শোকের মাসের অনুভূতি

20

প্রফেসর আবু জাফর চৌধুরী

শোকের মাস আগস্ট। আগস্ট মাস আসলেই আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে মিডিয়া বা সভা সমিতিতে ব্যাপক আলাপ আলোচনা হয়। অনেকেই তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। কিন্তু যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাস করেন, যারা প্রকৃতই এই চেতনাকে ধারণ করেন, যাদের মনে বঙ্গবন্ধু তিল তিল করে এই চেতনাকে সঞ্চারিত করেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শানিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন সেই প্রকৃত মুজিব ভক্তদের হৃদয়ে শোকের অনুভ‚তি কোন একটা দিন বা মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই প্রকৃত মুজিব ভক্তদের শোকানুভূতি প্রতিদিন, প্রতি মাস, সারা বছর এবং আজীবন। এরকম লক্ষ কোটি মুজিব ভক্ত সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তারা কারো কাছে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করে না। তারা নেতাদের আশেপাশে ঘুর ঘুর করে না কিছু পাওয়ার আশায়। তারা সাময়িক গজে উটা কোন নেতাকে সমর্থন করে না। তারা তাদের প্রিয় জন্মভূমিতে লুটেরা মাফিয়াদের রাজনীতি চায় না। কিন্তু আজকের বাঙলাদেশে রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে একটা মাফিয়া চক্র। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাদের এজেন্টরা ঢুকে পড়েছে। তাই প্রকৃত মুজিব ভক্তদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্য নয়, বঙ্গবন্ধুর প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বদেশ বাঙলাদেশের জন্য ও। এই মুজিব ভক্তকূল এখনো আশায় বুক বেধে আছে তার কন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে। তারা এখনো প্রত্যাশা করেন শেখ হাসিনা এতটুকু বন্ধুর পথ হেঁটে এসেছেন, তিনি পারবেন দেশকে মাফিয়া ব্যবসায়ী চক্র, টাকা পাচারকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে। তিনিই হলেন এখনো আশা ভরসার শেষ ঠিকানা।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ভোরে ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধু হত্যার মিশন শেষ করে। তাকে হত্যার মিশন শুরু হয় একবারে ১৯৪৮ সাল থেকে, যখন তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ছাত্র লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় থেকে মৃত্যু তাঁকে অনুসরণ করতে থাকে নিয়ত। পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের সাংগঠনিক শক্তি মত্তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলো। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় শেখ মুজিব মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন নেপথ্যে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দবিরুল ইসলামের মামলা পরিচালনার জন্য ঢাকা আসলে তিনি শওকত আলীকে আওয়ামী লীগ গঠনের নির্দেশ দিয়ে যান। (সূত্র : বদরুদ্দীন ওমর রচিত ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও ততকালীন রাজনীতি’ পৃ. ২৪৭)। শওকত আলী বিষয়টি মুজিবকে জানান। কারণ তিনি জানতেন এব্যপারে মুজিবকে লাগবে। মুজিব এগিয়ে গেলেন তার সিনিয়র সামশুল হককে নিয়ে। তারা প্রথমে শেরে বাঙলা এ কে ফজলুল হককে প্রধান করে আওয়ামী লীগ গঠন করতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রথমে রাজি হয়ে পরে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তারপর তারা মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দেন। ভাসানী ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি। সদ্য আসাম থেকে এসেছেন। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। (সূত্র : বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’)। এ প্রক্রিয়া থামানোর জন্য পাকিস্তান সরকার মুসলিম লীগের গুন্ডা লেলিয়ে দিল শেখ মুজিবের পেছনে। পুরান ঢাকায় গুন্ডারা তাকে আক্রমণ করলো হত্যার উদ্দেশ্যে, তবে তা ব্যর্থ হয়ে যায়। এর পর পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তিনি বিভিন্ন উৎসের মাধ্যমে জেলখানা থেকেই আওয়ামী লীগ গঠনের নির্দেশনা দিতে থাকেন । রোজ গার্ডেনে সম্মেলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করে। জেলখানা থেকেই তিনি যুগ্ম সম্পাদক হন। সামশুল হক এর পরে তিনি সম্পাদক হন। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্তৃত্ব তার হাতে চলে আসে। কিন্তু গ্রেফতার হয়রানির দ্বারা তাকে দমানোর চেষ্টা চলতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে মুজিব গ্রেফতার, ১৯৫৪ সনে ৯২ ক ধারা জারির সাথে সাথে মুজিব গ্রেফতার, ১৯৫৮ সনে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারির প্রথম রাতেই মুজিব গ্রেফতার, এভাবে চলতে থাকে।
১৯৬৬ সনে সম্মিলিত বিরোধী দলের সম্মেলনে তিনি ৬ দফা দাবি পেশ করলে তার জীবন হুমকির মধ্যে পরে। তিনি দ্রæত রাওয়ালপিন্ডি ছেড়ে করাচী চলে আসেন এবং সোহরাওয়ার্দী কন্যা বেগম আকতার সোলাইমান এর বাসায় আশ্রয় নেন। তারপর দ্রুত ঢাকা ফিরে আসেন। তারপর তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার সব আয়োজন ১৯৬৯ এর গণ-আন্দোলনের ফলে ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৯৭০ এর নির্বাচনী প্রচারে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার সময় তার সন্দেহ হয় যে, রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দরে তার উপর হামলা হতে পারে। বিমানে পশ্চিম পাকিস্তানের এক সাংবাদিক ছিলেন নাম মালিক সরফরাজ খান। ভদ্রলোকের চেহারা কিছুটা বঙ্গবন্ধুর সাথে মিল ছিলো। বঙ্গবন্ধু সফরসঙ্গী আওয়ামী লীগ নেতাদেরকে ইশারা করে দিলেন যে, ঐ ভদ্রলোককে সামনে দিয়ে তারা যেন বিমান থেকে নেমে পড়েন। সেভাবেই সবাই নেমে পড়লেন। অপেক্ষামান জনতা সরফরাজ খানকে বঙ্গবন্ধু মনে করে ফুলের মালা পড়িয়ে দিলেন। এই সময় হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নেমে তার জন্য অপেক্ষমাণ গাড়িতে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের পর পরাজিত ফকা চৌধুরীর লোকজন রাউজানের নোয়াপাড়ায় ভোটারদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করলে বঙ্গবন্ধু পরিদর্শনে আসেন। পথে তার গাড়িবহরে একটি ট্রাক আঘাত করার চেষ্টা করে। লক্ষ্য ছিলো তার গাড়ি, ভুলক্রমে আরেকটি জিপকে আঘাত করে পালিয়ে যায়। এতে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের দুজন ছাত্র লীগ নেতা নিহত হয়।
১৯৭০ এর নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও ভূট্টো আলোচনার নামে বার বার পশ্চিম পাকিস্তানে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তার সহকর্মীরা তাঁকে সেখানে না যেতে যুক্তি দেখিয়ে বলেন যে, পাকিস্তানীরা সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে বৈরুতের হোটেলে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করেছে, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে রাওয়ালপিন্ডির হোটেলে হত্যা করেছে, আপনি ও সেখানে গেলে আর জীবিত ফিরে আসতে পারবেন না।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার চুড়ান্ত ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের কারণে দেরি হচ্ছিল। এমতাবস্থায় ঢাকায় তাদের ৯৩ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করায় তাদেরকে বাঁচানোর জন্য বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু পাকিস্তানিরা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে সরে আসে নি। তারা তাদের গোয়েন্দাদের মাধ্যমে এদেশের মুসলিম লীগ, জামাতি এবং চীন পন্থী উগ্রবাদীদের সাথে যোগাযোগ করে। ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের একটি গ্রুপ রাতারাতি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ত্যাগ করে মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রের শ্লোগান দিয়ে সাময়িক উত্তেজনায় বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর হয়। গঠিত হয় জাসদ। মুসলিম লীগ, জামাতিরা সুযোগ পেয়ে যায়। তারা ঢুকে পড়ে জাসদে। তারা জনগণের মধ্যে এবং সেনাবাহিনীতে তীব্র মুজিব বিরোধী প্রচার চালায়। কর্নেল অব. তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামে জাসদের সামরিক শাখা গঠিত হয়। এই সামরিক শাখা, পাকিস্তান ফেরত অফিসার-সৈনিকরা এবং উচ্চাভিলাসী মুক্তি যোদ্ধা সামরিক অফিসার মিলে বাঙলাদেশ সেনাবাহিনীতে বঙ্গবন্ধু,রক্ষীবাহিনী ও ভারত বিরোধী তীব্র প্রচার চালায়। তাদের সাথে যুক্ত হয় পাকিস্তান এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা। কর্নেল সাফায়ত জামিলের তথ্য মতে ১৯৭৩ সনের শেষের দিকে মেজর ফারুক একবার অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। তখন ট্যাংক ছিল মাত্র তিনটি। সেগুলো কব্জা করে বিদ্রোহ করতে চেয়েছিলো। ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা দেখে পিছিয়ে যায়। সেই কাজটায় ১৯৭৫ এর পনেরই আগস্ট সম্পন্ন করা হয়। আমরা জাতির জনককে হারিয়ে ফেলি। এদেশে আবার চালু হয় পাকিস্তানী ভাবধারা। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলো। ১৯৭১ সনে পরাজয়ের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন যে, যুদ্ধ শেষ হয় নি, যুদ্ধ চলবে। সত্যিই আমাদের সাথে তাদের দালালদের যুদ্ধ চলছে। সেই ধারাবাহিকতায় যেমন ১৫ আগস্ট, একইভাবে ২১ আগস্ট, সবই এক সূত্রে গাঁথা। আমরা শোককে শক্তিতে পরিনত করে শেখ হাসিনাকে সম্বল করে এগিয়ে যেতে চাই। বাঙালি অফুরন্ত প্রাণ শক্তির অধিকারী। সুতরাং জয় আমাদের হবেই।
লেখক: শিক্ষাবিদ