শিশু হত্যাকাণ্ড এবং ক্রাইম পেট্রোল সিরিয়াল প্রসঙ্গে

10

সুপ্রতিম বড়ুুয়া

আমরা লক্ষ করছি, বর্তমানে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে, সেগুলো আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে না। দুর্বৃত্তরা হয় পুড়িয়ে, না হয় কুপিয়ে কিংবা গলা কেটে হত্যা করছে। হত্যার এ এক নতুন নিয়ম চালু হয়েছে যেন! কেন এই উন্মত্ততা? চট্টগ্রামে শিশু আয়াতের হত্যাকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আবির নামে একজন ১৯ বছরের তরুণ এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আবির শিশু আয়াতকে প্রথমে অপহরণ করে মুক্তিপণের জন্য। কিন্তু আয়াতের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে না পারায় ক্রাইম পেট্রোলের দৃশ্য কাজে লাগিয়ে আয়াতকে হত্যার পর ছয় টুকরো করে সাগরে ভেসে দেয়। শিশু অপহরণ, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, হত্যা এবং হত্যার পর শরীর টুকরো টুকরো করার খবর কি আয়াতই প্রথম? যদি প্রথম না হয়ে থাকে তবে এমন জঘন্যতম অপরাধ দিনে দিনে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে চলছে কেন? এর জন্য কি সমাজ দায়ী? যদি সমাজ দায়ী হয়ে থাকে তবে কেমন করে? সমাজ এই দায়ভার কার ওপর চাপাবে?
হত্যাকারীরা কোনোকিছুই পরোয়া করছে না। ছোট শিশু আয়াত হত্যাকাণ্ডে সামাজিক মিডিয়াতে প্রতিবাদের ঝর উঠেছে, মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। অথচ এসব প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে থোড়াই পাত্তা দিচ্ছে অপরাধীরা। মানুষ কেন এত বেপরোয়া হয়ে উঠল, কেন সামান্যতেই তাদের মধ্যে জেগে উঠছে জিঘাংসা- এটা এক বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে প্রতিকারের ব্যবস্থা না নিলে মানুষের এ নৃশংসতা রোধ করা যাবে না। বাংলাদেশ ছোট্ট আয়তনের একটি দেশ এবং এখানে বাস করছে ১৭ কোটি লোক। মানুষের মধ্যে যদি শুভবুদ্ধি কাজ না করে, তাহলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঘটা অপরাধ দমন করা একা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হওয়ার কথা নয়। সংবাদপত্রের পাতা খুললেই শুধু হত্যা আর হত্যা।
এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার পরিকল্পনা নিয়েও এগোতে হবে। অপরাধ দমনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলা হয়ে থাকে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যে একেবারেই হচ্ছে না, তা নয়। পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হয়েছে, অথচ কুপিয়ে হত্যা বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে। সুতরাং শুধু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অপরাধ দমনে পুরোপুরি কার্যকর নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। আসলে প্রয়োজন পড়েছে সমাজের চতুর্দিকব্যাপী এক বড় সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যে আন্দোলন মানুষকে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন করে গড়ে তুলবে। বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাই, কিশোর, তরুণেরা কি বুদ্ধিমানের পরিচয় দিয়েছে, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে কিভাবে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দেশের সমস্ত সংগ্রাম, আন্দোলনে তরুণেরা এভাবেই মানুষের মুক্তির জন্য নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়েছে, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, মানুষের জন্য নিজের জীবন বলিদান দিয়েছে। কিন্তু আজ আমরা কি দেখছি? আমরা দেখছি ৫/৭ জন্য কিশোর বা তরুণ একসাথে রাস্তায় হাটলে কিংবা মোটরসাইকেলের বিকট শব্দে চলাচল করলে মানুষ আশঙ্কা প্রকাশ করে এই ভেবে যে না জানি তারা কি অপরাধ করে বসে। মানুষের মনে এই ভাবনা কি হটাৎ একদিনে তৈরি হয়েছে। না, একদিনে তৈরি হয়নি। হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসা কিশোর গ্যাং এর জঘন্যতম অপরাধগুলো প্রতিনিয়ত ঘটার ফলে।
সা¤প্রতিক যেসব হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে, তার প্রতিটিরই বিচার হওয়া চাই। বস্তুত অপরাধের বিচার ও একইসঙ্গে মানুষের মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার আন্দোলন- এ দু’য়ের যথাযথ বাস্তবায়ন হলেই হত্যাকাণ্ডসহ সব ধরনের অপরাধ দমন। সাথে সাথে ক্রাইম পেট্রোল জাতীয় টিভি সিরিয়ালগুলো বন্ধ করতে হবে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও শিশুসাহিত্যিক