শিবরাত্রি ব্রত ও প্রাসঙ্গিক

35

বিপ্লব কান্তি নাথ

‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’ এই তিনটি শব্দের মধ্যেই শিব শব্দের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়। শিব ও সত্য পরস্পর এক ও অভিন্ন। তাই শিবরাত্রিতে সত্য জীবনযাপনের জন্য নতুন করে সংকল্প করতে হয়। ঐ সত্যনিষ্ঠা মন বাক্য ও আচরণে সর্বদা যতœ সহকারে পালন করা হলেই পরম সুন্দর শিব-চেতনায় মনটা ভরে ওঠে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন ‘সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়। কিন্তু কোনও কিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।’ কারণ সত্যকে আশ্রয় করে থাকলেই মানবিক গুণগুলি মনকে অবলম্বন করে থাকে। অন্যথায় দয়া মায়া মমতা ধৈর্য সহিষ্ণুতা ভালবাসা ক্ষমা করার ইচ্ছা ইত্যাদি গুণগুলি ক্রমে ক্রমে সরে যায়। শ্রীমা সারদামণি স্বয়ং বলেছেন‘যে সত্যে আছে সে ভগবানের কোলে শুয়ে আছে।’
শিবরাত্রিব্রত শুরুর কথা : পুরাকালের কথা। তখন কৈলাশ পর্বতের শিখর ছিল সর্বরতেœ অলংকৃত। ছিল ছায়াসুনিবীড় ফুলে-ফলে শোভিত বৃক্ষ, লতা ও গুল্মে ঢাকা। পারিজাতসহ অন্যান্য পুষ্পের সুগন্ধে চারদিক থাকত আমোদিত। এখানে সেখানে দল বেঁধে নৃত্য করে বেড়াত অস্পরারা। ধ্বনিত হতো আকাশ গঙ্গার তরঙ্গ-নিনাদ। ব্রহ্মার্ষিদের কন্ঠ থেকে শোনা যেত বেদধ্বনি।
কৈলাশশিখরে শিব-পার্বতী বাস করতেন। গন্ধর্ব, সিন্ধ, চারণ প্রভৃতি তাদের সেবা করত। পরম সুখে ছিলেন শিব-পার্বতী। একদা পার্বতী শিবকে প্রশ্ন করলেন, ভগবান, আপনি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ-দাতা। আপনি কোন ব্রত বা তপস্যায় সন্তুষ্ট হন?
দেবী পার্বতীর কথা শুনে শিব বললেন, দেবী, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথীর রাত্রিকে শিবরাত্রি বলা হয়। এ রাত্রিতে উপবাস করলে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হই। স্নান, বস্ত্র, ধূপ, পুষ্প ও অর্চনায় আমি যতটুকু সন্তুষ্ট হই তার চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হই শিবরাত্রির উপবাসে।
তিনি আরও বলেন, ব্রতপালনকারী ত্রয়োদশীতে স্নান করে সংযম পালন করবে। স্বপক্ষ নিরামিষ বা হবিষ্যান্ন ভোজন করবে (ভূমি বা বালু বিছানো যজ্ঞবেদী) অথবা কুশ বিছিয়ে শয়ন করে আমার (অর্থাৎ শিবের) নাম স্মরণ করতে থাকবে। রাত্রি শেষ হলে শয্যা ত্যাগ করে প্রাতঃ ক্রিয়াদি করবে অন্যান্য আবশ্যক কার্যাদি করবে। সন্ধ্যায় যথাবিধি পূজাদি করে বিল্বপত্র সংগ্রহ করবে। তারপর নিত্যক্রিয়াদি করবে। অতঃপর (যজ্ঞবেদীতে), সরোবরে, প্রতীকে বা প্রতিমায় বিল্বপত্র দিয়ে আমার