শোকাবহ আগস্ট

55

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি নন। একটি প্রতিষ্ঠান। একটি আন্দোলন। একটি বিপ্লব। একটি অভ্যুত্থান। জাতি নির্মাণের কারিগর। মহাকাব্যের অমর গাঁথা এবং একটি ইতিহাস। এই ইতিহাসের ব্যাপ্তি হাজার বছর। তাই সমকাল তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। তিনিই হবেন বাঙালি জাতির মহাকালের মহানায়ক। ইতিহাসে অক্ষয় ধ্রুবতারার মত অম্লান গরিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবেন। বাঙালি জাতিকে পথ দেখাবেন। তাঁর স্বপ্ন বাঙালির অস্তিত্ব। তাঁর স্মৃতি বাঙালি জাতির আরাধ্য সমাজ ও সংস্কৃতি। যে সকল সম্ভাবনা এবং প্রতিশ্রুতি তিনি তুলে ধরেছিলেন তাই বাঙালি জাতি ও তাঁর সভ্যতার ফল্গুধারা।
জনগণের কাছে তিনি বন্ধু। জাতির কাছে তিনি পিতা। বিদেশিদের চোখে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিক সিরিল ডান বলেন, ‘বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, কৃষ্টিতে এবং জন্মসূত্রেও ছিলেন খাঁটি বাঙালি। তাঁর দীর্ঘ শালপ্রাংশু দেহ, বজ্রকণ্ঠ, মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ
করার বাগ্মিতা এবং জনগণকে নেতৃত্বদানের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সাহস তাঁকে এ যুগের এক বিরল মহানায়কে রূপান্তর করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউজউইক’ পত্রিকা বলেছে, ‘শেখ মুজিব পোয়েট অব পলিটিক্স- রাজনীতির কবি।’ বিলেতের মানবতাবাদী আন্দোলনের প্রয়াত নেতা মনীষী লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে বলেছেন, ‘জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ডি ভ্যালেরার চেয়েও শেখ মুজিব এক অর্থে বড় নেতা।’ নতুন মিশরের শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক হাসনাইন হাইকেল বলেছেন, ‘নাসের কেবল মিশরের নন, সারা আরব জাতির মুক্তিদূত। তাঁর আরব জাতীয়তাবাদ আরব জনগণের শ্রেষ্ঠ মুক্তি-প্রেরণা। তেমনি শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নন, বাঙালি জাতির মুক্তিদূত। তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালির সভ্যতা ও সংস্কৃতির নব অভ্যুদয়ের মন্ত্র।’ মুজিব বাঙালির অতীত ও বর্তমানের শ্রেষ্ঠ মহানায়ক। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ারসে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি। শেখ মুজিবকে দেখলাম। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে মানুষটি হিমালয়। আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।’ বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মত্যুর খবর শুনে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইলসন লন্ডনের এক বাঙালি সাংবাদিকের কাছে লেখা শোকবাণীতে বলেন, ‘এটা আপনাদের কাছে অবশ্যই এক বিরাট ন্যাশনাল ট্রাজেডি। আমার কাছে এটা পরম শোকাবহ পার্সোনাল ট্রাজেডি।’
আসলে জাতির পিতা বলতে নেশন স্টেট এর প্রতিষ্ঠাতাকে বুঝানো হয়। আধুনিক ইউরোপের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-চেতনার ফসল আধুনিক জাতীয়তা ও জাতীয় রাষ্ট্র। এই আধুনিক নেশন ও নেশন স্টেটের প্রতিষ্ঠায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, জাতি তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে পিতা ও রাষ্ট্র নির্মাতার সুউচ্চ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। এজন্য কামাল আতাতুর্ক নব্য তুরস্কের জনক, মহাত্মা গান্ধী নতুন ভারতের পিতা, শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মডার্ন নেশন স্টেটের নির্মাতা এবং বাঙালি জাতির জনক। কামাল আতাতুর্ক এবং গান্ধীর চেয়েও শেখ মুজিব আরও বেশি সার্থকভাবে জাতির পিতার মর্যাদার অধিকারী। ওসমানিয়া বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের আমলেও তুর্কি জাতির নাম ও অস্তিত্ব বহাল ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার পর কামাল পাশা সেই সাম্রাজ্যের শেষ ভগ্নাবশেষ তুরস্ককে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত করে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক নেশন স্টেট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। গান্ধীর আগে এবং তাঁর আমলেও ভারত তাঁর নাম এবং জাতিত্বের পরিচয় হারায়নি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর বাংলাদেশ ও বাঙালির নামটি মুছে দেয়া হয়েছিল। নতুন পাকিস্তানি শাসকেরা তাদের সংবিধানেই বাংলাদেশের নাম দেয় পূর্ব পাকিস্তান। এরপর পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হাজার বছরের জাতিসত্তার পরিচয় মুছে দিয়ে তাদের কপালে রাষ্ট্রভাষা উর্দু সেঁটে দেয়া হয়। আর তাতেই ফুঁসে ওঠে বাঙালি জাতি।