শুদ্ধতার শুভ্রতায় ভরে উঠুক নতুন বছর

16

মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত

প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পা রেখেছে ৫২ বর্ষে। ছোট আয়তনের বিশাল জনগোষ্ঠীর এই প্রিয়ভূমি এখন বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে কথা বলে। নানান প্রতিকূলতা আর সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির পথে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং করোনা অতিমারি পেরিয়ে বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বকীয়তায় ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে।
একান্ন বছরের বাংলাদেশে হাজারো অপ্রাপ্তির মাঝে অবকাঠামোগত অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। বিগত বছরে দেশে পদ্মা সেতু এবং বছরের শেষে এসে মেট্রোরেল সহ অনেক বড় বড় কাজ হয়েছে যা বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে এক যুগান্তকারী সফলতা বলা যায়। কর্ণফুলী টানেল, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ, মাতারবাড়ি ও পায়রা সমুদ্রবন্দর সহ অনেক মেগা প্রকল্পের কাজ সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে যা আমাদের সবল অর্থনীতির শক্তিমত্তা ও সরকারের সফলতার পরিচায়ক। নানান প্রতিকূলতা আর সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের পোশাক শিল্প। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ১৮০টি ’সবুজ কারখানা’র দেশ। আরও ৫৫০টির বেশি পোশাক কারখানা গ্রিন সার্টিফাইডের তালিকায় আসার অপেক্ষায় রয়েছে। প্রবাসী আয়ে শীর্ষ ১০ দেশর মধ্যে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে। এসব আমাদের অর্জন যা বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে সমগ্র বিশ্বে এক অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিতে মধ্য ও নি¤œবিত্তের মানুষের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এর ধাক্কা লেগেছে খুব ভালো করে। চাল, ডাল, গম, তেল সহ সব জিনিসের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে ও বাজার ব্যবস্থা স্থিতিশীল রাখা এবং দ্রব্যমূল্য সাধারণের আয় ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকার চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিগত বছর মানুষ খুব বেশি ভোগান্তি ভোগ করেছে বিদু্যুৎ সংকটে যা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে এবং সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। দেশের উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ অপরিহার্য বিষয়। তাই এসব বিষয়ে সরকারের লুকোচুরি খেলা মোটেই সমীচিন নয়। সরকার একদিকে বলেছে বিদ্যুতে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ আর অন্যদিকে বিদ্যুত আর গ্যাস সংকটে কল-কারখান অচল এবং সাধারণ মানুষ দৈনিক দু-চার ঘণ্টাও বিদ্যুৎ পায়নি। অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকারের সফলতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলেছে ব্যাংকিং খাতের ব্যাপক লুটপাট ও অর্থপাচার। দেশের সাতটি ব্যাংক থেকে ব্যাপক অর্থ লুটপাটের খবরে নড়েচড়ে বসেছে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো বার-বার অস্বীকার করে আসছে এরকম কিছু হয়নি বলে অথচ দুদক আনুষ্ঠানিক ভাবে তদন্তের ঘোষণা দিয়ে প্রমান করল ব্যাংকিং খাতে কিছু না কিছু হয়েছে যা হয়তো এই নতুন বছরে আরো ভালো করে জানা যাবে। মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে কিন্তু জীবনের নিরাপত্তা বাড়েনি সামগ্রিক ভাবে। সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনা যেন বেড়েই চলছে। বিশেষ করে সড়কে মৃত্যুর মিছিল প্রতিনিয়ত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে যা সত্যিই মর্মান্তিক! আশংকাজনক ভাবে বেড়েছে আত্মহত্যা বিশেষ করে কিশোর ও যুবকদের মাঝে। বেড়েছে কিশোর অপরাধ, মাদকাসক্তি এবং অসহনশীলতা। যার ফলে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে একজন আরেক জনকে খুন করছে নির্দ্ধিধায় ! কর্মসংস্থানের অভাবে শিক্ষিত