শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব চট্টগ্রাম লোকগানের দিকপাল

70

শাহীন চৌধুরী
শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব বলতে চট্টগ্রামের ভাষার গানের কথা সামনে চলে আসে। তিনি তাঁর স্বকীয় উপস্থাপন আর গানের মুল বিষয়টাকে আঙ্গিক ভাবাবেগ দিয়ে তুলে ধরতেন বলে তিনি শুধু দেশে নয় উপমহাদেশে জনপ্রিয়তার ঈর্ষনীয় অবস্থানে ছিলেন। একসময় বিয়ে বলতে শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব আর শেফালীর গান ছাড়া চিন্তা করা যেত না। দুজনের এ জুটির গান মানুষের আজো সমান জনপ্রিয়তায় হৃদয়ে আছে। খুব সহজ সাবলীল রীতিতে তাঁর গানগুলো তিনি গাইতেন বলে শ্রোতারা সহজে গানগুলোকে উপভোগ্য হয়ে উঠত। শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব ১৯২৭ সালে হাটহাজারী থানার অন্তর্গত ফতেয়াবাদের নন্দিরহাট গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা জয়দাশ বৈষ্ণব ছিলেন আধাত্মিক গানের একনিষ্ঠ সাধক। মা তুলশী বৈষ্ণব ছিলেন একজন সভ্রান্ত পরিবারের আদর্শ গৃহীনি। বলতে বাবার হাত ধরেই তিনি গানের হাতেকড়ি হয়। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের হাল ধরতে তিনি কর্ম জগতে যুক্ত হওয়ায় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের সহধর্মিণী রেণু বালা বৈষ্ণব ছিলেন আরেকটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। তাঁদের পাঁচ ছেলে পাঁচ মেয়ে। ছেলেরা যথাক্রমে রাধা গোবিন্দ বৈষ্ণব, সত্যজিৎ বৈষ্ণব, বিশ্বজিৎ বৈষ্ণব, নন্দ কিশোর বৈষ্ণব, প্রেম সুন্দর বৈষ্ণব। আর মেয়েরা হলো- জ্যুতি বালা বৈষ্ণব, লক্ষি বৈষ্ণব, সীতা বৈষ্ণব, গীতা বৈষ্ণব, স্মৃতি বৈষ্ণব। তার মধ্যে প্রেম সুন্দর বাবার গানগুলো এখনো নিজ কন্ঠে বাবার সে আমেজকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব ১৯৬৩ চট্টগ্রামের প্রবীন আঞ্চলিক ও মরমী গানের গীতকার সৈয়দ মহিউদ্দিন প্রকাশ মহি আল ভান্ডারীর গান দিয়ে বাংলাদেশ বেতারের পথ চলা শুরু করেন এরপর তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে কন্ঠশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তাঁর গাওয়া অসংখ্য গান রয়েছে তারমধ্যে জনপ্রিয় গানগুলো হলো- আর বাঁইক্কা টেঁয়া দে, বানুরে জ্বী, অ বানু জ্বী, অ জেডা ফইরার ভাব, আঁর বউরে আঁই কিলাইয়ুম, চল আঁরা ধাই, ভাইসাব দুম্বি আইয়েন, ও বেয়াইন কেন্নে আইলেন আঙ্গো বাইত, দেশে গেলে কইয়েন গো ভাইচা, চাটিগায় চাক্রী এককান হাইচি এরকম অসংখ্য গান। তিনি সৈয়দ মহিউদ্দিন, আবদুল গফুর হালী, এম, এন আক্তার, এবং নিজের লেখা গান করেছেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় বেশকিছু সন্মানে ভুষিত হন। তাঁকে সন্মান দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলে হলো- বেতার গুণীজন সংবর্ধনা, রয়েল ক্লাব অব মেট্রোপলিটন, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা পরিষদ, শহীদ নতুন চন্দ্র সিংহ স্নৃতি পরিষদ, বাংলাদেশ উদীচী চট্টগ্রাম, ধ্রুব পরিষদ, চট্টগ্রাম শিল্পী সংস্থা, আলাউদ্দিন ললিতকলা একাডেমি, ত্রিতরঙ্গ, ফতেপুর পল্লীবাসী, হাটহাজারী কন্ঠ, সম্মিলিত বর্ষবরণ, এছাড়া তিনি মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছিলেন। চট্টগ্রামের এই আঞ্চলিক গানের সম্রাট শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব ২০০০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। আজ ৪ ডিসেম্বর তাঁর ২২ তম মৃত্যুবার্ষিকী। চট্টগ্রামের লোক গানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া এই শিল্পীর অনেক গান সংরক্ষণ অভাবে হাঁরিয়ে যাচ্ছে। বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্র আলাদা একটি টিভি কেন্দ্র হওয়া স্বত্বেও চট্টগ্রাম গুণী শিল্পীর একটি ছবিও চোখে পড়েনি যা পরবর্তী প্রজন্মকে প্রেরণা জোগাবে। শুধু শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব নয় রমীশ শীল যিনি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হওয়া স্বত্বেও তাঁর সহ, শেফালী ঘোষ, অন্যান্য প্রথিতযশা কোনো শিল্পীর কেনো তথ্য এ কেন্দ্রে নেই যা হতাশা এবং দুঃখজনক। এসব গুণী শিল্পীদের জীবন কর্ম তুলে ধরা এবং তাঁদের গানগুলো বাঁচিয়ে রাখার পদক্ষেপ গ্রহণে সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। লোক গানের সম্রাট শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের ২২ মৃত্যুবারৃষিকীতে তাঁর স্নৃতির প্রতি অতল শ্রদ্ধা জানাই।