শুধু শ্বাসতন্ত্রে নয়, মস্তিষ্কেও পৌঁছে যাচ্ছে করোনা সংক্রমণ!

86

করোনা যে কারো শরীরে থাবা বসানোর পর তার শ্বাসতন্ত্রে গিয়ে বংশবিস্তার শুরু করে। এমনটিই জানিয়েছে বিভিন্ন গবেষণা। তবে সম্প্রতি জানা গেছে, করোনাভাইরাস শুধু শ্বাসতন্ত্রে নয় বরং পৌঁছে যায় মস্তিষ্কেও। সেখানে গিয়েও বংশবিস্তার করে করোনা।
মানবশরীরে করোনাভাইরাস ঢোকার একটি দরজার কথা এতদিন জেনেছিল দুনিয়া। যে সারফেস রিসেপটরের নাম অ্যাঞ্জিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম-২ বা এসিপই-২। দুইটি পৃথক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, করোনার জন্য দরজার কাজ করছে মানবদেহের আরো এক প্রোটিন, নাম নিউরোপাইলিন ১।
যার সঙ্গে জোট বেঁধে শুধু শ্বাসতন্ত্রের কোষ নয়, মস্তিষ্কেও পৌঁছে যাচ্ছে করোনা সংক্রমণ। বহু আক্রান্ত যে গন্ধবিচারের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন, তার অন্যতম কারণ এই রিসেপটর।
তবে সুখবরও আছে। পরীক্ষাগারে দুইটি গবেষণাই দেখিয়েছে, অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে করোনার মুখের উপর এই দরজা বন্ধ করা সম্ভব। তাই নতুন ওষুধ এবং ভ্যাকসিনের গবেষণাতেও এই তথ্য কাজে দেবে বলে মত ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের।
সার্স কোভ-২ কীভাবে মানবশরীরে ঢোকে এবং ছড়িয়ে পড়ে, তা সঠিকভাবে জানা প্রয়োজন। তবেই শরীরে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব। নতুন ড্রাগের টার্গেট ঠিক করা তো বটেই, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজে এমন প্রতিটি দরজার হদিস থাকা জরুরি। কীভাবে এসিই-২ রিসেপটরের সঙ্গে বাইন্ড করে করোনার স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন মানবকোষের মধ্যে ঢুকে পড়ে, সে সম্পর্কে আগেই জেনেছে বিশ্ব।
দ্য প্রকাশিত দুইটি গবেষণায় দেখানো হয়েছে, স্পাইক প্রোটিনের একটি ডোমেইন এস-১ মানবশরীরের এন্ডোথেলিয়াল ও এপিথেলিয়াল কোষে থাকা নিউরোপাইলিন-১ এর (এনআরপি-১) সঙ্গে জোট বেঁধে শরীরের আরো নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। শ্বাসতন্ত্র তো বটেই, কামান দাগছে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রেও।
করোনায় মৃত ছয়জনের অটোপসি করে পাঁচ জনের অলফ্যাক্টরি এপিথেলিয়াম ও অলফ্যাক্টরি বাল্বে সংক্রমণের প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ইঁদুরের উপর পরীক্ষাতেও স্পষ্ট, সংক্রমণ ঘটছে মস্তিষ্কের টিস্যুতে, যার অন্যতম কারণ অলফ্যাক্টরি এপিথেলিয়ামে থাকা নিউরোপাইলিন-১ রিসেপটরের উপস্থিতি।
একটি গবেষণা হয়েছে ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টলে, অন্যটি জার্মানির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখে। দু’টি প্রি-প্রিন্ট গবেষণাই প্রকাশিত হয়েছে বায়োআর্কাইভে। এই গবেষণা দুইটির উল্লেখ করেছে বিজ্ঞান পত্রিকার নেচারও।
কীভাবে দরজার কাজ করছে নিউরোপাইলিন-১? কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিকেল বায়োলজির অর্গ্যানিক অ্যান্ড মেডিসিনাল কেমিস্ট্রির বিজ্ঞানী অরিন্দম তালুকদার বলেন, হোস্ট প্রোটিন এসিই২-র সঙ্গে জুড়ে কোষের ভিতরে ঢোকে স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন। এর দুটো ডোমেইন : এস১ ও এস২। এরা ভাগ হতে পারলে তবেই সক্রিয় হয়।
মানবশরীরকে কব্জা করে হোস্ট প্রোটিয়েজ ফিউরিনের মাধ্যমে ক্লিভেজ অর্থাৎ ভাগ হওয়ার এই কাজটা সেরে ফেলে। এস-২ আবার ট্রান্সমেমব্রেন সেরিন প্রোটিয়েজ-২ অর্থাৎ টিএমপিআরএসএস-২ এর মাধ্যমে বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, এস-১ ডোমেইনও এনআরপি-১ এবং এনআরপি-২ এর সঙ্গে বাইন্ড করে। ফলে আরো ছড়িয়ে যেতে পারে।
এসিই-২ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা নেয়। ওষুধ দিয়ে সরাসরি আক্রমণ করে সেই দরজা বন্ধ করা কঠিন। তাই বিকল্প পথের খোঁজ পেলে গবেষণায় সুবিধা। টিএমপিআরএসএস-২ কে নিষ্ক্রিয় করে, এমন কিছু ড্রাগ আগে থেকেই রয়েছে। নিউরোপাইলিনকেও রোখা গেলে সংক্রমণে আরো কিছুটা বাঁধ দেয়া যেতে পারে।
মানবশরীরে করোনার ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ভাইরাসের প্রোটিয়েজকে নিষ্ক্রিয় করার গবেষণা চালিয়ে ৩১টি মলিকিউলের খোঁজ দিয়েছিলেন হায়দরাবাদের টিসিএস জীবণবিজ্ঞান গবেষণাগারের বিজ্ঞানী অরিজিৎ রায়। তিনি বলেন, ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ব্যাসিজিনকেই প্লাজমোডিয়ামের একমাত্র রিসেপটর হিসেবে মনে করা হত।
পরে দেখা যায়, আরো দরজা রয়েছে। করোনার ক্ষেত্রেও তেমনই খোঁজ পাওয়া গেল। আপাতত সামান্য তথ্য মনে হতে পারে। তবে ছোট ছোট তথ্য জুড়েই বড় জয়ের পথ তৈরি হয়।