায়ের করা দুটি মামলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে ২২ জনের নাম উল্লেখ করে ও বাকিদের অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। মামলার পর থেকে শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নাম উল্লেখিত ২২ জন আসামির সবাই স্থানীয় হওয়ায় প্রকল্প এলাকার আশপাশের গ্রামগুলো পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। তবে মামলায় নিরীহ কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বাঁশখালী থানার ওসি শফিউল কবীর পূর্বদেশকে বলেন, ঘটনায় যারা উস্কানি দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শ্রমিকদের কাজে যোগদান করতে বলা হয়েছে। নিরীহ কাউকে হয়রানি করা হবে না।
প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর মো. ফারুক আহমদের দায়েরকৃত মামলায় উল্লেখ করা হয়, শ্রমিকরা দশটি দাবি দিয়েছিল। দাবিগুলো হল- রমজান উপলক্ষে সকাল ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত ৮ ঘন্টা ডিউটি পালন, দুই ঈদে এক মাসের বেতনের সমান বোনাস প্রদান, প্রতি মাসের ১০ তারিখে বেতন প্রদান, কোন কারণ ছাড়া বেতন থেকে টাকা কর্তন না করা, বাংলাদেশী শ্রমিকদের সাথে খারাপ ব্যবহার না করা, শ্রমিক দুর্ঘটনা কবলিত হলে চিকিৎসা খরচ দেওয়া, শুক্রবার দশ ঘণ্টার পরিবর্তে সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যন্ত পাঁচ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করে ১০ ঘণ্টার বেতন দেওয়া, শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করা, আবাসন এলাকার উন্নয়ন সাধন করা। এসব দাবি মেনে নিতে ঘটনার আগের দিন জং জি জিয়াং কোম্পানির প্রায় তিন শতাধিক শ্রমিক কাজে যোগদান না করে সেফকো-৩ এর সামনে দাবি আদায়ে বিক্ষোভ করেন। পরে মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে জং জি জিয়াং কোম্পানি ও ম্যান পাওয়ার কোম্পানির বৈঠকে দশটি দাবির মধ্যে শুক্রবারে পাঁচঘন্টা ডিউটি করে দশ ঘন্টার বেতন নেয়ার দাবিটি ছাড়া বাকি সবগুলো মেনে নেয়। এরপরেও জং জি জিয়াং কোম্পানির কর্মবিরতি পালনকারী শ্রমিকরা প্রকল্পের সকল শ্রমিকদের কর্মবিরতি পালনের প্ররোচনা দেয়। পরে খবর পেয়ে পুলিশ শ্রমিকদের আবাসন গেটে গিয়ে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ না করে দাবি আদায়ের জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করতে বলেন। এরপরেই প্রকল্প এলাকায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। গাড়িতে আগুন দেয়া হয়।
মামলার বাদি ও প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর মো. ফারুক আহমদ পূর্বদেশকে বলেন, প্রকল্পের ২৫ শতাংশ শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছেন। বাকিরাও দ্রæত যোগ দিবেন। এখন পুরোদমে কাজ চলছে। প্রথমেই শ্রমিকদের দশ দাবির ৯টিই মানা হয়েছিল। যে একটি দাবি তখন মানা হয়নি সেটিও পরবর্তীতে আলোচনা করে মানা হয়েছে। প্রকল্পে ধীরে ধীরে কাজের পরিবেশ ফিরে আসছে।
লুটপাটে জড়িত ১৮ জন: ঘটনার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রকল্পের চারপাশে ও জেটিতে কোনরূপ নিরাপত্তা প্রহরী ও পুলিশ পাহারা ছিল না। যে কারণে প্রকল্পের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব পাশের এলাকায় দুষ্কৃতিকারীরা প্রকল্পের ভেতর থেকে স্টিল ও ইলেকট্রিক্যাল নানা যন্ত্রপাতি লুট করে। যার আনুমানিক মূল্য ১০ কোটি টাকা। চুরির বিষয়ে মামলার সাক্ষি নবীর হোসেন জানান, স্থানীয় ১৮ জন ব্যক্তি প্রকল্পের ভেতর থেকে বিভিন্ন জিনিস চুরি করে নিয়ে যায়।
ইউপি সদস্যও আসামি : মামলার ২১ নং আসামি করা হয়েছে গন্ডামারা ইউপির ৩ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আলী হায়দার আসিফকে। স্থানীয় জমিদার বাড়ির সন্তান আসিফ এই বিদ্যুৎ প্রকল্পে চাকরি করতেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় আসিফ। তিনি চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন কর্পোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। এ বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতেই জড়িতদের আসামি করা হয়েছে।
মাইকিংয়ে শ্রমিক উস্কানি : শনিবার সকাল থেকেই শ্রমিকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে প্রকল্পের ভেতরে থাকা শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে মাইকে বক্তব্য রাখা হয়। এমন বক্তব্যের একটি ভিড়িও পূর্বদেশের হাতে এসেছে। মাইকিংয়ে শোনা যায়, ‘মৃত্যুর ভয় কেউ পাবেন না, মৃত্যু চলে আসলে যেখানেই থাকেন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পারবেন না। দয়া করে সবাই চায়না কেন্টিনের সামনে চলে যান।’
কয়েকজনের কন্ঠে এমন মাইকিং শোনা যায়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রমিকরা দিগি¦দিক ছুটতে থাকেন। গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন শ্রমিকরা। চিৎকার করে কেউ কেউ বলে উঠেন, ‘পুলিশ গুলি করছে।’
গন্ডামারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সমন্বয়ক আদিল বিল্লাহ পূর্বদেশকে বলেন, সেদিন মাইকিং করেই শ্রমিকদের উস্কানি দেয়া হয়েছে। যার প্রমাণ পুলিশের কাছে আছে। তদন্তে বের হবে এই মাইকিং কারা করেছে।
মামলার তদন্ত কাজে জড়িত পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে কারা ঘটনায় উস্কানি দিয়েছে তার সব ধরনের ফুটেজ আছে। আমরা সেগুলো ধরেই তদন্ত কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। মাইকিং করেই শ্রমিক উস্কানি দিয়েছে একটি পক্ষ। এই মাইকিং যারা করেছে তাদেরও আমরা চিহ্নিত করেছি।