শুরু হলো আঁচলের যুদ্ধ

19

দীপান্বিতা

নিজের সাথে নিজের।সে হার মানবে না অনিকেতের কাছে। কিছুতেই না।
আরে দুটো মেয়ের মা তো হয়েই গেলাম।সবার কপালে কি আর সব সুখ থাকে।এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল আঁচল।ছয় বছরের অর্চনা আর অর্পনা ও ঘুমিয়ে পড়েছে।ওরা টুইন।
এটা নিয়ে ও অনিকেতের অনেক ক্ষোভ। দুটিই মেয়ে সন্তান বলে।
হঠাৎ মাঝরাতে গ্লাস পড়ার শব্দে ঘুম ভাঙলো আঁচলের।অর্চনার মাথাটা বালিশে তুলে দিয়ে ওয়াশরুমে গেল। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো অনিকেত বিছানায় নেই। আঁচলের আবার মন খারাপ হলো।ইদানীং অনিকেত প্রায়ই মাঝরাতে ছাদে চলে যায়। বৌ এর অক্ষমতা মানতে কষ্ট হয় হয়তো তাই খোলা নীলের নীচে বসে থাকে।
আজ আঁচলের মনে হলো এ বিষয়ে ওর সাথে কথা বলা দরকার। এখন তো চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক উন্নত।তার সমস্যার চিকিৎসা হবেনা কেন?
অনেক সময় বেশি বয়সে বেশি হলে সেক্স পাওয়ার নিয়ে প্রবলেম হতেই পারে।কিন্তুু চিকিৎসা ও থাকবে ত।
এমনটাই ভাবতে ভাবতে ডাইনিং টেবিলে গ্লাসটা তুলে রেখে ছাদে চলে গেলো।
অনিকেত!
এই অনিকেত!
না কোনো সাড়া মিললো না। আঁচল পুরো ছাদে খুঁজল। অনিকেত তো এখানে নেই।
আঁচল ভাবল, তাহলে ও কোথায়?
ও কি তবে রোজ এ সময়ে ছাদে আসেনা!
তবে কোথায় যায়?
আঁচল নিচে নেমে গেল। শোয়ার রুমে ঢুকতেই দেখলো অনিকেত শুয়ে আছে।ঘুম।
আজব! এতক্ষণ ছিল টা কোথায়?
কেমন যেন লাগলো ব্যাপারটা।
থাক।রাত সাড়ে তিনটার সময় ওকে আর এ নিয়ে বিরক্ত করা ঠিক হবেনা।কাল সকালে কথা বলে নেব।এই ভেবে, পর্না আর অর্চনা কে জড়িয়ে ধরে ঘুম ধরে গেল আঁচল।
পরদিন সকালবেলা।
রুটি সবজি আর কলা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সাজালো।পর্নাকে আর অর্চনা কে খাওয়াতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল হল কুসুম পুরো জামাটাই উল্টো পড়ে আছে।
কুসুম আঁচলদের ঘরে কাজ করে। পর্না আর অর্চনার জন্যই ওকে রাখা হয়েছে।
আঁচল ঃ কিরে কুসুম! তোর গায়ের জামাটা উল্টো কেন?
মাথা ঠিক আছে তো?কুসুমের মুখ দেখে মনে হলো বিশাল একটা অপরাধ করে ফেলেছে সে।
কুসুমঃ না বৌদি। সাবান কম দেয়ার জন্য উল্টো পড়েছি।
আঁচল ঃ কথাটা শুনে আমার এমন হাসি পেল। থাক্ সোনা তোমাকে আর সাবান বাঁচাতে হবেনা।
জামাটা ঠিক করে গায়ে দিয়ে আয়।
কুসুম চলে গেল জামা পাল্টাতে।
একটু পর অনিকেত এল ব্রেকফাস্ট টেবিলে।একেবারে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে।আঁচল অনিকেতের প্লেটে। সবজি আর রুটি দিল।
অনিকেত খাওয়া শুরু করলো। আঁচল ভাবছে ডাক্তার দেখানোর কথাটা এখন তুলবে কিনা?
আর একটু পর।ও খেয়ে নিক।অনিকেতের মেজাজটা বড় গরম।
অনিকেতের খাওয়া প্রায়। শেষের দিকে। আঁচল বলল,কাল রাতে তুমি কোথায় ছিলে?অনিকেত কাল রাতেই আন্দাজ করেছে এটা নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠবে।
তাই উত্তর টাও রেডি করে রেখেছে।
অনিকেতঃ আমি কাল রিডিং রুমে ছিলাম। এ মাস অডিট চলছে। অনেক হিসেবের কাজ। তাই করছিলাম।
আঁচল ঃ ও ও।
আঁচল ঃ আমরা কি একটা ডাক্তার দেখাতে পারিনা?
অনিকেতঃ কোন ব্যাপারে ঠিক?
আঁচল ঃ তুমি জান অনি আমি কি প্রসঙ্গে বলছি।
অনিঃ, ও। দেখাবে আর কি আস্তেধীরে। অত তাড়া কিসের? তাছাড়া আমি এখন তোমাকে সময় দিতে পারবনা।
তুমি নিজে নিজে গিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে এসো।
আঁচল ঃ কেন এমন করছ অনিকেত?
তোমার তো কষ্ট হচ্ছে আমি জানি।তার চেয়ে চিকিৎসায় সব সমাধান সম্ভব।
অনিঃ আমার সমস্যা হচ্ছে কে বললো?এত কাজে এসব আর ভালো লাগে না।
আমার দেরী হচ্ছে। আমি গেলাম।
অর্চনা আর অর্পনা কে নিয়ম করে আদর করাটা যেন ভুলেই গেল অনিকেত।ওদের ভাই নেই।এটাই ওদের অপরাধ।
এমন করে কাটলো আর এক সপ্তাহ। পরের সপ্তাহের সোমবার রাতে আবার আঁচলের ঘুম ভেঙে গেল।তবে কোন আওয়াজে নয়। অর্চনা ওয়াসরুমে যাবে বলল।তাই।
যথারীতি অনিকেত বিছানায় নেই।অর্চনাকে শুইয়ে দিয়ে রাত দুটোর সময় আঁচল গেলো রিডিং রুমের দিকে। আঁচলের খুব মায়া হলো অনিকেতের উপর।ভাবলো আজ সারারাত অনিকেতের সাথে রিডিং রুমেই কাটাবে।
এই ভেবে রিডিং রুমের দিকে যেতেই রান্নাঘর থেকে খুব বাজে একটা শব্দ কানে এলো।কিন্তুু রান্নাঘরে তো শুধু কুসুম থাকে।
কিচেনের দরজা টা সরাতেই চোখে যা পড়লো তাতে আঁচল থ।বর কে নিয়ে দেখা তার স্বপ্ন গুলো মিথ্যে হলেও এতটা মিথ্যে হবে সে কল্পনাতেও আনেনি।
নীরবে বিছানায় গিয়ে কাঁদতে লাগলো।
খুব ঘেন্না হতে লাগলো নিজের উপর।অনি ওকে ডাক্তার দেখিয়ে ট্রিটমেন্টের কথা ভাবেনি।কিন্তুু সোজা রাস্তা টা বেছে নিল।
খুব ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কান্না করি।কিন্তুু পারছে না।
কি করবে এখন আঁচল?
অনি কে ডিভোর্স দেবে?
তবে মেয়ে দুটোর ভবিষ্যৎ?
বাবার ওদিকে ত তেমন কেউ নেই আঁচলের। বুড়ো মা। ভাই নেই। মারা গেছে। আর এক বোন।সে ও বাইরে।
বালিশ ভিজতে ভিজতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে আঁচল।
পরদিন সকালবেলা।
অনিকেত কে কিছু বলার রুচিতে ধরছেনা।
আবার ভাবলো। কুসুমকে বের করে দেবে?
কি লাভ? আরও কত কুসুম আসবে।
অনিকেত অফিস যাওয়ার পর কুসুমকে ডাকলো।তখন ও মুখে কিছু দেয়নি আঁচল। মেয়ে দুটোকে খাওয়ালো শুধু।
আঁচল ঃ কুসুম এদিকে এসো।
তোমার দাদা রোজ রাতই তোমার ঘরে যায়।
কুসুম আঁচলের পা ধরে কেঁদে উঠলো।
ওর ভাষায় বুঝা গেল।প্রথমে ওর ইচ্ছে ছিলনা।এখন অনির অভ্যাসের কাছে হার মানছে রোজ।
কুসুম কে এক সপ্তাহের জন্য বাড়িতে পাঠিয়ে দিল।
তারপর অনিকেতের অত্যাচার থেকে আঁচল কে কেউ বাঁচাতে পারেনি। প্রতিটা অঙ্গে বেতের বারি উপহার দিয়েছে আঁচলকে।
কুসুম ও আর আসেনি।
নতুন একটা মেয়ে এসছে গীতা।এমন কাজের লোকের আকালে অনি মেয়ে গুলোকে কোথায় পায় কে জানে।
এমন করে চলছিল আঁচল আর তার দুই মেয়ের বড় হওয়া।
উনিশ বিশ হলেই অনি বলে উঠে তুই মরে যেতে মেয়ে গুলোকেও নিয়ে যাবি।
মাস ছয়েক পর।
আঁচল হালকা পাতলা নার্সিং এর কাজ সেরে বাসায় ঢুকল। পর্না আর অর্চনা তখনও স্কুলে।
ইস! কি রক্ত ড্রইংরুম জুড়ে। রান্নাঘরেও তাই।গীতার রানের গোড়া থেকে রক্ত পড়ছে ভীষণ। মেয়েটা যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে।
অনিকেত ব্যান্ডেজ তুলো নিয়ে ঢুকল হুড়মুড় খেয়ে। আঁচলের যা বুঝার বুঝল। অনিকেতের দিকে তাকায় না সে অনেকমাস।
আঁচল বলল ওকে দ্রæত ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। নয়তো বাঁচবে না।
অনিকেত বললো, না ওকে ডাক্তারের কাছে নিলে উনিশ বিশ হলে পুলিশ কেস হবে।তুমি ত পার সেলাই করতে।
প্লিজ তুমি হেল্প কর।
আঁচল অবাক হয়ে গেলো। কি রুচি অনিকেতের।
সেদিল আঁচল পারেনি মুখ ফিরিয়ে নিতে।আমরা মেয়েরা পারিনা বরের বিপদে চুপ থাকতে।
আঁচল নিজ জ্ঞানে যতটুকু সম্ভব গীতার রান টা সেলাই করে দিল।তারপর পরে ডাক্তার দেখিয়ে ওকে সুস্থ করে বাড়িতে দিয়ে এলো।
ঐ গীতাও যাওয়ার সময় অনিকে বলে গেল,
আপনি দিদির জামাই হওয়ার যোগ্য না।
বিশ বছর পর।
অনিকেত এখন মানসিক হুইল চেয়ারে বসে বসে দিন গুনছে।আঁচলের রেখে যাওয়া সামান্য কিছু জমা দিয়ে তার জীবন চলছে।অথচ এই অনিকেত ই আঁচল কে বলেছিল যদি কখনও কোটিপতি হই তবে তুই কালো মেয়েকে ডিভোর্স দেব।
আজ আঁচল নেই।তবে আঁচলের দুই মেয়েই সরকারি কর্মকর্তা।তারা ও অনিকেতের দেখাশোনা করে।তবে অনিকেত প্রতি পদে ভুগছে কারন এখন আর তার সে হাঁকডাক কেউ পাত্তা দেয়না। উল্টে সবার গালের বারি সইতে হয়।
বড় মেয়ে অর্চনা বলে, -এটাই তোমার প্রাপ্য বাবা।
আমার মা জিতেছে তোমার কাছে।
তুমি হেরেছ ভীষণ ভাবে।
আসলে অনিকেত প্রায় আঁচল কে খোঁটা দিয়ে বলতো
পেটে ত ছেলে ধরনি। সারাজীবন পরের তুল্য হয়ে থাকতে হবে।
আমাদের সমাজে অনিকেতের মত মানুষের অভাব নেই। ঐ সব পুরুষ বুঝেনা যে, পৃথিবীতে কোন কিছুই কারো জন্য থেমে থাকেনা। সব দরজা বন্ধ হলেও বিধাতার দরজা খোলা থাকে তার ভক্তদের জন্য।
অনিকেত চেয়েছিল মেয়েদের অল্প পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দিতে।কিন্তুু আঁচল হাল ছাড়ে নি।সে মেয়েদের কে আগে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এত কষ্টের ভেতরেও।
তাই অবশ্যই আঁচল রতœগর্ভা।
রতœগর্ভা আঁচল।