শুষ্ক মৌসুমে বাড়ছে বায়ুদূষণের মাত্রা এখনই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন

14

 

দেশে সারা বছর বায়ুদূষণের বিষয়টি আলোচনায় থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে এ দূষণ আরো বেড়ে যায়। বিশেষ করে এ সময়ে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এবং স্থাপনা, সড়ক অবকাঠামো নির্মাণসহ ব্রিক ফিল্ডগুলো ইট উৎপাদনের ফলে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পায়। যা পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এ বায়ুদূষণ মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব কিছু নয়, যদি পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক উদ্যোগ থাকে। কিন্তু লক্ষ করা যায়, সব উদ্যোগ কথার মধ্যেই সীমিত থাকে তবে কার্যকর হয় না। আমরা জানি, রাজধানী ঢাকায় বায়ুদূষণ সর্বোচ্চ মাত্রা অতিক্রম করেছে। ফলে এটিকে এখন বাসযোগ্য নগরী বলা হয় না। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সাগর, নদী ও পাহাড়ের সবুজ বেষ্টনির কারণে এ চট্টগ্রাম এখনো কিছুটা হলেও বাসযোগ্যতায় থাকলেও সম্প্রতি মাত্রাতিরিক্ত পরিবেশ দূষণের খবর নগরবাসীকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এ অবস্থা থেকে দ্রæত উত্তরণের পদক্ষেপ এখনই নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি আমরা।
আমরা জানি, বায়ুদূষণের অনেকগুলোর উৎসের অন্যতম হচ্ছে ধুলাবালি। নির্মাণকাজের কারণে বাতাসে প্রচুর ধুলাযুক্ত হয়। যানবাহনে ব্যবহƒত জ্বালানিও অন্যতম কারণ। এছাড়া বর্জ্য পোড়ানোর কারণে দূষিত হচ্ছে বাতাস। শিল্প কারখানার ধোঁয়া এবং রাজধানী ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের কারণে দূষণ কমানো যাচ্ছে না। শহর ও আশপাশের এলাকায় যেখানে-সেখানে ময়লার স্তূপ থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ সপ্তাহের শুরুতে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে মারা যাচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। ২০১৯ সালে দেশে বায়ুদূষণে সর্বোচ্চ ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত শহর হিসেবে চিহ্নিত হয়। গবেষকদের মতে, দূষণের মাত্রা কমানো গেলে বাংলাদেশের মানুষ আরো ৫ দশমিক ৪ বছর বেশি বাঁচতেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার কারণে শুধু ঢাকায় বসবাসকারীদের গড় আয়ু কমেছে ৭ দশমিক ৭ বছর। রাজধানী ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কেবল স্বাস্থ্য নয়, জিডিপির ক্ষতিও হচ্ছে ৩.৯-৪.৪ শতাংশ। শ্বাসকষ্ট, কাশি, নিম্ন শ্বাসনালির সংক্রমণ ও বিষণœতার ঝুঁকি বাড়ছে মানুষের। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংক ও গবেষকদের পর্যবেক্ষণকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। জনস্বার্থে দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। ঢাকা দীর্ঘদিন ধরেই বায়ুদূষণ সমস্যায় জর্জরিত। ঢাকার বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে উন্নত হয়। এর আগে গত বছরের ২৩ অক্টোবর ঢাকার বাতাসের গুণমান সূচক (একিউআই) ১৫৯ রেকর্ড করা হয়েছিল। তখন ঢাকাকে বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ঢাকাসহ প্রধান প্রধান নগরগুলোতে বায়ুদূষণের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তার মধ্যে তিনটি কারণ প্রধান। যাতে সারাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ছে। সেগুলো হলো ইটভাটা, মোটরযানের কালো ধোঁয়া ও যথেচ্ছ নির্মাণকাজ। জানা যায়, ২০১৩ সালে দেশে মোট ইটভাটার সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৯৮৫টি। ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৯০০টিতে। এর মধ্যে ঢাকার আশপাশেই রয়েছে ২ হাজার ৮৭টি। প্রতি মুহূর্তে এসব ইটভাটার ধোঁয়ায় বিষাক্ত হয়ে উঠছে ঢাকার বাতাস। শুষ্ক মৌসুমে ৫৮ শতাংশ বায়ুদূষণের পেছনে দায়ী এসব ইটভাটা। গত পাঁচ দশকে বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরে সুউচ্চ ভবন ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ৭৫ শতাংশ চাষযোগ্য জমি হারিয়ে গেছে। এছাড়া নন-কমপ্লায়েন্স শিল্প ও অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে শহরের বাতাস এবং ভূপৃষ্ঠের পানি দূষিত হচ্ছে। বায়ুদূষণের উপাদানগুলো মূলত ধূলিকণা, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রো কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সিসা ও অ্যামোনিয়া। অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা স্থাপনে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ ক্রমাগত বাড়ছে। ক্ষতিকর উপাদানগুলোর ব্যাপকহারে নিঃসরণ ঘটছে। এ কারণে বিশেষ করে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে বিঘ্ন ঘটা ও স্নায়ুবিক ক্ষতি হতে পারে এবং গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সুস্থ থাকতে ও বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে হলে বায়ুদূষণ কমানোর বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগসহ জনসাধারণের সহযোগিতা ও সচেতনতা প্রয়োজন। এ সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।