শোকাবহ আগস্ট

80

বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃংখল ও দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়াই যে বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল, তাঁর বিভিন্ন সময়ে উচ্চারিত কথামালার মধ্যেই সে প্রমাণ পাওয়া যায়। শেখ মুজিব প্রকৃত অর্থেই শ্রেণী-বৈষম্যহীন মর্যাদাবান বাঙালি জাতি গড়ারই স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতার ভালোবাসাই তাঁর কাছে পরমারাধ্য ছিল। রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেই তিনি ধনীক শ্রেণীর বদলে সাধারণ বাঙালির স্বার্থকেই বড় করে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর নিজের কথামালার মধ্যেই তাঁর ব্যক্তিত্ব, সাহস, বিচক্ষণ নেতৃত্ব, অকুণ্ঠ দেশপ্রেম, বাঙালি জাতির ভবিষ্যত নিয়ে দূরদর্শী চিন্তা, আপসহীন চেতনা ও আদর্শসহ বিশাল হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায়।
জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে প্রতিটি মূহুর্ত জাতির কল্যাণে কাজ করে গেছেন। কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা রেখেছেন। তিনি বলেন, কোনো জেল-জুলুমই কোনোদিন আমাকে টলাতে পারেনি, কিন্তু বাংলার মানুষের ভালবাসা আমাকে বিব্রত করে তুলেছে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন- পড়ো, জানো, শেখো, বোঝো। তারপর বিপ্লবের কথা বলো। বিপ্লব রাতের অন্ধকারে গুলি কইরা, টেরোরিজম কইরা হয় না। মানুষ মরতে পারে, কিন্তু নীতি বা আদর্শ মরে না কোনোদিন। পরবর্তী প্রজন্মের উপর ভরসা রেখে তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক, শহীদদের রক্তদান সার্থক। দুর্নীতি নামের যে বিষ আজ রাষ্ট্র-কাঠামো ও সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে, তা বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশাতেই বুঝতে পেরেছিলেন। এজন্য রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালেই তিনি বলেছিলেন, বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতি উৎখাত করতে হবে। দুর্নীতি আমার বাংলার কৃষক করে না। দুর্নীতি আমার বাংলার শ্রমিক করে না। দুর্নীতি করে আমাদের শিক্ষিত সমাজ। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে উপমহাদেশে ধর্মান্ধতা বা সাম্প্রদায়িকতার বীভৎস-রূপ নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেই বীভৎসতার কবর রচনা করতে চেয়েছেন বাংলার মাটি থেকে। এজন্যই তার স্পষ্ট উচ্চারণ, সা¤প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু, ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে লুট করে খেতে দেওয়া হবে না। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব তা মোটেও হয়নি। আমি বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি বলে, গণতান্ত্রিক-মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলব সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটিকয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তা করতেই হবে। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে শক্তিধর বহির্বিশ্বের চুল পরিমাণ হস্তক্ষেপও বঙ্গবন্ধু কখনও বরদাশ্ত করেন নি। এজন্যই আত্মবিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে বলেছেন, আমার দেশ স্বাধীন দেশ। ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট ব্রিটেন হোক-কারো এমন শক্তি নাই যে, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ আমার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।