শিশুর জীবন গঠনে নৈতিকতার চর্চার প্রয়োজনীয়তা

50

 

আজকাল প্রায়শই প্রতিটি পরিবারের মনের কথা শোনতে পাওয়া যায় যে ছেলেমেয়েরা কথা শুনে না।সারাক্ষণ মোবাইল অথবা গেম নিয়ে পড়ে থাকে। আসলেই বাস্তবতার নিরিখে কথাগুলো বড্ড আক্ষেপের সাথে সন্তানের অভিভাবকরা বলে থাকেন।সময়ের অবয়ব পরিবর্তনশীল। আজ যা হালের ফ্যাশন কাল তা খুব পুরনো। আবার নতুন করে গজিয়ে উঠে অন্য ভাবধারার জীবনযাপনের অনুষঙ্গ।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মেধা ও মননে অনন্য প্রতিভার অধিকারী মানুষ। সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ উপহার মানুষ এই ভূধরে। মানুষ যখন জন্ম নেয় তখন থাকে গোমূর্খ। ভাল মন্দ, উচিত অনুচিত কিছুই তার ভিতরে বাছ বিচার করার ক্ষমতা তৈরি হয় না। এই ক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতা দৈনন্দিন জীবনে চর্চার মাধ্যমে আয়ত্তে¡ আনায়ন হয়।শিশুর মুখে কথা ফোঁটার সাথে সাথেই তাকে বুনিয়াদি শিক্ষার পাশাপাশি নীতি নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া খুব জরুরী। ধনী মানুষ পাওয়া যায় কিন্তু ভাল মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ পাওয়া খুবই কঠিন।জগতটা একধরনের লোভ,সৌন্দর্য আর মোহের লীলাভূমি। সহজেই মানুষ এতে জড়িয়ে পড়ে আর পশুর মত অযাচিত আচরণ করতে, অন্যের ক্ষতি করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না। সৃষ্টিলগ্ন থেকে অদ্যাবধি মানুষের এই অসদাচারণের কারণে পৃথিবীর মানুষ বারবার যুদ্ধ বিগ্রহ করে কোটি প্রাণ দিয়ে তার মূল্য চুকিয়েছে। তাই ব্যক্তির ভিতরটা আসলত্ব দিয়ে, সৌন্দর্যের নীতি নৈতিকতা দিয়ে ভরপুর করতে পারলে পৃথিবীটা সবার জন্যই শান্তির স্থান হতে পারে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, শিক্ষা হচ্ছে মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে থাকা উৎকর্ষের বিকাশ। শিক্ষার কোন বিকল্পও নেই। মেধা মস্তিষ্ক দ্বারাই চলে একপ্রকার মানুষের মন। সেটা তাই শৈশব থেকেই গেঁথে দিতে শিশুর মনে। আমার মা আমাদের শৈশবে কিশোরী বয়সে শিক্ষা দিয়েছেন, কখনো কারো জিনিস পড়ে থাকলেও না ধরতে,কারো কুৎসা,অনুপস্থিতিতে তার বদনাম না করতে, স্বকীয়তায় বাঁচতে নিজের কর্মের ভাল মন্দ বিচার করতে বলতেন।আজো আমরা সেই শিক্ষার আলোকে জীবন পথ চলতে চেষ্টা করি।আমাদের মা সে সময়ে এসব কথা মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন বলেই আজো তার চর্চা অব্যাহত আছে নিজেরই অজান্তে।আর এটাই নীতি নৈতিকতা শিক্ষার সফল উদাহরণ। পারিবারিক শিক্ষা একজন শিশুকে ভাল মানুষ তৈরীতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। যারা মনে করেন কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই শিশুর মেধার স্ফুরণ ঘটায় তা চরম ভুল। বাইরের জগতে চলতে শেখায় এই শিক্ষা। কিন্তু তা চালনার করার মূল শিক্ষাটা আসলে পরিবার থেকেই আসে।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, আপনি কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের জলের দিকে তাকিয়ে সমুদ্র পার হতে পারবেন না। শিক্ষাও তেমন। শুধু উপদেশ দিয়ে ক্ষান্ত হলে চলবে না। নিজের জীবন চরিত দিয়ে অন্যকে শিক্ষা দেয়া বাঞ্ছনীয়। সেই শিক্ষাটা শিশুরা তাড়াতাড়ি গ্রহণ করতে সক্ষম। কারণ শিশুরা অনুকরণ প্রিয়।মা বাবা ভাই বোন যেভাবে কথাবার্তা, চাল চলন করে সেভাবেই তারা গড়ে উঠে।
