শুভ নববর্ষ ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’

193

 

সময়ের চাকা ঘুরে বছর শেষে আবারও আমাদের দ্বারপ্রান্তে বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ মানেই বৈশাখ। যাকে দিয়ে সূচনা নতুন বছরের। এর সঙ্গে বিদায় হলো ঘটনাবহুল আরও একটি বছরের। শুরু হলো বছর ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। পহেলা বৈশাখ আবহমানকাল ধরে বাঙালির কাছে চিরায়ত আনন্দের দিন, খুশীর দিন। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আজকের দিনটি নতুন প্রভাত নতুন প্রাণের বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে বাঙালির ঘরে ঘরে। দেশব্যাপী ধর্মবর্ণনির্বিশেষে আজ মানুষের ঘরে ঘরে জাগবে নতুন প্রাণের স্পন্দন। শুরু হলো নতুন আশা ও উদ্দীপনার নতুন বছর। নতুন বছর সবার জন্য মঙ্গলময় হয়ে উঠুকÑএই প্রত্যাশা আমাদের। বাস্তবতা হচ্ছে আবহমান কাল ধরে এই নববর্ষ বাঙালির জীবন-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বিগত দুই বছর মহামারি করোনার কারণে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা সম্ভব হয়নি। এবছর অবস্থার উন্নতি ঘটেছে, সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছে তবে, নানা আয়োজনে আজকের দিনটি ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালন হওয়ার কথা থাকলেও পবিত্র রমজান মাস যেহেতু, ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যের প্রতি সদয় দৃষ্টি রেখে কর্তৃপক্ষ সংক্ষিপ্ত পরিসরে এবং দিনের প্রথম প্রহরে নির্দিষ্ট জায়গায় বর্ষবরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ধর্মপ্রান মুসলমানসহ সকলেই রমজান মাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে দিনটি পালন করবে এমন প্রত্যাশা সকলের।
সারাবিশ্বের অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও নাগরিক জীবনের এবং সরকারি কর্মকাÐের সবকিছু চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসাবে। তারপরও বাঙালির গভীর মানসে বাংলা নববর্ষের স্থান অনেক উঁচুতে। বাঙালির মনপ্রাণজুড়ে রয়েছে বাংলা নববর্ষ। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, জেলে-তাঁতী, কামার-কুমারসহ নানা পেশার মানুষ যুগ যুগ ধরে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে আসছে আনন্দ-উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে। ব্যবসায়ীরা এখনও চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন কওে পুরনো হিসাবের ইতি ঘটান আর হিসাবের নতুন খাতা-হালখাতা খোলেন বৈশাখের প্রথম দিনে। এ জন্য মিষ্টান্নসহ নানাধরণের ভোজের আয়োজন থাকে। নববর্ষ উপলক্ষে দেশে গ্রামেগঞ্জে নদীর পাড়ে, খোলা মাঠে কিংবা বটগাছের ছায়ায় মেলার আয়োজন করা হয়। দোকানিরা মুড়ি, মুড়কি, পুতুল, খেলনা, মাটির তৈরি হাঁড়ি-পাতিল, বাঁশিসহ বাঁশ- বেত-কাঠ-মাটির তৈরি বিভিন্ন পসরা নিয়ে বসেন।
আমাদের নাগরিক জীবনেও নববর্ষের আবেদন কম নয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকেই ছায়ানটের উদ্যোগে রমনার বটমূলে বৈশাখের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈশাখ বরণ উৎসব শুরু হয় মহাসমারোহে। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের চারু কলার উদ্যোগে বৈশাখী র‌্যালীর আয়োজন করা হয়। রঙবেরঙের মুখোশ পরে নানা সাজে সজ্জিত হয়ে র‌্যালীতে অংশ নেয় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। সকাল না হতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি চত্বরসহ গোটা রমনা অঞ্চল মুখরিত হয়ে ওঠে বৈশাখ উপলক্ষ্যে ফ্যাশন হাউসগুলোতেও থাকে নানা আয়োজন। চট্টগ্রামও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানে ডিসিহিল, সিআরবি, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, পতেঙ্গা সৈকতে, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে, পার্বত্য জেলার প্রতিটি জনপদে বর্ষবরণে চলে নানা আয়োজন। পত্রিকাগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ইলেকট্রনিক মিডিয়াও বৈশাখের নানা আয়োজনে ব্যস্ত থাকে।
এভাবে বৈশাখ আসে আমাদের প্রাণের উৎসব হয়ে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কথিত আছে, মোগল সম্রাট আকবর এ বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আরবি হিজরি সনের সাথে সমন্বয় করে কৃষি ব্যবস্থায় আর্থিক লেনদেনে শৃঙ্খরা ফেরানোর জন্য এ সন প্রবর্তন করা হয়েছে বলে ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়। সঙ্গতকারণে বাংলা সনের উৎপত্তির সঙ্গে জড়িত এই দেশের সংস্কৃতির জীবনধারা এবং প্রকৃতির অবস্থার সঙ্গে ফসলের মৌসুম এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন তারিখ তথা পঞ্জিকার প্রবর্তন হলেও এ নববর্ষ উৎসব বাঙালির চিন্তা-চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে। এটা এমন একটা উৎসব যাকে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীসহ সকলেই সর্বজনীনভাবে প্রাণের আনন্দে বরণ করে নেয়।
বাংলা নববর্ষ অসুর দূর করে সুর সঙ্গীতের, মেলা ও মিলনের আনন্দ ও উৎসবের, সাহস ও সংকল্পের প্রেরণা যোগায়। দুঃখ-গ্লানি, অতীতের ব্যর্থতা পেছনে ফেলে তাই এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়ার দিনও পহেলা বৈশাখ। দেশের কল্যাণে সকলেই এক কাতারে শামিল হয়ে এগিয়ে যাওয়ার কঠিন শপথ নেওয়ার দিন আজ। কবির ভাষায়, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বাঙালি জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক পরিচয় বৈশাখের চেতনায় উজ্জীবিত হোক পুরো জাতি। দৈনিক পূর্বদেশের পক্ষ থেকে সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। স্বাগতম ১৪২৯।