শিশুশ্রম বন্ধ হবে কবে ?

36

 

সম্প্রতি আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। হাঁটার সময় হঠাৎ চোখ পড়ল আমাদের পাশের বাড়িতে ১১ থেকে ১২ বছর বয়সী একটি শিশু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নিয়ে বৈদ্যুতিক লাইন মেরামতের কাজ করছে। আমরা সকলেই জানি এই কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। তার উপর আবার এটি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এর উপযুক্ত উদাহরণ। এটিতো শুধু একটি শিশুর কথা বলা হলো, সারা দেশের চিত্র প্রায় এরকমই। বিভিন্ন ধরনের ঢালাইয়ের কাজ, রাজমিস্ত্রির কাজ কিংবা ওয়েল্ডিং এর মত যুক্তিপূর্ণ কাজে শিশুরা ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর এভাবেই শিশুশ্রম এর পরিমান দিন দিন বাড়ছে।
পৃথিবীর জনসংখ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো শিশুরা। বাংলাদেশ সরকারের শিশু আইন, ২০১৩ অনুসারে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ব্যক্তি শিশু হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া ইউনিসেফের মতেও ১৮ বছরের নিচে সকল ব্যক্তি শিশু হিসেবে পরিগণিত হবে। বর্তমান সময়ে এই বয়সের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝুঁকি সমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হল শিশুশ্রম। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্যমতে শিশুশ্রম হল এমন এক ধরনের শ্রম যেখানে শিশুরা তাদের শৈশবের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে যে সম্ভাবনা বিদ্যমান তা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে শিশুশ্রম শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে। তবে শিশুশ্রম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। পৃথিবীতে শিশুশ্রমের বিভিন্ন প্রকার ধরন রয়েছে যেমন দাসত্ব কিংবা শিশু পাচার, শিশুদের দিয়ে পতিতাবৃত্তি বা পর্নোগ্রাফি তৈরি, বিভিন্ন ধরনের অবৈধ মাদকদ্রব্য পরিবহনে শিশুদের ব্যবহার এবং এমন ধরনের বিপজ্জনক পরিবেশ তৈরি করা যেখানে শিশুর শারীরিক মানসিক বা অন্যান্য ক্ষতি হয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে সারাবিশ্বে ১৬০ মিলিয়ন শিশু শিশুশ্রম এর সাথে জড়িত যার মধ্যে ৬৩ মিলিয়ন বালিকা ও ৯৭ মিলিয়ন বালক রয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী প্রতি দশজন শিশুর মধ্যে একজন শিশু শিশুশ্রম এর সাথে জড়িত। এদের মধ্যে প্রায় ৭৯ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০১৩’র ( চূড়ান্ত ২০২১) তথ্যমতে দেশে শিশু শ্রমিক রয়েছে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার শিশু রয়েছে যাদের কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়ে। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার জন। আর ২ লাখ ৬০ হাজার জন শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত যা তাদের জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
উপরোক্ত পরিসংখ্যান থেকে এটা স্পষ্ট যে সারাবিশ্বে শিশুশ্রম এর পরিমান আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি। করোনার অভিঘাতে শিশুশ্রম এর পরিমান অনেকাংশে বেড়ে গেছে। কেননা করোনাকালীন সময় অর্থনৈতিক মন্দার দরুন অনেক শিশুকে কাজে নেমে পড়তে হয়েছে তাদের পরিবারের হাল ধরার জন্য। ফলে তারা স্কুল থেকে ছিটকে পড়েছে, বাধাগ্রস্ত হয়েছে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। ফলে বিশ্ববাসী একটি অশিক্ষিত ও অদক্ষ প্রজন্ম পেতে যাচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে। যা মোটেও বিশ্ববাসীর জন্য সুখকর নয়। কেননা আমরা সকলেই জানি ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। আজকে যে শিশুটি তার শৈশবকালীন ও কৈশোরকালীন অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে মূল ধারার উন্নয়ন থেকে ছিটকে পড়ছে সে কখনোই আর মূল ধারার উন্নয়নে ফিরে যেতে পারবে কিনা সেটা চিন্তার বিষয়।
আমরা সকলেই জানি সুশিক্ষিত ও দক্ষতা সম্পন্ন তরুণ প্রজন্ম একটি দেশের ভবিষ্যত নির্ণয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক। কিন্তু সুশিক্ষিত ও দক্ষতা সম্পন্ন তরুণ প্রজন্ম তৈরীর সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো শিশুশ্রম। করোনার অভিঘাতে আমাদের দেশের প্রচুর শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। যার বেশিরভাগই আর কখনোই স্কুলে ফিরবে না। এর মধ্যে যারা স্কুলে ফিরেছে তাদের অধিকাংশই আবার পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছে না। একদিকে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা অন্যদিকে মানসিক চাপ সব মিলিয়ে লেখাপড়ায় উৎসাহী হওয়ার মতো পরিবেশ অবশিষ্ট নেই। তাইতো মা-বাবারা তাদের সন্তানদের দিয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের কাজে।
এইযে সন্তানদের কাজে পাঠিয়ে দেবার যে প্রবণতা এটা কিন্তু প্রকট আকার ধারণ করেছে করোনা পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এটি অধিকতর পরিমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যা আমাদের দেশের ও বিশ্বের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের দেশের ভবিষ্যতের হাল ধরার সৈনিকদের। আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের সোনার বাংলার দামাল ছেলেদের যারা বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। যাদের হাত ধরে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী দেশ। অর্থনৈতিকভাবে যাদের হাত ধরে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে চায় তাদেরকেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি শিশুশ্রম নামক নিষ্ঠুর যাঁতাকলে ফেলে। শিশুশ্রম আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিচ্ছে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সুতরাং সময় এখন সামাজিক সুরক্ষা নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে শিশুশ্রম বন্ধ করা এবং শিশুদেরকে আলোর পথে নিয়ে আসা যাতে করে তারা আমাদের দেশের এবং দেশের উন্নয়নের আলোকবর্তিকা হাতে উদ্যম গতিতে এগিয়ে যেতে পারে।
শিশুশ্রম বন্ধে দেশের সকল মানুষের একত্রে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত সরকার, সুশীল সমাজের নাগরিক ও বেসরকারি সংস্থাগুলো কে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। তবে শিশুশ্রম বন্ধে পরিবারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার থেকে যদি সর্বপ্রথম শিশুশ্রম বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাহলে শিশুশ্রমের পরিমাণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এজন্য পরিবারের সদস্যদেরকে বিশেষত শিশুর বাবা ও মাকে শিশুশ্রম এর কুফল ও সুফল সম্পর্কে অবহিত করা খুবই জরুরী। এসব ক্ষেত্রে তাদেরকে বাস্তব উদাহরণ এর মাধ্যমে যদি বোঝানো সম্ভব হয় তাহলে সেটি খুবই কার্যকর হবে। মা-বাবা যদি একবার সচেতন হয় তাহলে শিশুশ্রম অনেকাংশেই কমে আসবে। অন্যদিকে সরকার ও নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ দেশের সব জায়গায় শিশুশ্রম এর কুফল সম্পর্কে আলোকপাত করবেন যাতে করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ কিংবা শহরের মানুষ সকলে সচেতন হয় এবং শিশুশ্রম বন্ধে এগিয়ে আসে। তাছাড়া শিশুশ্রম বন্ধে সরকার যে আইন প্রণয়ন করেছে তার যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি।
এছাড়া যে সকল শিশু কোন কারণে ইতিমধ্যে শিশুশ্রম এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে তাদেরকে যথাযথভাবে পুনর্বাসনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। যাতে করে তারা স্কুলে ফিরতে পারে এবং লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে। এ ধরনের শিশুদের পুনর্বাসন এর ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ত্বরান্বিত করার জন্য সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক। পুষ্টিকর খাদ্য ছাড়া শিশুর সঠিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সম্ভব নয়। পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা গেলেই গড়ে উঠবে ভবিষ্যতের সুস্থ-সবল তরুণ প্রজন্ম। তাই সরকারিভাবে এসকল শিশুদেরকে পুনর্বাসনে ক্ষেত্রে উক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করা খুবই জরুরি।
সার্বিকভাবে সকল শিশুর সঠিক বিকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ যেমন খেলাধুলা করার জন্য খেলার মাঠ, বিনোদনের জন্য বিভিন্ন বিনোদনমূলক কার্যক্রম ও সহশিক্ষা কার্যক্রম এর ব্যবস্থা করা উচিত যাতে করে শিশুরা তাদের পূর্ণ অধিকার পেয়ে বেড়ে ওঠে এবং ভবিষ্যতে সুস্থ-সবল ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন তরুণ প্রজন্ম গড়ে ওঠে।
শিশুশ্রম একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। তাই আসুন শিশুশ্রম বন্ধে আমরা সকলে যার যার জায়গা থেকে সোচ্চার হই, গড়ে তুলি জনমত। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই বিশ্বকে, এই দেশকে শিশুর বাসযোগ্য স্থানে পরিণত করি যেখানে থাকবে না কোন শিশুশ্রম। ফুলের মত পবিত্র শিশুগুলো বেড়ে উঠবে তার আপন মহিমায়, আলোকিত করবে সারা বিশ্বকে। নেতৃত্ব দেবে আগামীর পৃথিবীকে। আজ থেকে আমাদের পথচলা শুরু হোক শিশুশ্রম মুক্ত পৃথিবীর প্রত্যাশায়। আর আমাদের শ্লোগান হোক ‘শিশুশ্রম বন্ধ করি, সমৃদ্ধশালী পৃথিবী গড়ি।

লেখক : শিক্ষার্থী, ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