শিবনারায়ণ রায়

25

বিংশ শতাব্দীর স্বনামধন্য বাঙালি চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, এবং সাহিত্য সমালোচক। একজন রাডিকেল মানবতাবাদী মানবেন্দ্রনাথ রায়, এবং বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল, রায়ের উপরে মন্তব্য করে একদা বলেছেন… শিবনারায়ণ রায় দাঁড়িয়েছেন সেই মতের পক্ষে যেটাকে আমি পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। … … তার লেখা আমাদের সময়ের অধিকাংশ লেখকের চেয়ে বেশি যুক্তিগ্রাহ্য হিসেবে প্রকাশিত।
শিবনারায়ণ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালে ২০ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। পিতা খ্যাতনামা সংস্কৃতবিদ, আদর্শ শিক্ষাব্রতী, বেদ, বেদান্ত, জৈন ও বৌদ্ধশাস্ত্রে সুপÐিত উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ শাস্ত্রী। মাতা রাজকুমারী রায়চৌধুরীও ছিলেন একজন লেখিকা। তিনি নিয়মিত বামাবোধিনী, শিবম, অন্তপুর এবং মহিলা পত্রিকায় লিখতেন। এঁদের পৈতৃক যোগ ছিল পূর্ববঙ্গের বরিশালের রায়েরকাঠি রাজবংশের সাথে। চিরাচরিত হিন্দু আচারনিষ্ঠ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও আমৃত্যু ঘোষিত নাস্তিক ছিলেন শিবনারায়ণ। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে রেজিনা গুহ স্বর্ণপদক নিয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজী সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন । ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পনেরো বছর এখানে কাজ করে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংরাজী ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে তৎকালীন বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতবিদ্যা’ বিভাগের প্রধান হিসাবে অধ্যাপনা করার জন্য অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজে যোগ দেন। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে অবসর নেওয়ার সময় তিনি ছিলেন ভারততত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান। দেশে ফেরার পর তিনি বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষ হন। পরে দীর্ঘদিন ‘রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি ফাউন্ডেশনের’ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তার আলাপ হয় বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে। এরপর আমৃত্যু তিনি মানবেন্দ্রনাথের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। নাস্তিক, যুক্তিবাদ, বুদ্ধির মুক্তি ও মানবতাবাদের সপক্ষে তিনি সক্রিয় ছিলেন। একাধিক কর্মকান্ডে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রতিবাদ করেছেন। বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী সহ সমকালীন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি বিশিষ্ট রসবেত্তা হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রচর্চাতেও। তার সম্পাদিত ত্রৈমাসিক ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ছিলেন। কলকাতার রাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট সংস্থার প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনি । সূত্র: বাংলাপিডিয়া
তিনি মননশীল সাহিত্য ত্রৈমাসিক জিজ্ঞাসা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে- সাহিত্য চিন্তা, নায়কের মৃত্যু, কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা, রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়র ও নক্ষত্রসংকেত, খাড়াইয়ের দিকে, স্বদেশ, স্বকাল, স্বজন, বিবেকী বিদ্রোহের পরম্পরা, বাঙালিত্বের খোঁজে ও অন্যান্য আলোচনা, প্রবাসের জার্নাল, মৌমাছিতন্ত্র, গণতন্ত্র, সংস্কৃতি ও অবক্ষয় প্রভৃতি।
এছাড়া তার উলে­খযোগ্য কীর্তি বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের জীবনী রচনা ও তার নির্বাচিত রচনা সম্পাদনা – ঝবষবপঃবফ ড়িৎশং ড়ভ গ.ঘ.জড়ু, অধ্যাপক শিবনারায়ণ কলকাতা ও শান্তিনিকেতনের পুর্বপঠল্লী দু-জায়গাতেই বাস করতেন। বার্ধক্য জনিত কারণে তার মৃত্যু হয় শান্তিনিকেতনে। চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহারের জন্য তার ইচ্ছানুসারে দেহদান করায় শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতার এস.এস.কে.এম. হাসপাতালে তার মরদেহ সমর্পণ করা হয়। সূত্র: বাংলাপিডিয়া