শিশুশ্রম নিরসনে চাই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা

10

এমরান চৌধুরী

পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা বাড়ার পেছনেও অভিন্ন কারণ বিদ্যমান। দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। ক্ষুদ্র আয়তনের এ দেশটিতে বাস করে ষোল কোটিরও বেশি মানুষ। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশই শিশু। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুসারে শিশু অর্থ ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেনি এমন ব্যক্তি এবং কিশোর অর্থ ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেছে এবং ১৮ বছর বয়স পূর্ণ করেনি এমন ব্যক্তিকে বোঝায়। জাতীয় শিশুশ্রম নীতি ২০১০ অনুসারে শিশুদের আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে দেওয়া যাবে না। কিশোরদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০১৩ অনুসারে দেশে কর্মরত শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা সাড়ে ৩৪ লক্ষ। প্রকৃত হিসেবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ২০১৩ থেকে ২০২২ এই ১০ বছরের মধ্যে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়া শিশুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বৈশ্বিক মহামারি শুরুর পর এই সংখ্যা অভাবিত হারে বেড়েছে। অবশ্য ২০১৩ সালের সমীক্ষা অনুসারে শিশুশ্রমের আওতায় পড়া শিশুর সংখ্যা সাড়ে ১৭ লক্ষ। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ১২ লক্ষ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। আর ২ লক্ষ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ( প্রথম আলো, তাং ১২.০৬.২০২২)।
বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এনজে এফ) শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের সুরক্ষা কর্মসূচি ( পিডবিøউসি) এর আওতায় ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা (কামরাঙ্গীচর ও কেরানীগঞ্জ), কুমিল্লা,বরিশাল, যশোর ও খুলনায় একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে অংশ নেয় শ্রমে নিয়োজিত ৩৩ হাজার শিশু। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাম থেকে শহরে এসে নতুন যুক্ত হয়েছে ৩ হাজার ২৪০ শিশু। কাজ ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল এমন আড়াই হাজার শিশু করোনাকালে পরিবারকে সহায়তা করতে আবার কাজে ফিরে গেছে। আগের চেয়ে কম পারিশ্রমিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে ২ হাজার ৪০০ শিশু। নতুন করে ৭ হাজার ৮০০ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়েছে।
আমাদের অনেকেরই জানা সরকার কতৃর্ক ইতিমধ্যে শিশু আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ৩৮টি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে ২০১৩ সালেই গেজেট প্রকাশ করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে আরও ৫টি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহৃিত করা হয়। এ ৪৩টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তালিকায় অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিক কারখানা যথাক্রমে ১ ও ৯ নাম্বারে। এ ধরনের কারখানায় কাজ করলে শিশুদের নিউমোনিয়া, কাশি, আঙুলে দাঁদ, দুর্ঘটনাজনিত দৈহিক ক্ষত, ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ, হাঁপানি, যকৃতের দুরারোগ্য ব্যাধি, মূত্রাশয় ক্যানসারের মতো রোগ হতে পারে। বলে সতর্ক করা হয়েছে।
২০১৩ সালে প্রণীত আইনের ফলে শ্রমজীবী শিশুদের কর্ম পরিবেশের উন্নয়নের জন্য মালিক, শিশু ও শিশুর অভিভাবকের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে শিশুর সামর্থ্য অনুযায়ী ঝুঁকিবিহীন কাজ করার সুযোগ গৃষ্টি হয়েছে। কাজের ধরন, কাজের সুস্পষ্ট শর্ত, শিশুর পক্ষে অনুকূল কর্ম সংস্থানের পরিবেশ, শিক্ষা ও বিনোদন, চিকিৎসা সেবা, পরিবারের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ, শিশুর ভবিষ্যত নিরাপত্তার ব্যবস্থা ইত্যাদি নিশ্চিতে রাষ্ট্রের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবি সংস্থাও কাজ করে যাচ্ছে। এই আইনের ফলে শ্রমজীবী শিশুদের নিয়োগকর্তাদের মন ও মানসিকতার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটার কথা । শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার বেলায় অবলম্বন করার কথা সতর্কতা। বাড়ার কথা শ্রমজীবী শিশুদের কাজের পরিবেশ, কাজের ধরণ প্রভৃতি বিষয়ের উপর নজরদারি। শিশু কিশোরদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হয় এমন কাজে শিশুদের নিয়োগ করা থেকে বিরত রাখার যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার কতটা সুফল শ্রমজীবী শিশুরা পাচ্ছে তা গবেষণার বিষয়।
গত ১২ জুন ছিল বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস।দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ছিল সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করি। শিশুশ্রম বন্ধ করি। এই তারিখে দৈনিক প্রথম আলো ‘যেখানে শিশুশ্রম এখনো স্বাভাবিক ঘটনা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কমিউনিটি পার্টিসিপেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিডি) ২০১৯ সালে কামরাঙ্গীরচর এলাকার নূরবাগ, নিজামবাগ ও আশ্রাফাবাদ স্থানে শিশুশ্রমের ওপর এক সমীক্ষা করে। ওই তিনটি স্থানে আনুমানিক ৪৩৩ কারখানায় ১২ শতাধিক শিশু-কিশোর কাজ করে। নূরবাগের একটি অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় বেলা ১১ টার সময় পলিশের কাজ করছিল তিন কিশোর। জামাকাপড়, চুল ও মুখ অ্যালুমিনিয়ামের গুঁড়া লেগে ধূসর হয়ে গেছে। একজন বলল, বিকেল হতে হতে তাদের আর চেনা যায় না। তিন কিশোর জানায়, পরিবারকে সহায়তা করার জন্য তারা কাজে যোগ দিয়েছে। সপ্তাহে ২ হাজার ২০০ টাকা পায়। সবচেয়ে ছোট কিশোর (১৫) জানায়, বাড়ি সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলায়। সাত মাস আগে টাঙ্গাইলের কারখানায় কাজ নেয়। এক মাস আগে কামরাঙ্গীরচর কারখানায় এসেছে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় করোনায স্কুল বন্ধ হলে আর স্কুলে ফিরে যায়নি।’ উপর্যুক্ত প্রতিবেদন থেকে দুটো বিষয় স্পষ্ট, এক, বৈশ্বিক মহামারিজনিত কারণে স্কুল বন্ধ থাকার সুযোগে হত দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা পরিবারের সহায়তায় শিশুশ্রমে যোগ দিয়েছে। দুই, ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের তালিকায় শীর্ষে থাকা কাজে যেখানে শিশুদের নিয়োগ না দেওয়ার কথা সেখানে মালিকপক্ষ শিশুশ্রম আইন মানছেন না। এক্ষেত্রে তারা যতটা মানবিকতার কথা বলুক না কেন কম মজুরিতে শিশু-কিশোরদের খাটাতে পারেন বলেই তারা সরকারের নিষেধ থাকা সত্বেও শিশুদের নিয়োগ দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম কর্তৃক পরিবেশিত সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমজীবী শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন। এদের শতকরা ৯৪ জন দিনের পুরো সময় কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে। সংস্থাটির মতে গৃহকর্মের শ্রমই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এরা সূর্যোদয় থেকে যে পরিশ্রম করে সে তুলনায় তাদের প্রাপ্তি খুবই নগন্য।
শ্রমজীবী শিশুদের ব্যাপারে দেশের সচেতন নাগরিক এবং দেশের উন্নয়নের স্বার্থে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু দায়িত্ব রয়েছে। সরকার বা রাষ্ট্র সবকিছু দেখবে এই বলে নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে এড়িয়ে যাওয়া অবহেলার শামিল। একটি শিশু যেখানে কাজ করে সেখানে তার কাজ করার অনুকূল পরিবেশ আছে কি না? শিশুটিকে সঠিক বেতন বা মজুরি দেওয়া হচ্ছে কি না? অসুস্থ হলে শিশুটি ছুটি বা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে কি না? ক্লান্ত হলে সে বিশ্রামের সুবিধা পাচ্ছে কি না? কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিনোদনের ব্যবস্থা আছে কি না? নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে কাজ করানো হচ্ছে কি না? গৃহকর্মী হলে তার খাবার ও থাকার জায়গা স্বাস্থ্যমত কি না? এসব কিন্তু বাসা-বাড়িতে এসে কেউ দেখাশোনা করবে না। এগুলো দেখার মূল দায়িত্ব কিন্তু যে বাসা-বাড়িতে শিশুটি কাজ করে তাদের এবং প্রতিবেশির।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনে অঙ্গিকার করা হয়েছে। যে সব দরিদ্র অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজে পাঠিয়েছিল তা থেকে শিশুদের স্কুলগামী করতে বিনাবেতনে, বিনামূল্যে ও খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এর ফলে অনেক অভিভাবক তাদের শিশুদের আবার স্কুলে ফিনিয়ে আনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেছে। এতে করে অনেক পরিবারের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে। এ কথা সত্য যে শিশুশ্রম বন্ধে বা কমিয়ে আনতে শিশুদের স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে অভিভাবক ও মালিকপক্ষকে সচেতন করতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে সরকারকে। কঠোর পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে অভিভাবকরা কাজে নয়, নিজ নিজ শিশু সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হয়। সামান্য রুজি রোজগারের জন্য শিশুকে কাজে না পাঠিয়ে তাকে যদি লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করা যায় তা হবে মা বাবা ও শিশুটির ভবিষ্যতের জন্য উত্তম বিনিয়োগ। মা বাবার মধ্যে এ সচেতনতাবোধ জাগাতে সচেতন মানুষ রাখতে পারে প্রশংসনীয় ভূমিকা।
একটি কথা জোর দিয়ে বলতে চাই শিশুশ্রম বন্ধ করা বলুন, কমিয়ে আনা বলুন কিংবা শ্রমজীবী শিশুর উন্নয়নে রাষ্ট্র যতই আন্তরিক হোক তা কখনো সুফল বয়ে আনবে না, যদি শিশুর মা বাবা, অভিভাবক এবং শিশুদের যারা কাজে লাগায় সে নিয়োগকর্তারা সচেতন ও আন্তরিক না হোন। আমাদের ঘরে ফ্রিজ, টেলিভিশন, আসবাবপত্র রাখার জায়গা ঠিকই থাকে। শুধু জায়গা থাকে না যে মানুষটি যে শিশুটি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে তার। এ মানসিকতার পরিবর্তন হলেই আমরা বিনির্মাণ করতে পারব শিশুদের জন্য শিশুশ্রমমুক্ত একটি সাজানো বাগান।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক