শূন্যপদে মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ নির্দেশনা না মানার অভিযোগ

18

এম এ হোসাইন

ইমরাত নির্মাণ নকশা অনুমোদনসহ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের পদ ‘প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ’। গত ফেব্রæয়ারিতে খালি হওয়া পদটি পেতে জোর লবিংয়ে ব্যস্ত সিডিএ’র দুই ‘নগর পরিকল্পনাবিদ’। কাক্সিক্ষত যোগ্যতা না থাকার পরও পদটি পেতে মরিয়া হয়ে আছেন তারা। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় সকলের যোগ্যতার বিষয়ে জেনে প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তিন সপ্তাহ আগের সেই নির্দেশ বাস্তবায়নে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সিডিএ। অন্যদিকে নকশা অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা গ্রাহকদের দীর্ঘসূত্রিতায় পড়তে হচ্ছে, বাড়ছে হয়রানি।
নকশা অনুমোদনের মাধ্যমে একজন ভূমির মালিক ভবন বা স্থাপনা করার অনুমতি পান। চট্টগ্রাম নগরীতে ভবন নির্মাণে নকশা অনুমোদনের একমাত্র এখতিয়ার আছে সিডিএ’র। নকশা বহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণ আইনত অপরাধ। নির্ধারিত নিয়ম মেনেই ভবন নির্মাণে নকশা অনুমোদন দেয়ার কথা সংস্থাটির। নকশা অনুমোদনের এখতিয়ার থাকা সিডিএ’র ‘নগর পরিকল্পনা’ বিভাগের গোড়ায় গলদ রয়েছে। বাণিজ্যে জড়িয়ে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই নকশা অনুমোদনের অভিযোগ আছে এই বিভাগের বিরুদ্ধে। বিষয়টি ওপেন-সিক্রেট হলেও এই বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংস্থাটি। উল্টো দুর্নীতিবাজ হিসাবে চিহ্নিতদের এই বিভাগে রাখার লড়াইয়ে নেমেছে।
সূত্র মতে, ২০২০ সালের ১ অক্টোবর এক অফিস আদেশে সিডিএ’র উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম খানকে ‘প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ’-এর চলতি দায়িত্ব এবং নগর পরিকল্পনাবিদ-২ মো. আবু ঈসা আনছারীকে উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (ভারপ্রাপ্ত) এর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অবসরে চলে যান মো. শাহীনুল ইসলাম খান। ফলে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের পদটি খালি হয়ে পড়ে। উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে কয়েক বছরের চলতি দায়িত্ব পালনকারী কোনো কর্মকর্তাকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে আসছিল সিডিএ। কিন্তু উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসাবে ‘চলতি দায়িত্বে’ সিডিএতে কোনো কর্মকর্তা নেই। তাছাড়া পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে (এমইউআরপি) বা তদুর্ধ্ব ডিগ্রিধারীর এ পদটির জন্য সিডিএ’র পরিকল্পনা বিভাগে কোনো লোক না পাওয়াতে শেষে মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়। এরই মধ্যে সমপর্যায়ের (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) পদের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে ভারপ্রাপ্ত হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রায় দুইমাস ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব নিয়ে নগর পরিকল্পনা বিভাগকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন তিনি। আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন শুরু করেন, বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনায় উচ্ছেদ অভিযানও চালান। আসতে শুরু করে শৃঙ্খলা। এরই মধ্যে হাসান বিন শামসকে সরিয়ে সেখানে নির্বাহী প্রকৌশলী মনজুর হাসানকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের দায়িত্ব দেয় সিডিএ। এখানেই শেষ নয়, উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আবু ঈসা আনছারী প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের পদ পেতে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। মনজুর হাসান ও আবু ঈসা আনছারী দু’জনেই নির্বাহী প্রকৌশলী পদ মর্যাদার পদে নিয়োজিত আছেন। দুই ধাপ উচ্চপদের জন্য দৌড়াচ্ছেন তারা। অথচ তাদের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে (এমইউআরপি) ডিগ্রিও নেই বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে সিডিএ কার্যালয়ে গিয়েও কথা বলা সম্ভব হয়নি চেয়ারম্যান এম. জহিরুল আলম দোভাষের সাথে। পরবর্তিতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
কথা হলে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, বাইরে ও সিডিএ থেকে যোগ্য লোক না পাওয়াতে আপদকালীন সময়ে প্রধান প্রকৌশলীর সমপর্যায়ের পদ হিসাবে আমাকে (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্ব দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের আদেশ পেয়ে আমি যোগদানপত্র জমা দিয়েছি। এখন বাকি সিদ্ধান্ত অফিস নিবে।
সিডিএ’র বিদায়ী প্রধান নগর-পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে যান। এরপর সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু হাসান বিন শামস ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে গেলে গত ৭ জুলাই নির্বাহী প্রকৌশলী মোহা. মনজুর হাসানকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ অবস্থায় বিধিমালা ভঙ্গের অভিযাগ করে সিডিএকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)। বিআইপি দাবি করে, পদটি পূরণে পদোন্নতির ক্ষেত্রে উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে কমপক্ষে দশ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু সিডিএতে এ ধরনের কোনো কর্মকর্তা নেই। এ অবস্থার মধ্যে উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (ভারপ্রাপ্ত) আবু ঈসা আনছারী মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। চলতি বছরের ২৮ জুলাই এক পত্রের মাধ্যমে মন্ত্রণালয় মো. আবু ঈসা আনছারী বর্তমানে কোন পদে দায়িত্ব পালন করছেন এবং তার প্রেরিত আবেদনপত্রের বিষয়ে সাত কর্মদিবসের মধ্যে মতামত প্রদান করতে বলা হয়। সেই পত্রের জবাবে ২ আগস্ট সিডিএ সচিব আনোয়ার পাশা স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়,‘ মো. আবু ঈসা আনছারী ২০/১১/২০০৮ তারিখে নগর পরিকল্পনাবিদ পদে যোগদান করেন এবং উক্ত পদে কর্মরত আছেন। গত ০৪/১০/২০২০ তারিখে তাকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে উপ-প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এর (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এছাড়াও তিনি চট্টগ্রাম শহরের মাস্টার প্ল্যান প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত আছেন এবং বর্তমানে এই প্রকল্পের কাজ চলমান আছে।’ এই পত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘মোহা. মনজুর হাসানকে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এর ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে’। লোভনীয় পদটির দায়িত্ব পেতে যখন দুই কর্মকর্তা দৌড়ের মধ্যে আছেন তখনই গত ১১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এর (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করার কথা বলা হয়।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে একটি পত্র দেন। সেই পত্রে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বর্তমানে সিডিএ‘তে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে (এমইউআরপি) বা তদুর্ধ্ব ডিগ্রিধারী জ্যেষ্ঠ নগর পরিকল্পনাবিদ না থাকায় প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কাজ চালাতে হচ্ছে। এতে করে উচ্চতর পেশাদারীত্বের অভাবে মাস্টার প্ল্যান ও ড্যাপ প্রণয়ন, সংরক্ষণ, ভ‚মি ব্যবহার, ছাড়পত্র প্রদান এবং ইমরাত নির্মাণ নকশা অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি হচ্ছে।’