পূজা করবে। একটি বিল্বপত্র দ্বারা পূজা করলে আমার যে প্রীতি জন্মে, সকল প্রকার পুষ্প একত্র করে কিংবা মণি, মুক্তা, প্রবাল বা স্বর্ণনির্মিত পুষ্প দিয়ে আমার পূজা করলেও, আমার তার সমান প্রীতি জন্মে না। প্রহরে প্রহরে বিশেষভাবে স্নান করিয়ে আমার পূজা করবে। পুষ্প, গন্ধ, ধূপাদি দ্বার যথোচিত অর্চনা করবে। প্রথম প্রহরে দুগ্ধ, দ্বিতীয় প্রহরে দধি, তৃতীয় প্রহরে ঘৃত এবং চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে আমাকে স্নান করাবে এবং পূজা করবে। এছাড়া যথাশক্তি নৃত্যগীতাদি দ্বারা আমার প্রীতি সম্পাদন করবে।
হে দেবী, এই হলো আমার প্রীতিকর ব্রত। এ ব্রত করলে অপস্যা ও যজ্ঞের পূণ্য লাভ হয় এবং ষোল কলায় দক্ষতা জন্মে। এ ব্রতের প্রভাবে সিদ্ধি লাভ হয়। অভিলাষী ব্যক্তি সপ্তদীপা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়। শিব পার্বতীকে আরও বলেন, এবার শিবচতুদর্শী তিথির মাহাত্ম বলছি, শোন।
একদা সর্বগুণযুক্ত বারাণসী পুরীতে ভয়ঙ্কর এক ব্যাধ বাস করত। বেঁটে-খাটো ছিল তার চেহারা, আর তার গায়ের রং ছিল কালো। চোখ আর চুলের রং ছিল কটা। নিষ্ঠুর ছিল তার আচরণ। ফাঁদ জাল, দড়ির ফাঁস এবং প্রাণী হত্যার নানা রকম হাতিয়ারে পরিপূর্ণ ছিল তার বাড়ি।
একদিন সে বনে গিয়ে অনেক পশু হত্যা করল। তারপর নিহত পশুদের মাংসভার নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো। পথে ক্লান্ত হয়ে সে বনের মধ্যে বিশ্রামের জন্য একটি বৃক্ষমূলে শয়ন করলে এবং একটু পরেই নিদ্রিত হলো।
সূর্য অস্ত গেল। এলো ভয়ঙ্কর রাত্রি। ব্যাধ জেগে উঠল। ঘোর অন্ধকারে কোনো কিছুই কারও দৃষ্টিগোচর হলো না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে একটি শ্রীফলবৃক্ষ অর্থাৎ বিল্ববৃক্ষ পেল। সেই বিল্ববৃক্ষে সে লতা দিয়ে তার মাংসভার বেঁধে রাখল। বৃক্ষতলে হিংশ্র জন্তুর ভয় আছে। এই ভেবে সে নিজেও ঐ বিল্ববৃক্ষে উঠে পড়ল। শীতে ও ক্ষুধায় তার শরীর কাঁপতে লাগল। এভাবে সে শিশিরে ভিজেই জেগে কাটাল সারা রাত।
দৈববশত সেই বিল্ববৃক্ষমূলে ছিল আমার (অর্থাৎ শিবের) একটি প্রতীক। তিথিটি ছিল শিবচতুর্দশী। আর ব্যাধও সেই রাত্রি কাটিয়েছিল উপবাসে। তার শরীর থেকে আমার প্রতীকের ওপর হিম বা শিশির ঝরে পড়েছিল। তার শরীরের ঝাঁকুনিতে বিল্বপত্র পড়েছিল আমার প্রতীকের ওপর। এভাবে উপবাসে বিল্বপত্র প্রদানে এবং শিশিরস্নানে নিজের অজান্তেই ব্যাধ শিবরাত্রিব্রত করে ফেলল। দেবী, তিথিমাহাত্মে কেবল বিল্বপত্রে আমার যে প্রীতি হয়েছিল, স্নান, পূজা বা নৈবেদ্যদি দিয়েও সে প্রীতি সম্পাদন সম্ভব নয়। তিথি মাহাত্মে ব্যাধ মহাপুণ্য লাভ করেছিল। পরদিন উজ্জল প্রভাতে ব্যাধ নিজের বাড়িতে চলে গেল।
