শীতের আগেই আবারও ঘূর্ণিঝড়ের চোখরাঙানি

156

কার্তিকের প্রথম সপ্তাহেই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ধরে পাততাড়ি গোটানোর পালা শুরু হয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর। ক্রমান্বয়ে অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিদায় নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার শুধুমাত্র চট্টগ্রাম অঞ্চলে কম মাত্রায় সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে তা দুর্বল অবস্থায় বিরাজ করছিল। বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডারের পাতার পর আজ বুধবারের মধ্যেই দেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিতে যাচ্ছে বর্ষা। পালাবদলের সন্ধিকাল পেরিয়ে আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝি উত্তুরে হাওয়ায় ঘটতে পারে শীতের আগমন। তবে, তার আগে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের ঘনঘটা দেখছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। দু’টি নিম্নচাপের অন্তত একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার পূর্বদেশকে বলেন, দেশে আবহাওয়া পরিস্থিতিতে বিদ্যমান আলামত পর্যবেক্ষণ এবং দীর্ঘদিনের বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে আমরা অক্টোবর-নভেম্বর মাসকে সাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির মাস হিসেবেই দেখে থাকি। সাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপজনিত কারণে গত কয়েকদিন ধরে যে বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়েছে, তার প্রভাব ইতিমধ্যেই কেটে গেছে। মেঘ-বৃষ্টির বাধা পেরিয়ে নভেম্বরের মাঝামাঝি শীতের আগমনের বার্তা যেমন রয়েছে, তেমনি এ মাসে সাগরে দুটি নিম্নচাপের অন্তত একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
অধিদপ্তরে সংরক্ষিত বিগত ১৯৬০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা ও পরের তিন বছরের ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ছয় দশকে সবমিলিয়ে মোট ৩৬টি ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে, এরমধ্যে ১৫ টিই আছড়ে পড়েছে মে মাসে। সর্বশেষ গত ২১ মে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আম্ফান দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। যাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এগারশ’ কোটি টাকা নির্ধারণ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে উপকূলীয় সাত জেলায় মারা যান ১৬ জন। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ধকল কাটিয়ে না উঠতেই গত ২৭ জুন থেকে শুরু হয় দেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। এবারের বর্ষা মৌসুমে টানা ৫১ দিন ধরে চলা ওই বন্যায় দেশের ৩৭ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। আক্রান্ত হয় ৯০ লাখ মানুষ। এই বন্যায় দেশের ৪০ জেলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ হাজার নয়শ’ ২৭ কোটি ৭৪ লাখ ৬২ হাজার ৭৬ টাকা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশের জলবায়ু’ শীর্ষক গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য মো. বজলুর রশীদের মতে, এবার বছরজুড়েই প্রতিমাসেই গড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। দেশের উত্তরের জনপদ রংপুরে বিগত ৭০ বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়েছে। সেপ্টেম্বরেও দেশজুড়ে বৃষ্টি হয়েছে ৩৩ শতাংশ বেশি। দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি উজানে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় বন্যার স্থায়ীত্বকালও বাড়ছে। সামগ্রিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ ও তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টায় পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার সিনপটিক অবস্থা বা দৃশ্যপটে বলা হয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলসহ রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, সিলেট ও ঢাকা বিভাগ থেকে বিদায় নিয়েছে এবং তা আগামী চব্বিশ ঘন্টায় দেশের অবশিষ্টাংশ থেকে বিদায় নিতে পারে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে কম সক্রিয় এবং বঙ্গোপসাগরে দুর্বল অবস্থায় বিরাজ করছে। পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ হিমালয়ের পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। আর পূর্বাভাসে বলা হয়, অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। তবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের দুয়েক জায়গায় হালকা বৃষ্টি বা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। বর্ধিত পাঁচদিনের আবহাওয়ার অবস্থায় এই সময়ের শুরুতে বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী ও কক্সবাজারে দেশের সর্বোচ্চ ৩৩ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি এবং সর্বউত্তরের জনপদ তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন ১৯ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
অধিদপ্তরে সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে কর্মকর্তারা জানান, পূর্ববর্তী বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে নির্ধারিত সময়ের তুলনায় কিছুটা দেরিতেই চেনারূপে ধরা দিয়েছিল বর্ষা মৌসুম। তেমনি বিদায়ও নিয়েছিল রেকর্ড দেরিতে। তার আগের ৫৮ বছরের ইতিহাসে এতটা দেরিতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের প্রস্থান ঘটেনি। তবে মৌসুমি বায়ুর দেরিতে প্রস্থান সেটিই প্রথমবার নয়। গত আট বছরে অন্তত চারবার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে প্রস্থান ঘটেছে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের। তাতে করে মৌসুমি বায়ুর স্বাভাবিক গতিবিধি নিয়েও ভাবনার অবকাশ তৈরি হয়েছে বলে তখন আবহাওয়াবিদরা মনে করেছিলেন। সুদীর্ঘকাল থেকেই খ্রীষ্টাব্দের মে মাসের শেষের দিকে বঙ্গোপসাগর থেকে টেকনাফ উপকূল দিয়ে দেশের স্থলভাগে প্রবেশ করত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ। এর মধ্য দিয়েই কাগজে-কলমে না হলেও অনানুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়ে যেত দেশের ষড়ঋতুর মধ্যে দৈর্ঘ্যের দিক থেকে সবচেয়ে বড় বর্ষা ঋতুর। বাদল-ধারার এই ঋতুর বিদায় ঘটত সেপ্টেম্বরের শেষে এসে। আর এখন বর্ষা শুরু হতেই জুনের মাঝামাঝি সময় লেগে যাচ্ছে। মৌসুম শেষ হচ্ছে অক্টোবরে এসে। এমনিতে স্বাভাবিক রীতি মেনে প্রতিবেশি দেশ ভারতের কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে টেকনাফ উপকূল দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ বঙ্গোপসাগর থেকে দেশের স্থলভাগে প্রবেশ করে। চলতি বছর বৈশ্বিক অতিমারী করোনাকালের মধ্যে গত পয়লা জুন ভারতের কেরালায় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের প্রবেশ পরিলক্ষিত হয়েছে। এরপর তা পশ্চিমবঙ্গ হয়ে গত ৭ জুন টেকনাফ উপকূল দিয়ে দেশের স্থলভাগে প্রবেশ করে। স্থলভাগে প্রবেশের সাথে সাথেই শুরু হয় বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিপাত। জুনের প্রথমার্ধেই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ সারাদেশে বিস্তার লাভ করে। অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেকটা শক্তিশালী রূপে হাজির হওয়া এবারের বর্ষায় দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি উজানেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে ভারী বর্ষণ হয়েছে। তাতে নদ-নদীর পানি বেড়ে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চল দীর্ঘমেয়াদী বন্যার কবলে পড়ে।