শুভ জন্মাষ্টমী রসামৃত

36

রূপম চক্রবর্ত্তী

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, হে অর্জুন! যিনি আমার এই অলৌকিক জন্ম ও কর্ম যথার্থভাবে বোঝেন, তিনি শরীর পরিত্যাগ করিয়া পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন না, আমাকেই লাভ করেন। ১২৫ বছর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে লীলা আমাদের দেখিয়েছেন তাঁর রসামৃত আমাদের জীবনকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করছে। তাই প্রতি বছর ভাদ্রের জন্মাষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি পালনের জন্য বিশ্বের কোটি কোটি নরনারী অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন। মানব জীবনে শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হচ্ছে মুক্তি এবং পাপ থেকে বিরত থাকা। পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় মানব জীবনের মুক্তির ও পাপ মুক্ত হওয়ায় নির্দেশ দিয়ে গেছেন। তাঁর দিব্য জন্ম মানবতার বিশ্ব গড়ে সুন্দর ও সুখময় জীবনযাপনের নির্দেশনা দিয়ে গেছে। শ্রীকৃষ্ণের আগমন শিক্ষা এবং আধ্যাত্ম ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সম্পর্কে আজও লাখ লাখ মানুষ অবহিত নহে। দ্বাপর যুগে ভগবান কৃষ্ণের আগমন অনেক ক্ষেত্রে দ্বৈত আর অদ্বৈত বাদের বেড়াজালে আবদ্ধ। ভজন পূজনে আর ভক্তিতে পুরুষাণুক্রমিক চলে আসছে। কেউ বলছেন কৃষ্ণ অবতার আবার কেউ বলছেন ভগবান। কিন্তু ধর্ম ভগবান আর অবতার তত্ত¡ অত্যন্ত কঠিন শব্দ। হিন্দু ধর্মের নাম সত্য সনাতন ধর্ম। যাহা অতীতে ছিল বর্তমানে আছে ভবিষ্যতেত্ত থাকবে। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় এ ধর্ম বৈদিক বা বৈদান্তিক ধর্ম। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে জানতে নানা বৈদিক শাস্ত্র জ্ঞান অবহিত হওয়া প্রয়োজন। আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে দ্বাপর যুগে এই দিনে এক বৈরী সমাজে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের উদ্দেশ্যে নিরাকার ব্রহ্ম বসুদেব ও দেবকীর সন্তান হিসেবে পৃথিবীতে ভ‚মিষ্ঠ হয়েছিলেন। দ্বাপর যুগে ওই সময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ছিল। কতিপয় রাজা রাজধর্ম, কুলাচার, সদাচার ভুলে গিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যায়, অবিচারে মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। মথুরার রাজা কংস পিতা উগ্রসেনকে উৎখাত করে নিজে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। একই রকম ত্রাসের শাসন চালিয়েছিলেন জরাসন্ধ, চেদিরাজ, শিশুপাল-সহ অনেক রাজা। রাজা জরাসন্ধ একাই ৮৬ জন যুব রাজাকে বলি দেওয়ার জন্য কারাগারে রেখেছিলেন। এ ছাড়া হস্তিনাপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন দুর্যোধন-দুঃশাসন। এ হেন অধর্ম-অবিচার নির্মূল করে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রীকৃষ্ণরূপে ভগবানের মর্তে আগমন। তাই শ্রীকৃষ্ণ মর্তে এসে একে একে কংস, শিশুপাল, জরাসন্ধ ও কৌরবদের দর্পচ‚র্ণ করে, তাঁদের পাপসৌধ ধ্বংস করে ধর্মরাজ্য স্থাপন করলেন।