যুবকদের মাঝে হতাশা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। তাই নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে বেকার যুবকদেরকে উপযুক্ত কাজ দিয়ে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে এবং হতাশামুক্ত সুন্দর জীবনের পথ দেখাতে হবে। গণতন্ত্রের মোড়কে স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা দমন পীড়ন না করে সরকার ও বিরোধীদল সহ অপরাপর সকল রাজনৈতিক শক্তিকে দেশের তরে কাজ করতে হবে। রাজনীতি হতে হবে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। ক্ষমতায় কে আসবে বা রাষ্ট্্র পরিচালনার মতো মহান দায়িত্ব কার হাতে অর্পণ করবে তা নির্ধারণের ক্ষমতা দিতে হবে জনগণের হাতে নতুবা রাজনৈতিক ক্লেশ বাড়তে থাকবে এবং দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং চলমান উন্নয়ন কর্মকাÐ ব্যাহত হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দমন-পীড়নের মনোভাব থেকে ক্ষমতাসীন দলকে ফিরে এসে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যেতে হবে এবং সকলকে তার সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার ভোগ করতে দিতে হবে। খাদ্যে ভেজাল, ঔষধে ভেজাল, চিকিৎসা সেবায় বিশৃংখল অবস্থা থেকে দেশের মানুষকে উদ্ধার করতে হবে। দেশের মানুষের মানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে এবং ’শিক্ষাব্যবস্থা’ নিয়ে প্রতিনিয়ত এক্সপেরিম্যান্ট না করে একটি যুগোপযোগী, বিজ্ঞানসম্মত, আধুনিক ও নৈতিকবোধ জাগ্রত করার মতো ’শিক্ষাব্যবস্থা’ স্থির করতে হবে নতুবা জগাখিচুড়ি মার্কা শিক্ষাপদ্ধতির কারনে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষিত হয়ে দুর্নীতিবাজ, সুদখোর, ঘুষখোর ও অমানবিক মানুষ বৈ আর কিছু হবে না। নতুন বছরে আমরা চাই না রাজনীতির ময়দান সহিংস হয়ে উঠুক, আমরা চাই না গ্রামের অসহায় মানুষগুলো নগরের বস্তিবাসী হয়ে যাক, চাই না বৃদ্ধাআশ্রমে কারো মা-বাবা আশ্রয় নিক, আমরা চাই না মাদকের নেশায় হারিয়ে যাক কোন যুবকের স্বর্ণালী ভবিষ্যৎ, চাই না কোন সড়ক কেড়ে নিক আপনজনের প্রাণ। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের নায্য দাবীর প্রতি সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আরো মনযোগী হোক এবং প্রবাসীদের অবসর জীবন যেন অমানবিকতায় পর্যবসিত না হয় সে ব্যাপারে যুগান্তকারী পরিকল্পনা গ্রহণ করুক এই নতুন বছরে। কালের পরিক্রমায় বছর শেষে নতুন বছর আসে আর আমরাও নতুন বছরকে স্বাগত জানাই। স্বপ্ন দেখি-স্বপ্ন দেখাই অনেক কিছু কিন্তু বাস্তবায়ন হয় তার অল্প। বর্তমান ও বিগত সরকারগুলোর অনেক সফলতা রয়েছে কিন্তু এই সফলতার ঝুড়ি আরো ভরে দিতে পারতাম এই একান্ন বছরে যদি দেশে ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যেত। অতীব দুঃখজনক হলেও সত্য যেকোন সরকারই সুশাসনের পথে হাঁটেনি তাদের রাজনৈতিক উচ্চাবিলাস চরিতার্থ করার স্বার্থে। সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলে দেশের উন্নয়ন আরো অনেকাংশে বৃদ্ধি পেত এবং সাধারণ মানুষ অনেক বেশি শান্তি ও স্বস্তি বোধ করত নিঃসন্দেহে।
পুরো পৃথিবীটা আজ মারাত্মক অসুখে ভুগছে। আমরাও এর বাইরে নই। তবও আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি। অহংকার আর গর্ব করি স্বাধীন মাতৃভূমিকে নিয়ে। হাজারো না পাওয়া আমাদের থাকবে। নানান বৈষম্য ও সীমাবদ্ধতা থাকবে সমাজে। তারপরও যা আছে তার উপর নির্ভর করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে এবং যার-যার দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে হবে। দেশ কারো একার নয়, তাই দেশকে সুন্দর, নিরাপদ ও সমৃদ্ধশালী করতে হলে সবাইকে কাজ করতে হবে দেশের তরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে। অতীতের সকল ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে নব চেতনায় দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দ্বিগুণ কর্মস্পৃহায় আমাদের শপথ নিতে হবে একটি আলোকিত মানবিক সমাজ ও সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনের।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব