শেরশে লে ফাম-মেয়েটি কই?

28

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

হেডিং দেখে নিশ্চয় বুঝে গেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের বিখ্যাত সেই রম্য গল্পটি বলতে যাচ্ছি। অবশ্য না বুঝলে সমস্যা নাই, এখন বুঝবেন বিচারকের মতি-মর্জি। ফ্রান্সে এক বিচারক ছিল, যিনি এজলাসে বসে সারাটা সময় শ্যাম্পেন-শেরি ঢেলে ঝিমাতেন, কোন উকিল কোননথি উত্থাপন করলেই লাল লাল চোখ অর্ধেকটা খুলে জিজ্ঞেস করতেন, “শেরশে লে ফাম” (মেয়েটি কই?)। বিচারক বিশ্বাস করতেন সবঘটনার পেছনেই মেয়েমানুষ আছে, মেয়ে ছাড়া এ দুনিয়ায় কোন ঘটনা ঘটে না। হাহাহাহা, বিচারকের চমৎকার বিশ্বাস।
এক গৃহনির্মাণ কর্মী ছয়তলা বাড়ির উপর কাজ করছে, বাড়ির নীচ দিয়ে সুন্দরী এক মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তাকে দেখে ছেলেটি উপর থেকে শিস দিতে লাগল। মেয়েটি তখন তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে একটি হাসি দিল, আর মাথা ঘুরে ছেলেটি নীচে পড়ে গেল। ফলে যা হবার তা হল, যদিও মৃত্যু একটি অতি দুঃখের বিষয় কিন্তু এমন মৃত্যুর ঘটনা দুঃখকে লঘু করে দেয়। সে পরের কথা, মামলাটি আলোচ্য বিচারকের আদালতে আসল। কর্মীটির মা আদালতে বললেন, গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে তাঁর ছেলে মারা গেছে। তো ভিকটিমের পক্ষের উকিল কেস নিয়ে কথা বলতে যেতেই বিচারক ঠিক একইভাবে বললেন, “শেরশে লে ফাম” (মেয়েটি কই?)। আর এ কথা শুনেই বিবাদীর উকিল তো হাতে চাঁদ পেলেন, তিনি বললেন, মি লর্ড আমাকে কয়েকদিন সময় দিন, আমি মেয়ের খবর আনছি। বিচারক দুই দিন সময় দিলেন, উকিল চলে গেল সেই গৃহনির্মাণ স্থানে। একে জিজ্ঞেস করে, তাকে জিজ্ঞেস করে, এখানে খুঁজে, সেখানে খুঁজে, একে চা খাওয়ায়, ওকে বিয়ার খাওয়ায়। একদিন গেল, দেড়দিনও পার হল, উকিলের মাথা খারাপ, কোন সূত্র যদি হাজির করতে না পারে, তবে তার ক্লায়েন্ট হেরে যাবে।
প্রচুর টাকা ক্ষতিপূরণ দিতেহবে গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য। বিকেল বেলা সেই ছয় তলায় উঠে চার পাশ দেখছে সে মাইক্রোস্কোপ, টেলিস্কোপ দিয়ে, সূত্র কই, সূত্র কই? এমন সময় এক চ্যাংড়া শ্রমিক আরেকজন শ্রমিককে বলে উঠল, দ্যাখ নিকোল, সেই ফ্রলাইন আজও নিচের পথ দিয়ে যাচ্ছে। উকিলও নিচে তাকিয়ে দেখে একটি উদ্ভিন্নযৌবনা সুন্দরী একটা মিনি স্কার্ট পরে গুট গুট করে হেঁটে যাচ্ছে সে রাস্তা দিয়ে। উকিল চ্যাংড়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মেয়েটা কি রোজ এই সময় এই পথ দিয়ে হেঁটে যায়?’ চ্যাংড়া বলল, ‘হ্যাঁ হের লইয়ার, রোজই।’ উকিল, ‘যেদিন ফারদিন, মানে ফারদিনান্দ পড়ে গিয়েছিল, সেদিনও মেয়েটি নিচের পথ দিয়ে গিয়েছিল?’ চ্যাংড়া, ‘হ্যাঁ হের লইয়ার! ফারদিন তো ওকে দেখতে গিয়েই…!’ ব্যস, উকিলকে আর পায় কে? কোর্টে প্রমাণ হয়ে গেল, শ্রমিক গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে মারা যায়নি, মরেছে মেয়ে দেখতে গিয়ে। গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষ বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। অবশ্য আদালত গৃহনির্মাণ কর্তৃপক্ষকে, নিহত শ্রমিকের মাকে মানবিক সাহায্য প্রদানের কথা বলেছিল। এই জন্য না বুঝে যখন-তখন, যেখানে-সেখানে যে-সে কথা বলে না ফেলা। ঐ চ্যাংড়া শ্রমিকের কারণে ফারদিনের মা বড় অংকের এক ক্ষতিপূরণের অর্থ হতে বঞ্চিত হল।
এ কথা সত্য, এমন একজন বিচারক থাকলে বিচারের বাণী কখনো নিভৃতে কাঁদতে পারে না, হাহাহাহা। বস্তুত সৈয়দ সাহেব আসলেই একজন গুণী ও সজ্জন ব্যক্তি। লিখনীর মাধ্যমে প্রচুর দিকনির্দেশনা তিনি মানুষকে দিয়েছেন। এখন তাহলে অনুরূপ আরেকটি গল্প শুনুন। এক কৃষক পা ভেঙ্গে ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি করে ভাংলেন?’ কৃষক, ‘পঁচিশ বছর আগে আমার নিজের জমি ছিল না।’ ডাক্তার, ‘আমি তখনের কথা বলছিনা আজ কি করে ভাঙলেন, তা বলেন।’ কৃষক, ‘সেই কথাই তো বলছি ডাক্তার সাহেব। পঁচিশ বছর আগে আমার নিজের জমি ছিল না, অন্যের জমি চাষ করতাম। একদিন সন্ধ্যার পর জমির কাজকর্ম সেরে বাড়ি এসে রাতের খাওয়া-দাওয়া করে নিজেরঘরে শুতে গেলাম। এমন সময় মালিকের সুন্দরী মেয়েটি আমার ঘরে এসে জিজ্ঞেস করে, তোমার কি আর কিছু লাগবে? আমি বললাম, লাগবে না। সে আবার বলল, তোমার জন্যে কি কিছু করতে পারি? আমি বললাম, করতে হবে না। সে পুনরায় বলে, ভাল করে ভেবে বলো। আমি এবার কিছুটা বিরক্ত হয়ে, বললাম না, লাগবে না! মেয়েটি চলে গেল, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।’
এই পর্যন্ত বলে কৃষক একটু থামল। ডাক্তার কিছুটা আশ্চর্য হয়ে, ‘কিন্তু তারসাথে আজকের পা ভাঙ্গার সম্পর্ক কি?’ কৃষক, ‘সেই তো দেখছি আপনিও বুঝতে পারলেন না ডাক্তার সাহেব। তাহলে শুনুন, আজ বিকেলে বাড়িরছাদে উঠে পায়চারি করছিলাম, আর হেঁটে হেঁটে তখন পুরানা দিনের কথাগুলা স্মরণ করছিলাম। হঠাৎ সে রাতের কথাটাও মনে পড়ে গেল, আর অমনি বুঝে ফেললাম! সাথে সাথে মাথা চক্কর দিয়ে ছাদ থেকে মাটিতে, তারপর আর কিছু মনে নেই। চোখ খুলে দেখি আমি আপনার সামনে।’ বুঝুন এবার সময়ের কথা অসময়ে বুঝলে, হয় কি দুরবস্থা, হাহাহাহা। চ্যাংড়া শ্রমিক ফারদিনের মায়ের কথা বুঝল না। তাই বলে একথা বলা যাবে না যে ফারদিনের জন্য তার সহানুভূতি ছিল না। অবশ্যই ছিল, এবং সেই কারণে সে ফ্রলাইনের কথা বলেছিল, ভেবে ছিল তা বললে ফ্রলাইনের সাজা হবে। কিন্তু হয়ে গেল হিতে বিপরীত, যেমন হয়েছে কৃষকের ক্ষেত্রে, এবং এই বিষয়টিতে পরবর্তীতে আসছি। তবে এ পর্যন্ত যা বুঝলাম, সকল অঘটনের পিছনে রয়েছে নারীর হাত। যেমন, ট্রয় ধ্বংস হয়েছে হেলেনের কারণে, জুলিয়াস সিজার আর এন্টনিও শেষ হয়েছে ক্লিওপেট্রার কারণে। সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্যে রয়েছে আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও মন্ত্রী টাকলু মুরাদ। অবশ্য মুরাদ অতি খাটাশ মার্কা, হাহাহা।
ইতিহাসে আরো আছেÑআকবরের হেরেমে মাহিমাঙ্গা, জাহাঙ্গীরের নুরজাহান, সুলতান সোলাইমানের খোররমসুলতান ওরফে আলেক্সান্দ্রা। এমন বহু উদাহরণ ইতিহাসে রয়েছে। তবে সব চাইতে বড় বিপর্যয় ঘটেছে মনে হয় ইভ কর্তৃক এ্যাডামের, এবং সেই জন্য সৃষ্টিকর্তা নাকি নারীকে সন্তান ধারণের কষ্ট প্রদান করেছেন। ঠিক আছে নারী অতি নষ্টের মূল। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতে গেলে ক্ষতি তো দেখছি আমাদেরই। কারণ আমাদের নানী-দাদী, মা-বোন, খালা-ফুফু, চাচী-মামী, স্ত্রী-কন্যা এসব সম্পর্কগুলো তো সবই অস্পৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবুন তো দাদী-নানীর আদরের কথা, মা-মেয়ের স্নেহের কথা! কি স্বর্গীয় আবেশ, কি অনাবিল শান্তি বিরাজ করছে এই সম্পর্কগুলোতে? আচ্ছা, পারিবারিক এই দিকটিতে পরে আসছি, তারাগে আরেকটি গল্প বলি শুনুন। ভাতিজা এসেছে চাচার বাড়ি বেড়াতে, সাথে এনেছে তার বউকে। চাচার সিন্দুকে টাকার বান্ডিল দেখে ভাতিজার গেল মাথাখারাপ হয়ে। সে ফাঁকে আছে কি করে টাকা হাতানো যায়। একদিন চাচা দেখেন সিন্দুকে টাকার বান্ডিল তিনটি কম। তিনি তো পড়ে গেলেন ভীষণ চিন্তায়, কে নিল টাকা? এইদিকে ভাতিজা টুপি-পাঞ্জাবী পরে, হাজীরুমাল জড়িয়ে তসবিহ্হাতে হেঁটে হেঁটে মন্ত্র জপছে; বাত্তি নাই গো, বাত্তি নাই গো কবরে, মইরা গেলে বাত্তি নাই গো কবরে।
ভাতিজার আচরণের হঠাৎ পরিবর্তন দেখে চাচার মনে খটকা লাগল, তিনি আড়চোখে ভাতিজাকে দেখতে লাগলেন। চাচার চাহনিতে ভাতিজা আরো লেফাফাদুরস্ত সেজে কান্না ভেজাঊষর কণ্ঠে চাচাকে, ‘চাচা, কবরে বাত্তি নাই ক্যান?’ চাচার বিশ্বাস এবার উর্বর হল, ভাতিজাকে তিনি, ‘কাছে আয় বলবো।’ ভাতিজা এলে, তার ঘাড়ে গেঁদে বসে পিঠে কনুইর গুঁতো মেরে চাচা, ‘টাকার বান্ডিল লুকানোর জন্য কবরে বাত্তি নাই, হারামজাদা আমার টাকা কই রাখছস বল, নইলে তোকে পুলিশে দিবো।’ ছাড় চাচা ছাড় দিতেছি দিতেছি-বলে বান্ডিল দুটি বের করে দিল ভাতিজা। বান্ডিল আরেকটা কই, জিজ্ঞেস করল চাচা। তোমার বউমার লাইগা বাজার কইরা ফেলছি। কি আর করবে চাচা তবে অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ একথা গেল বুঝা, হাহাহাহা। তাহলে এবার আসি এই যে এতক্ষণ এত কথা বলার পিছনের কারণে। সম্প্রতি পেপারে দেখলাম সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের উসখুসানি। আহা কি মিষ্টি চেহারার সেই মেয়েটি মাহমুদা খানম মিতু, আর কি আবেগঘন সেই স্ট্যাটাস স্ত্রীকে নিয়ে বাবুল আক্তারের, যেন কথাশিল্পী পরিপূর্ণ সাহিত্যিক। হায়রে বকধার্মিক তুমি যেন সাক্ষাৎ ভাতিজা। বাবুল আক্তারকে দেখলে কারাগারে এখন এরশাদের কথা মনে হয়। তিনিও তখন খালি সবকিছুর অভাব বোধ করতেন কারাগারে, হেহেহে।
সম্প্রতি জানতে পারলাম বাবুলের সাথে ভারতীয় এক নারীর কানেকশন ছিল। সেই নারীর কারণে বাবুলের আজ এ দুর্গতি। দেখুন একদম খাপে খাপ বাইন্যার মাপÑমিলে গেছে ফারদিন আর কৃষকের ঘটনার সাথে, বাইন্যা = স্বর্ণকার। তারাও নারী ঘটিত কারণে ভস্ম, বাবুলও ঐ একই কারণে ধ্বংস। আহা কি আবেগ ঘন বাবুলের স্ট্যাটাসÑআপাদমস্তক যেন সাক্ষাৎ কবি। ‘এক সুন্দর দিনে সাধারণ এক কিশোরী বউ হয়ে এসেছিল আমার জীবনে। ঘর-সংসার কী অত বুঝত সে তখন? তারপর যুগের শুরু। এককিশোরীর নারী হয়ে উঠার সাক্ষী আমি।’বাবুলের আবেগঘন স্ট্যাটাসের ক্ষুদ্রাংশ, পড়ে আমার মনে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত চরণ, ‘এ সংসারে এসেছিলেম ন-বছরের মেয়ে, তার পরে এ্ই পরিবারের দীর্ঘ গলি বেয়ে দশের ইচ্ছা বোঝাই-করা…।’ দেখুন কি অপূর্ব মিল বাবুল যেন সাক্ষাৎ কবিগুরু! তারপর তার করা চাচা-ভাতিজা মার্কা নাটক ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’ দেখে সারা দেশই যেন হতভম্ব! যেদিন মিতুর মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ হল, পত্রিকায় দেখে আমি ও আমার স্ত্রী বড়ই আফসোস করেছিলাম। কিন্তু কে জানত তার ঠিক তিন মাসের মাথায় একই ট্রাজেডি আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
মিতু যে বছর খুন হল, সে বছরের ১ সেপ্টেম্বর প্রসবকালীন জটিলতায় আমার নিভা, আমার সুন্দর মেয়েটি আমাদের ছেড়ে, এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলেগেল। আজও ১ সেপ্টেম্বর এলে আমি আর তার মা রাতের আকাশের তারাগুলোর দিকে দেখেথাকি, খুঁজি আমার মেয়ের মিষ্টি মুখখানি। তাই মিতুর ঘটনাটি আমার মনে আজও সতেজ। বাবুল যার গেছে সে বুঝে, তুই কি বুঝবি? আজ যে এত উশখুশ করছিস, আজ তোর সে ভারতীয় (মেয়েটি কই?) শেরশে লে ফাম। নানী-দাদী, স্ত্রী-কন্যা এসব সম্পর্ক মধুর চাইতেও অনেক বেশিমিষ্টি, আর বড়ই রহস্য ঘেরা বাবুল এই দুনিয়া। তুই তো তা বুঝলি না। ফলে হা-হুতাশ করে আর কি হবে? এখানে তো কোন সে বিচারক নাই যে বলবে, “শেরশে লে ফাম” আর তোমার উকিল দৌড়ে গিয়ে মেয়েটিকে খুঁজে নিয়ে আসবে, হে-হে-হে-হে!

লেখক : প্রাবন্ধিক