যমুনা নদীর তীরে ঘনজনসংখ্যা বিশিষ্ট শহর মথুরায় রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি। দেশের রাজধানী দিল্লি থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মথুরা নগরী। মথুরার মধ্যিখানে অবস্থিত শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দির। এখানেই প্রচÐ অত্যাচারী রাজা কংসকে নিধন করে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। দ্বাপর যুগে অধর্মের নাশ করে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। মথুরায় অন্য সব মন্দিরের মধ্যে কৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দিরে পূণ্যার্থীদের ভিড় থাকে সবচেয়ে বেশি। কৃষ্ণের জন্মদিনটি কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী বা জন্মাষ্টমী নামে পালিত হয়। কৃষ্ণ যাদব-রাজধানী মথুরার রাজপরিবারের সন্তান। তিনি বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম পুত্র। তার পিতামাতা উভয়ের যাদববংশীয়। দেবকীর দাদা কংস তাদের পিতা উগ্রসেনকে বন্দী করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। একটি দৈববাণীর মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন যে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানের হাতে তার মৃত্যু হবে। এই কথা শুনে তিনি দেবকী ও বসুদেবকে কারারুদ্ধ করেন এবং তাদের প্রথম ছয় পুত্রকে হত্যা করেন। দেবকী তার সপ্তম গর্ভ রোহিণীকে প্রদান করলে, বলরামের জন্ম হয়। এরপরই কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন।
শ্রীকৃষ্ণের জন্মের রাত ছিল গভীর অন্ধকার। তাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে বসুদেব দেখলেন শিশুটি চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করে আছেন। দেখে তিনি বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গলার্থে পূর্ণরূপে নারায়ণ তাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। বসুদেব করজোড়ে প্রণাম ও বন্দনা করলেন এবং পরে দেবকীও প্রার্থনা করলেন। শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করলেন। কৃষ্ণের জীবন বিপন্ন জেনে জন্মরাত্রেই কারাগার থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বসুদেব তাকে গোকুলে তার পালক মাতাপিতা যশোদা ও নন্দের কাছে রেখে আসেন। কৃষ্ণ ছাড়া বসুদেবের আরও দুই সন্তানের প্রাণরক্ষা হয়েছিল। প্রথমজন বলরাম (যিনি বসুদেবের প্রথমা স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন) এবং সুভদ্রা (বসুদেব ও রোহিণীর কন্যা, যিনি বলরাম ও কৃষ্ণের অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেন)। ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী, কোনো প্রকার যৌনসংগম ব্যতিরেকেই কেবলমাত্র ‘মানসিক যোগের’ ফলে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, সেযুগে এই ধরনের যোগ সম্ভব ছিল। বসুদেব বারবার সেই শিশু কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন এবং ভাবতে লাগলেন কিভাবে তাঁর এই পরম সৌভাগ্যের মুহুর্তটি তিনি উদযাপন করবেন। তিনি ভাবলেন, ‘সাধারণত যখন পুত্রসন্তানের জন্ম হয়, মানুষ তখন মহোৎসব করে, আর পরমেশ্বর ভগবান আজ আমার গৃহে আমার সন্তানরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। কত মহা আড়ম্বরে আমার এই উৎসব পালন করা উচিত।’ বসুদেব, যাঁর আরেক নাম আনকদুন্দুভি, যখন তাঁর নবজাত শিশুটির দিকে তাখিয়ে দেখলেন, তখন তাঁর হৃদয়ে আনন্দে এত উৎফুল্ল হয়ে উঠল যে, তিনি তখন নানা অলঙ্কারে ভূষিত হাজার হাজার গাভী ব্রাহ্মণদের দান করতে ইচ্ছা করলেন। বসুদেবের মনে আর যখন কোন সংশয় রইল না যে, এই নবজাত শিশুটিই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, তখন তিনি করজোড়ে প্রণিপাত করে তাঁর বন্দনা করতে শুরু করলেন। বসুদেব তখন চিন্ময় স্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে কংসের ভয় থেকে মুক্ত হলেন। সেই শিশুটির অঙ্গকান্তিতে সেই ঘর উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
কৃষ্ণের খোঁজ পাওয়া গেলে কংস পুতনা নামক এক রাক্ষসীকে পাঠান শিশুকৃষ্ণকে হত্যা করতে। পূতনা যখন শিশু শ্রীকৃষ্ণকে তার কোলে তুলে নিচ্ছিল, তখন রোহিণী এবং যশোদা উভয়েই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা তাকে নিষেধ করেননি, কেননা সে এত সুন্দর সজ্জায় ভূষিতা ছিল আর তা ছাড়া শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সে যে বাৎসল্য স্নেহ প্রদর্শন করেছিল, তাতে তাঁদের মনে কোন সন্দেহ স্থান পায়নি। তাঁরা বুঝতে পারেননি যে, সে একটা সুন্দর খাপে ঢাকা তলোয়ার। পূতনা তার স্তনে অতি তীব্র বিষ লাগিয়ে এসেছিল এবং শিশু শ্রীকৃষ্ণকে কোলে নিয়েই সে তৎক্ষণাৎ তাঁকে তার স্তন দান করল, যাতে সেই স্তন্য পান করা মাত্রই তাঁর মৃত্যু হয়। শ্রীকৃষ্ণ ক্রুদ্ধভাবে তৎক্ষণাৎ সেই স্তন করে দুগ্ধরূপী বিষের সঙ্গে সেই রাক্ষসীর প্রণবায়ুও শোষণ করে নিল। শ্রীকৃষ্ণ এতই কৃপাময় যে, সেই রাক্ষসী যেহেতু তার বুকের দুধ দান করবার জন্য তাঁর কাছে এসেছিল, তাই তিনি তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছিলেন এবং তার সেই কার্যকলাপ মাতৃবৎ বলে গ্রহণ করেছিলেন। আর তার বীভৎস্য কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য তাকে তৎক্ষণাৎ সংহার করেছিলেন। আর শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা নিহত হওয়ার ফলে সে মুক্তি লাভ করেছিল। মাত্র ৬ মাস বয়সেই পুতনা রাক্ষসীকে হত্যা করেন তিনি যাঁর উচ্চতা ছিল ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। কালীয় নামে একটি বিরাট সাপ যমুনার জল বিষাক্ত করে রেখেছিল। এই জল পান করে রাখাল ও গরুর মৃত্যু হত প্রায়শই। বালক কৃষ্ণ এই কালীয় নাগকে অপরাধের শাস্তি দেয়। হিন্দু চিত্রকলায় অনেক স্থানেই বহুফণাযুক্ত কালীয় নাগের মাথার উপর নৃত্যরত কৃষ্ণের ছবি দেখা যায়।এধরনের দৈত্যাকৃতির শত্রুদের বিরুদ্ধে তার একক হামলা ও তাদের পরাস্ত করার কৌশলাদি যে কোন চৌকশ মেধাবী সামরিক কর্মকর্তার দুর্ধরষতাকে হার মানায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, প্রথাগত বৈদিক ধর্ম ও তার দেবদেবীর বিরুদ্ধে কৃষ্ণের এই অবস্থান, আধ্যাত্মিক ভক্তি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছে। জীবকুলে তিনি সত্যের বাণী স্থাপন করেছেন। ন্যায়ের পক্ষে ভগবদ্ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে জীবশিক্ষার জন্য বিভিন্ন কর্ম করেছেন। আগামী দিনে সত্যের পথে চলার মতো আলোকবর্তিকারূপে বিভিন্ন শিক্ষা দিয়ে গেছেন।আর এই কারণেই সকল সময়ে সর্বত্র তার স্তব হয়। তিনি জগৎশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বলেই যুগে যুগে উচ্চরিত হবে তার নাম। ‘কৃষ্’ মানে সত্তা আর ‘ণ্’ এর অর্থ হলো আনন্দ। এই দুই মিলিয়েই তিনি কৃষ্ণ। সেই পরমপুরুষ মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে পৃথিবী থেকে দূর হোক সকল অসত্য, অন্যায়, অধর্ম। জন্মাষ্টমী বা কৃষ্ণজন্মাষ্টমী হিন্দুদের একটি ধর্মীয় উৎসব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথিকে কেন্দ্র করেই শুভ জন্মাষ্টমী পালন করা হয়। এই উপলক্ষে দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন মন্দিরে কৃষ্ণপূজা, তারকব্রহ্ম হরিনাম সংকীর্তন, গীতাযজ্ঞ, পদাবলি কীর্তন এবং ঘরে ঘরে ভক্তরা উপবাস থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা ও পূজা করে থাকেন। এই সময় জন্মাষ্টমী মিছিল ও শোভাযাত্রা বের করা হয়। এর অপর নাম কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী ইত্যাদি। কৃষ্ণভক্তদের বিশ্বাস, জন্মাষ্টমী ব্রত পালন করলে সব পাপমোচন ও প্রভ‚ত পুণ্য অর্জিত হয়। এই ব্রত যারা নিয়মিত পালন করেন তাদের সন্তান, সৌভাগ্য ও আরোগ্য লাভ হয় এবং পরকালে বৈকুণ্ঠ প্রাপ্তি ঘটে।
লেখক: প্রাবন্ধিক