শীতের রাতে জ্যোৎস্না

27

আরিফুল হাসান

মানুষগুলো সকাল থেকে হাঁটা শুরু করে। সেই কখন সূর্য উঠেছে। পথের ঘাসগুলো শিশিরের চিহ্ন মুছে দিয়ে ঝকঝকে রোদে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা কনকনে হাওয়া একটু আগেও ছিলো। এখন বাতাস কিছুটা উষ্ণ। মানুষগুলো নিজেদের শীত বস্ত্র শরীর থেকে আলগা করা শুরু করে। কেউ মাফলারটা খুলে গলার দু’পাশে ঝুলিয়ে রাখে। কেউ গায়ের চাদরটা খুলে ভাজ করে হাতে নেয়। কেউ জেকেটের চেইন পত করে খুলে ফেলে। বাউল কুদ্দুস একটু দূরে, পেছনে তামাক টানতে টানতে আসে। মানুষগুলো যাচ্ছে? কিন্তু কোথায় যাচ্ছে সেই উদ্দেশ্য এখন অচেনা। চলতে চলতে তাদের ক্ষুধা বাড়ে, সাথে টেক্কা দিয়ে বাড়তে থাকে তৃষ্ণা। মানুষেরা মনে করে এবার তাদের থামা দরকার। মাথার উপরে রোদ তেতে উঠেছে। বিস্তৃত প্রান্তরজুড়ে একটি শূন্যতা কেমন যেনো এই ক্ষুদ্র দলটির উপর নিঃসঙ্গতার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে।
দলের মধ্যে কলিমুদ্দি সবচেয়ে বড়। বয়সে ও প্রজ্ঞায়। সে হাত উঁচিয়ে দলটিতে থামার ইঙ্গিত করে। ক্ষেতের হালচষা ঢেলার মতো সবাই যার যার কদমে দাঁড়িয়ে যায়। কলিমুদ্দি তাদেরকে কিছু বলার জন্য ঠোঁট নাড়ে। কিন্তু কোনো কথা তার মুখ থেকে সরে না। ভাষাগুলো, অভিব্যক্তিগুলো সব কেমন অনাদ্র অবুনজ হয়ে গেছে। সে বার কয়েক চেষ্টা করে ক্ষান্ত হয়। দলের অন্যান্য লোকগুলো হা করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কলিমুদ্দি আবারও কিছু বলার চেষ্টা করে। এবারও তার ভাষা উবে যায়। যেমন রূপসীদেরও তকের লাবণ্য উবে যায় শীতল বাতাসে। কিন্তু এবারে আর না বললে হয় না। তাই কলিমুদ্দি সর্বশক্তি দিয়ে আবারও ঠোঁট নাড়ে। যেনো সে বলতে চায় অগনিত কথা মালা। দলের অন্যান্য সদস্যেরা আবারও হা করে তাকিয়ে থাকে কলিমুদ্দির মুখের দিকে। অধীর পিপাসা নিয়ে তারা বৃদ্ধ কলিমুদ্দির চোখের দিকে তাকায়, মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু তাদের শ্রবণ পিপাসা মিটে না। বাউল কুদ্দুর তার ঝোলা থেকে একতারাটি বের করে আনে। না, বাজে না কোনো সুর। সে আবার আঙুল ছোঁয়ায় একতারার তারে। না, অনুরণন নেই। বাধ্য হয়ে সে আবারও চোখ রাখে কলিমুদ্দির চোখে। কোনো অভিব্যক্তি নেই। দৃষ্টির ভাষা কথা কয় না। অন্য সদস্যরাও আগ্রহ ও অতিষ্ঠায় পাথরভুজ হয়ে থাকে। না, কথা নেই। কলিমুদ্দির মাটির দিকে তাকায়। চষা মাঠের মাটিগুলো শুকিয়ে শাদা শাদা মেঘের বলের মতো ফুটে আছে। সামান্য পায়ের আঙুলের আঘাতেই সেগুলো ঝুরঝুর করে গুঁড়ো হয়ে যায়। সে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে। যেনো কোনো পরামর্শ করছে ধরিত্রির সাথে। শেশষবারের মতো মতো সে মাথা তুলে। আবার দলটির মুখের দিকে তাকায়। প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের ডান হাত রাখে বুকের উপর। বৃদ্ধ দেহটাকে টানটান করে দাঁড়ায়। সমস্ত শরীরের শক্তি একত্র করে ঠোঁটে নিয়ে আসে। জিহব্বাটা একবার থুথু দিয়ে ভিজানোর চেষ্টা করে। না, থুথু নেই। জলাভাবে কাঠ হয়ে আছে কণ্ঠ অবধি। খড়খড়ে স্বাদবস্তুটাকে নাড়ানোর চেষ্টা করে। নড়ে না। পেছন থেকে টেনে কে যেনো জিহব্বাটাকে গলার ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। মাথার উপরে গনগনে সূর্য। সে আবার চলতে শুরু করে। না, সে পারবে না কোনো কথা বলতে। যাত্রীদলও আশাহত হয়ে তাকে অনুসরণ করে।
মাঠের শেষে একটি বৃক্ষ দেখা যায়। আপাতত এ পর্যন্ত তাদের গন্তব্য। তারা মরিয়া হয়ে বৃক্ষটির নিকটে যায়। না, কোনো ছায়া নেই। পাতাপল্লবহীন শীতের বৃক্ষ তাদের পথক্লান্তি দূর করতে পারে না। তবু তারা শেকড়ে ঠেস দিয়ে বসে। দলের অন্য আরেকজন সদস্য তার গায়ের সুয়েটারটা খুলে বৃক্ষের শাখায় ঝুলিয়ে দেয়। বুড়োটাও তার চাঁদর রাখে। বাউল তার একতারার ব্যাগটা নামিয়ে মাটিতে সমান্তরাল করে শোয়ায়। একটা হতাশার দীর্ঘনিঃশ্বাস তার কণ্ঠ চিড়ে বেড়িয়ে আসে। অনেক গভীর থেকে একটা বুদ্বুট উঠে মস্তিষ্কের ভেতরটা পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়। তার কিছুটা ঘুম পেতে থাকে। অন্য সব সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গা এলিয়ে দেয়।
সন্ধ্যে হলে তাদের ঘুম ভাঙে। এবং তারা যে সকাল থেকে হাঁটা শুরু করেছে ও দুপুরের রোদ অবধি হেঁটে এসে এই গাছের শেকড়ে শুয়ে পড়েছে তা তাদের মনে পড়ে। তারা আবার নিজেদের শীত বস্ত্র গায়ে জড়িয়ে নেয়। এবং মাঠের শেষে সু-উচ্চ পাহাড়ের উপর চড়তে থাকে। পাহাড়ে কী আছে? তাদের মনে প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরটা জানে না কেউ। কলিমুদ্দি সবার সামনে হাঁটুতে ভর দিয়ে দিয়ে তার নুয়ে আসা দেহটা টেনে তুলছে। অন্যরা তার পদাংক অনুসরণ করে তার মতোই শরীরকে বাঁকিয়ে পাহাড়ের পথে পা ফেলতে থাকে।
দাবানলে পুড়ে যাওয়া পাহাড়। কিছুদিন আগেই হয়তো পুড়েছে। গাছপালা তেমন নাই বললেই চলে। শুধু ছোট ছোট কাশের চাড়া আপনা থেকে গজিয়ে উঠে তিন-চার ইঞ্চি লম্বা হয়ে ঝোপের মতো তৈরি করার চেষ্ঠা করছে। কলিমুদ্দি একবার হাঁটা থামিয়ে পেছনের লোকগুলোর দিকে চায়। না, সবাই ঠিকঠাক আছে। সে আবারও চলতে থাকে। তার অনুসারীরা নিঃশব্দে পায়ে পা মেলায়।
খাড়া বেয়ে উঠা কষ্টের। কিন্তু কী করবে? এছাড়া আর তাদের গতি নেই। পাহাড়ের মাঝামাঝি একটা ঢাল দেখে কলিমুদ্দি থামে। এখানে কিছু বৃষ্টির ফোঁটা জমা থাকতে পারে। না, নেই। সবগুলো পাথরের গর্ত শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে। লোকজন বিরসমুখে পাথরের খাঁজগুলো পরখ করে। জলের গন্ধও নেই। বাউল তার তামাকের পুটলি থেকে তামাক খুলতে গিয়ে টের পায়, শেষ তামাকটা সে দুপুরের কাছাকাছি সময়ে খেয়ে ফেলেছে। এবার সেও বিষন্ন মুখে অন্যান্য সহযাত্রীদের সাথে কলিমুদ্দিকে ঘিরে দাঁড়ায়। শীতের রাতে একটি চাঁদ পুবাকাশের মাঝামাঝি উঁকি দিয়ে কুয়াশার আস্তরণে মুখ ঢেকে আছে। লোকজন উৎসুক মুখে চাঁদের দিকে তাকায়। রাতের প্রশান্তি তাদের চোখমুখে ঝরে পড়ে। কিন্তু এ প্রশান্তিতে তো তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের এখন গন্তব্য দরকার। না হলে কোন পথে, কোন উদ্দেশ্যে তারা সকাল থেকে রাত অবধি হেঁটে চলছে? তারা আবার কলিমুদ্দির মুখের দিকে তাকায়। বড় আশা হয়, কলিমুদ্দি এবার তাদের কিছু একটা বলবে। সবার কান উৎকীর্ণ হয়। ভেতরে অনুভূতির ঘরে একটা তৃষ্ণা আবার দানা বাঁধতে শুরু করে। দানা বাঁধতে শুরু করে কলিমুদ্দির ভেতরেও শক্তি ও সাহস। রাতের নীরবতা ভেঙে এবার হয়তো সে বলতে পারবে। চমৎকার একটি পড়ে থাকা পাথরের উপর সে উঠে দাঁড়ায়। লোকজন তাকে ঘিরে ধোঁয়া-জ্যোৎ¯œায় স্থির অটল হয়ে থাকে। কলিমুদ্দি তার ডান হাতটা উপরের দিকে তুলে। ছোট্ট দলটির দিকে প্রসারিত করে দেয়। কিছু একটা বলার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে সে আবার থেমে যায়। তারপর অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকে চাঁদের দিকে। কুয়াশার আড়াল থেকে আধখানা চাঁদ এবার বেরিয়ে আসে। রূপালি আলোয় পাহাড়টা মায়াময় হয়ে উঠে। কলিমুদ্দির চোখের নীচে জল চিকচিক করে উঠে। তার ঠোঁট দুটি অসম্ভব কাঁপতে থাকে। আবেগের আতিশয্যে এবারও তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোয় না। সে আবারও ঠোঁট নাড়ে, ঠোঁট নেড়ে চলে। দ্রুত, দ্রুত, আরো দ্রুত। আরো আরো দ্রুত কাঁপতে থাকে তার ঠোঁট। যেনো এখনই সাইক্লোন শুরু হবে কথার। কিন্তু মৃদু বৃষ্টিও হয় না। তার কণ্ঠে কোনো কথা সরে না। পাহাড়ে চাঁদের আলো চকমক করে। পাথর থেকে নেমে সে আবারও হাঁটতে থাকে চূড়ার দিকে। তার অন্যান্য সহযাত্রীরাও তার সাথে পা মেলায়।