কালক্রমে ব্যাধের আয়ু শেষ হলো। যমদূত তার আত্মাকে নিতে এসে তাকে যথারীতি যমপাশে বেঁধে ফেলতে উদ্যত হলো। অন্যদিকে আমার প্রেরিত দূত ব্যাধকে শিবলোকে নিয়ে এল। আর আমার দূতের দ্বারা আহত হয়ে যমদূত যমরাজকে নিয়ে আমার পুরদ্বারে উপস্থিত হলো। দ্বারে শিবের অনুচর নন্দীকে দেখে যম তাকে সব ঘটনা বললেন। এই ব্যাধ সারা জীবন ধরে কুকর্ম করেছে। জানালেন যম।
তার কথা শুনে নন্দী বললেন, ধর্মরাজ, এতে কোনো সন্দেহই নেই যে ঐ ব্যাধ দুরাত্মা। সে সারা জীবন অবশ্যই পাপ করেছে। কিন্তু শিবরাত্রি ব্রতের মাহাত্মে সে পাপমুক্ত হয়েছে এবং সর্বেশ্বর শিবের কৃপা লাভ করে শিবলোকে এসেছে।
নন্দীর কথা শুনে বিস্মিত হলেন ধর্মরাজ। তিনি শিবের মাহাত্মর কথা ভাবতে ভাবতে যমপুরীতে চলে গেল। শিব পার্বতীকে আরও বলেলেন, এই হলো শিবরাত্রিব্রতের মাহাত্ম। শিবের কথা শুনে শিবজায়া হিমালয় কন্যা পার্বতী বিস্মিত হলেন। তিথি শিবরাত্রিব্রতের মাহাত্ম্য নিকটজনের কাছে বর্ণনা করলেন। তারা আবার তা ভক্তি ভরে জানালেন পৃথিবীর বিভিন্ন রাজাকে। এভাবে শিবরাত্রিব্রত পৃথিবীতে প্রচলিত হলো।
পুরাণমতে শিবরাত্রির আগের দিন অর্থাৎ ত্রয়োদশী তিথিতে সংযমী থেকে চতুর্দশীতে উপবাস করে পঞ্চাক্ষর মন্ত্র ‘নমঃ শিবায়’ উচ্চারণে ভক্তরা ভক্তি নিবেদন করে। পরে রাতে শিবলিঙ্গকে প্রথম প্রহরে ‘হ্রীং ঈষণায় নমঃ’ মন্ত্রে দুধ দিয়ে দ্বিতীয় প্রহরে ‘হ্রীং অঘোরায় নমঃ’ মন্ত্রে দই দিয়ে তৃতীয় প্রহরে ‘হ্রীং বামদেবায় নমঃ’ মন্ত্রে ঘি দিয়ে এবং চতুর্থ প্রহরে ‘হ্রীং সদ্যোজাতায় নমঃ’ মন্ত্রে মধু দিয়ে স্নান করিয়ে পুজো করতে হয়। শিবরাত্রি ব্রতের অধিকারী রূপে নারী-পুরুষের কোনও ভেদ না থাকায় যে কোনও নারী বা পুরুষ বাল্যে মধ্যবয়সে অথবা বার্ধক্যে এই ব্রত পালন করতে পারে। আমাদের সমাজে যদিও মেয়েরাই বেশিরভাগ এই ব্রত পালন করে থাকে। কারণ‚শিবের মতো বর পাওয়ার আকাক্সক্ষা ছোটবেলা থেকেই তাদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত বর্তমানে সাধারণ মানুষের মধ্যে সত্যনিষ্ঠা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। জীবনের মূল্যবোধও লুপ্তপ্রায়। সারা বছর নানারকম উৎসব চলে। কিন্তু উৎসবের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কর্মকর্তারা অজ্ঞান। ফলে ভোগসর্বস্ব শৃঙ্খলাহীন নিয়মানুবর্তিতাহীন সত্যহীন আচরণেই তারা মেতে উঠেছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের হাতে সত্য লাঞ্ছিত অবহেলিত। তাই আজকের দিনে ভক্তি ভরে শিবরাত্রি পালন করা প্রয়োজন। শিবের কৃপা লাভ করলেই সমাজে শান্তি ফিরে আসবে।
লেখক: সংবাদকর্মী