পারতঃপক্ষে শিশুর সামনে অহেতুক খারাপ পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক কোন্দলে শিশুরে জড়ানো বা তাদের দেখানোর কোন ব্যতিব্যস্ততার দরকার নেই। ব্রেইনকে যতই ইতিবাচক ধারণা দেয়া যায় ততই তা সুপ্রসন্ন হয়।এবং ভাল দিকটাই সবসময় আগে বেছে নেয়।
শিশুর ভিতরে নীতি নৈতিকতার বীজ বুনে দিতে প্রথমে মা বাবা তাকে শিশুকাল থেকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিবেন।সদাচারণে শিশু পুলকিত ও আত্মবিশ্বাসী হয়।তখন শিশু বুঝতে পারে তার গুরুত্ব কতখানি।প্রতিদিন ছোটখাটো কাজে ভুল করলেও কেমন হওয়া উচিত তা বুঝিয়ে বলতে হবে।মারামারি, কান ধরানো,ওঠবস করানো, চড় থাপ্পড় মারা,গাল টিপে দেয়া,কান মুচড়ানো এসব শাস্তি দেয়া থেকে শিশুদের দূরে রাখুন।বুঝিয়ে বলতে হবে যেন ভবিষ্যতে এমনটি আর না করে।
আমাদের নবী করিম (সাঃ) শিশুকাল থেকেই এতটা সৎ ও ন্যায় নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন ছিলেন তখনকার আরববাসীরা তাঁকে ‘আল আমিন’ বলে উপাধি দিয়েছিলেন এবং মুসলিম,ইহুদীরাও তাঁর কাছে আমানত হিসেবে তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র গচ্ছিত রাখতেন। একজন মানুষের শিশু,কৈশোরকাল যত বেশি নৈতিক শিক্ষায় ভরপুর থাকে বড় হয়ে সে কখনে বিপথে পা বাড়ায় না। পরিবার,সমাজ তথা রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য সে সর্বোতভাবেই চেষ্টা,শ্রম দিয়ে যায় লাভের আশা না করেই।
কাউন্সিলিং হলো নীতি নৈতিকতা শিক্ষার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।জীবনঘনিষ্ট উদাহরণ দিয়ে শিশুদের বুঝাতে হবে। ছোট ছোট কথা দিয়ে বৃহৎ ভালো মানুষ তৈরির কারখানা আমাদেরই গড়ে তুলতে হবে।মানুষ আর পশুর মধ্যে এই হলো বিরাট পার্থক্য।মানুষকে বুঝালেই সে বুঝে।এবং তার একটি ফলাফল পাওয়া যায়।তাই বলব অধৈর্য না হয়ে দৃঢ়তার সাথে ভাল মানুষ তৈরীর দিকে আমাদের সবার আগে নজর দিতে হবে।তবেই পৃথিবীতে যুদ্ধ বিগ্রহ, যত অশান্তি দূর হবে। ঘুষ, দূর্নীতি করার আগে শিশুকালের খাঁটি নীতি নৈতিকতার শিক্ষা পরিণত বয়সে খারাপ কাজ করতে মানুষকে বাঁধা দেবে নিশ্চয়ই। মানুষ তার দেখা পরিবেশের সঠিক শিক্ষায় এতটাই অনুগত এবং নিজের উপর আস্থাভাজন হয়ে থাকলে তা উগরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
এ পি জে আবুল কালাম বলেছেন, তুমি তোমার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারবে না কিন্তু তোমার অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারবে এবং তোমার অভ্যাসই নিশ্চিতভাবে তোমার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করবে। এতে বুঝা যায় মানুষ যদি ষড়রিপুর মাঝে পর্যবসিত হয়েই থাকে তবুও যখনি সে বুঝতে পারে আসল ভালটা কী তখন সে নিজেই সরে আসে অনন্যধারায়। জন্ম হলেই মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবী। জীবনের প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত মৃত্যুকে স্মরণে আনতে হবে। এ জগত তো আমাদের চিরতরে থাকার জায়গা নয়।তা শিশুর মস্তিষ্ক ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করে দিতে হবে।এবং শিশুর মনে নীতি নৈতিকতার প্রশান্তির সুবাতাস,সফলতার গল্পের অনুরণন অনুসৃত করতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক