শোকাবহ আগস্ট

49

বাংলার ইতিহাসে এক মহাকাব্যের নাম হচ্ছে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। আর সেই মহাকাব্যের মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানি রাষ্ট্র-কাঠামোর অধীনেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভ্যুত্থান ঘটান শেখ মুজিবর রহমান। যার পরিণতিতে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর মত সাহসী ও ত্যাগী নেতৃত্ব তৎকালীন আর কারও মধ্যে দেখা যায়নি। ফাঁসির মঞ্চ থেকে তিনি একাধিকবার ফিরে এসেছেন, আপস করেননি। তাই, বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বাঙালি জাতির জন্য এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। পরিণত হয়েছেন বাঙালি জাতির জনকে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সেই সত্তা, যাকে রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সোহরাওয়ার্দীর মতো মহান ব্যক্তিবর্গ নিজের মতো করে আকার দিয়েছেন। আর সেই মৃত্তিকা-মূর্তির আকারে প্রাণ সঞ্চারের জন্য এক কঠিন সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধুকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলার ইতিহাস হয়তো দীর্ঘকালের জন্য অশুভ অন্ধকারে থমকে থাকত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচনী আবেদন’ শিরোনামে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল খুবই গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ। ওই ইশতেহারের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লিখলেন, ‘শেরে বাংলা আজ পরলোকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আমাদের মাঝে নাই। যারা প্রবীণতার দাবি করেছেন, তাদের অধিকাংশই হয় ইতোমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণির বাঙালি-বিদ্বেষীর কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিতে তল্পীবাহকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, নয়তো নিষ্কর্মা, নির্জীব হয়ে পড়েছেন। কেউবা অন্যের শলা-পরামর্শে বশীভূত হয়ে কথা ও কাজে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, ভাগ্য-বিপর্যস্ত মানুষের হয়ে আমাদেরকেই কথা বলতে হবে’।
বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল একটি স্বচ্ছ-জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক কল্যাণ-রাষ্ট্র হিসেবে। পাকিস্তান আমলে এদেশের মানুষকে ভোগ করতে হয়েছে সামরিক একনায়কতন্ত্র। পঁচাত্তরের পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে ফের পাকিস্তানি আদলে বাংলাদেশে দীর্ঘ সামরিক দুঃশাসন ফিরিয়ে আনা হয়। বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরোচিত ও কলংকময় এই হত্যাকান্ড ছিল বাংলাদেশ নামক কল্যাণ রাষ্ট্রটিকে হত্যারই একটি অপচেষ্টা। ঘাতকদের এটা জানা ছিল যে, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে সামরিক সন্ত্রাস, ধর্মীয় উগ্র-মৌলবাদ আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যের বাংলাদেশ তৈরি আর সম্ভব নয়। বাংলাদেশ দশকের পর দশক ধুঁকে ধুঁকে মরেছে। আকাশে ধ্বনিত হয়েছে খুনিদের উল্লাস। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতো লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রেরও মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর চেষ্টা হয় সেদিন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। তারও পাঁচ মাস আগেই ১৯৭২ সালের ৭ জুন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু যে বক্তৃতা করেন, তাতে বাংলাদেশের সংবিধান বা শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছিল। ওই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধানের চার স্তম্ভ সম্পর্কে বলেন, ‘আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালি জাতি, এ নিয়ে হলো- বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকবে। এ হলো আমার এক নম্বর স্তম্ভ। দ্বিতীয় স্তম্ভ হলো- বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। তবে, এ সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না। এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র। তার অর্থ হলো- শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন। কিন্তু, সমাজতন্ত্র যেখানে আছে সেখানে গণতন্ত্র নাই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে- গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করবো। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। তৃতীয় স্তম্ভ হলো- গণতন্ত্র। মানে জনগণের শাসন। আর চতুর্থ স্তম্ভ হলো- বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রীস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। বাংলার মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। এই হলো চার দফা, চার স্তম্ভ’। এমন দূরদর্শী চিন্তার জাল বিস্তার করা কেবল বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল হৃদয় ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী ইতিহাসের মহানায়কের পক্ষেই সম্ভব।