শৈশব রক্ষায় শিশুশিক্ষাকে শিশুবান্ধব করতে হবে

12

রতন কুমার তুরী

একজন শিশু তার শিক্ষা জীবনের শুরুতে যদি আনন্দঘন এবং শিশুবান্ধব পরিবেশে বিদ্যাশিক্ষা অর্জন করতে পারে, তাহলে সে সারাজীবন জ্ঞান অর্জনের প্রতি ভীত হবেনা। অনেক সময় একেবারে ছোট বয়স থেকে শিশুদের বিদ্যা শিক্ষার জন্য চাপ দেয়া হয়। খেলতে দেয়া হয়না, কোথাও বেড়াতে যেতে দেয়া হয়না, শুধু পড়া আর পড়া, এতে করে অনেক শিশুই ছোটকাল থেকে শিক্ষার প্রতি বিরূপভাবাপন্ন হয়ে ওঠে।
শিশুদের এমন ভীতি কাটাতে শিশু বয়স থেকেই আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষাদান খুবই জরুরি।
বর্তমান সমাজে শিশুদের পিতামাতাদের ৩/৪ বছর বয়স থেকেই মোটামোটা বই নিয়ে বিভিন্ন ইংরেজি, বাংলা মাধ্যম স্কুলে যাতায়াত করতে দেখা যায়।
বর্তমানে কিছু বেসরকারি বিদেশিধারার স্কুল এবং যেখানেসেখানে গড়ে ওঠা অসংখ্য ব্যক্তিগত ও সিন্ডিকেট পর্যায়ে স্কুলগুলো শিশুদের কাক্সিক্ষত বিদ্যা শিক্ষা দেয়ার বদলে চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এসব স্কুলের কিছুকিছু শিশুদের ভালো মানের বিদ্যাশিক্ষা দিতে সক্ষম হলেও এমন সংখ্যা হাতে গোনা। পথেঘাটে গড়ে ওঠা এসব স্কুলের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের কাক্সিক্ষত মান ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে এর প্রধান কারণ এসব স্কুলে শিশুদের আনন্দ বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। একটা ছোট্ট জায়গায় গড়ে ওঠা এসব স্কুলে শুধু পড়া আর পড়া।
একসময় এসব বিদেশি ধারার স্কুলে অভিভাবকরা তাদের শিশুদের একেবারে ছোট বয়সে ভর্তি করিয়ে দিতো বর্তমানে অভিভাবকদের মনে বিভিন্ন প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে, এতো বইয়ের চাপ শিশুমনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে কীনা, এতোগুলো বই তার ভবিষ্যত জীবনে আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কীনা ফলে এখন অনেক অভিভাবকই বেসরকারি বিদেশি ধারার কোনো স্কুলে তার ছোট্ট শিশুটিকে ভর্তি না করে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করাতে এগিয়ে আসছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহেরও বেশকিছু সীমাবদ্ধ রয়েছে তারপরও এখানে প্রায় প্রতিটি স্কুলের সামনে রয়েছে ছোট্ট শিশুদের জন্য একটি খেলার মাঠ। শিশুরা চাইলে এখানে একটু সময় খেলাধুলায় মত্ত হতে পারে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রাইমারি পর্যায়ের বইগুলোও মোটামুটি শিশুতোষ হিসেবেই প্রণয়ন করা হয়েছে। শিশু শ্রেণিতে বলা যায় তেমন পড়ার চাপ নেই। তাছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি প্রাইমারি স্কুল গুলোতে মেধাবিরা এগিয়ে আসছে শিক্ষকতা করতে ফলে অনেক প্রাইমারি স্কুলই তাদের শিক্ষার্থিদের কাক্সিক্ষত শিক্ষা দিতে পারছে। তবে গ্রামিণ পর্যায়ে শিক্ষক সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে তানাহলে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রাইমারি স্কুলগুলোতে বিদ্যাশিক্ষা কিছুটা ব্যাঘাত ঘটবে। প্রকৃতপক্ষে শ্রেণিকক্ষে শিশুদের আনন্দময় শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে একজন শিশুর আনন্দময় শৈশব ধরে রাখা যায়। বাংলাদেশের প্রাইমারি স্কুলগুলোতে এই বিষয়টি প্রয়োগ একটু কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। যেহেতু বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি প্রাইমারি স্কুলে এখন সুপরিসর জায়গা এবং দৃষ্টিনন্দন দালান রয়েছে শিক্ষকরা একটু আন্তরিক হলে শিশুদের একটু ভিন্নমাত্রার শিক্ষা দিয়ে তাদের শৈশবের শিক্ষা জীবনকে আনন্দময় করে গড়ে তুলতে পারে। শ্রেণি ক্লাসের ফাঁকে সামান্য গান,কবিতা আবৃত্তি, অংকের খেলা ইত্যাদি চর্চার মাধ্যমে ছোট্ট শিশুদের আনন্দময় শিক্ষা সহজেই দেয়া সম্ভব। এর বাইরে প্রাইমারি পর্যায়ে শিক্ষার্থিদের পরীক্ষাভীতি কমাতে পরীক্ষার সংখ্যা কমাতে হবে। পরীক্ষা হবে তবে তা কোনো চাপ ছাড়া। শিশুরা খেলতে খেলতে অথবা পড়তে পড়তে পরীক্ষা দেবে তাতে তাদের মধ্য থেকে পরীক্ষাভীতি কমবে। প্রকৃতপক্ষে শিশুদের মেধা ও মননশীলতা বাড়াতে বাড়িতে মা-বাবার শিক্ষা প্রধান হলেও এই শিক্ষাটি শিশুদের মনে আজীবন গেঁথে দিতে পাঠশালার কোনো বিকল্প নেই আর সেই পাঠশালার শিক্ষা হতে হবে আনন্দময় পরিবেশে।
মুলতঃ স্বাধীনতা পর বাংলাদেশের শিশুদের কথা চিন্তা কওে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে প্রাথমিক শিক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সংবিধান মতে প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক বিধানগুলো হলো-
(ক) একটি অভিন্ন জনসম্পৃক্ত ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সকল ছেলে-মেয়ের জন্য বিনামূল্যে ও বাধ্যতামুলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার যা আইন দ্বারা নির্ণয় করা যেতে পারে।
(খ)শিক্ষাকে সমাজে চাহিদা সাথে পুরনে সক্ষম প্রশিক্ষিত ও প্রণোদিত নাগরিক বের করা।
(গ) একটি নিদির্ষ্ট সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দুরকরণ আইন দ্বারা নির্ধারণ করা যেতে পারে। সরকার জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার স্বীকার করে যা বাংলাদেশে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।
স্বাধীনতার সূর্য উদয়ের পর থেকে প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে পুনর্জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। তারই আলোকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৬১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৫৬৭২৪ জন শিক্ষককে সরকারি করে প্রাথমিক শিক্ষায় গতির সঞ্চার করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সময়ও সেধারা অব্যাহত আছে। প্রকৃতপক্ষে শিশুদের প্রকৃত শিশুশিক্ষা দিতে হলে আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। এই বিষয়টি সকলপক্ষের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত।আমরা প্রত্যাশা করবো বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিশুদের আনন্দময় ও শিশুবান্ধব পরিবেশে শিক্ষা দান করবে এবং তাদের শৈশব ধরে রাখার জন্য শিক্ষকরা শিশু শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের সৃজনশীলতার মেলবন্ধন ঘটাবে।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক