শিপইয়ার্ডে দীর্ঘ হচ্ছে ‘মৃত্যুর মিছিল’

85

শিপইয়ার্ডে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। কোনোভাবেই থামছে না এ মিছিল। প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। নিহত হচ্ছেন শ্রমিকরা। গত ১০ বছরে মারা গেছেন অন্তত ২৫০ জন শ্রমিক। আহত হয়েছেন ১ হাজারেরও বেশি। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক নেই কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সর্বশেষ গতকাল মারা গেছেন তিন শ্রমিক।
জানা যায়, ১৯৬০ সালে বঙ্গোপসাগর উপকূলের সীতাকুন্ডে এমডি আলপাইন নামে বিকল হওয়া একটি জাহাজ কাটার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ‘জাহাজ ভাঙা’ শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। অর্ধশত বছর পেরিয়ে সীতাকুন্ড উপকূলে এখন বছরে জাহাজ ভাঙা হয় ৮০ থেকে ১০০টি। দেশে ইস্পাতের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশের যোগান আসে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। দিনে দিনে বেড়েছে এই শিল্পের পরিধি। ব্যবসার আকার ১০ হাজার কোটি টাকারও উপরে।
স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও মৃত্যুঝুঁকি জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের নিত্যসঙ্গী। দুর্ঘটনায় আহত বা নিহতের ঘটনাও ঘটে প্রায়ই। তবে পরিচয়পত্র কিংবা নিয়োগপত্র না থাকায় শ্রমিকরা একদিকে যেমন কর্মকালীন বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন, অন্যদিকে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে নিহতের পরিবার সম্মুখীন হয় মৃত্যু-পরবর্তী ক্ষতিপূরণপ্রাপ্তির জটিলতায়। শেষ পর্যন্ত অনেক শ্রমিক বঞ্চিত হন কর্মকালীন মৃত্যু বা দুর্ঘটনার কারণে শারীরিক ক্ষতির কারণে প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ থেকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সীতাকুন্ড উপকূলজুড়ে গড়ে উঠেছে শতাধিক শিপ উয়ার্ড। এসব শিপ ইয়ার্ড চরম ঝুঁকিতে। নীতিমালার তোয়াক্কা না করায় এসব ইয়ার্ডে একের পর এক ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সরকার এটিকে শিল্প ঘোষণা করার পরও এসব ইয়ার্ডে গড়ে তোলা হয়নি কোনোরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ফলে চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন এখানকার শ্রমিকরা। দীর্ঘদিন ধরে এসব শিপ ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিক মারা যাওয়ায় সরকার এই শিল্পকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি নীতিমালার আওতায় নিয়ে আসে।
বিগত সময়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ অক্যুপেশনাল সেইফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রণমেন্ট ফাউন্ডেশন (ওশি) শিপ ইয়ার্ডে দুর্ঘটনার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, জাহাজ থেকে পড়ে যাওয়া, লোহার পাতের ধাক্কা বা নিচে চাপা পড়া, অগ্নিকান্ড, এস্কেভেটরের আঘাত ও বিষাক্ত গ্যাসে আটকা পড়া। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, অধিকাংশ ইয়ার্ডের মালিক তাদের শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ, হেলমেট, সেইফটি জ্যাকেট ও বুট ইত্যাদি সরবরাহ করেন না। অন্যদিকে যেসব ইয়ার্ডে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা হয় সেখানকার শ্রমিকরাও এসব ব্যবহারে উদাসীন থাকেন।
সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বের বৃহত্তম এই জাহাজভাঙা শিল্প এলাকায় ১৮৬টি শিপ ইয়ার্ডের পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। তবে বর্তমানে চালু রয়েছে ৬০ থেকে ৮০টি শিপ ইয়ার্ড। সীতাকুন্ডের মাদাম বিবির হাট, কুমিরা, ভাটিয়ারি, সোনাইছড়ি, জাহানাবাদ, কদমরসূল, বাঁশবাড়িয়া উপকূলজুড়ে এগুলোর অবস্থান। এসব ইয়ার্ডে সরাসরি কাজ করছে ২২ হাজার শ্রমিক, পরোক্ষভাবে যুক্ত আছে আরো ১০ হাজার। উন্মুক্ত সৈকতে ঝুঁকিপূর্ণ বিচিং পদ্ধতিতে জাহাজ কাটতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছেন অতি দরিদ্র এসব শ্রমিক। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ বিচিং পদ্ধতিতে জাহাজভাঙার কাজ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই নিষিদ্ধ। তাছাড়া ইয়ার্ডগুলোতে ক্ষতিকর অ্যাসবেসটসের সংস্পর্শে শ্রমিকরা ক্যান্সারের ঝুঁকিতে পড়ছেন। ২০১৫ সালের বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালায় মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে সেইফটি কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে এই বিধি এখনো পুরোপুরি মেনে চলা হচ্ছে না।
শিপ ব্রেকার্স ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের সভাপতি তপন দত্ত বলেন, শিপ ইয়ার্ড শ্রমিকদের কোনো ধরনের উন্নতি হয়নি। তারা আগের মতই রয়ে গেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করে। শ্রমিকরা প্রতিনিয়তই মারা যাচ্ছে। তাদের জীবনের কোনো গ্যারান্টি নেই। সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, হতাহত শ্রমিকরা বিধি মোতাবেক ক্ষতিপূরণও পায় না।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) সভাপতি আবু তাহের কয়েকদিন আগে সাংবাদিকদের বলেন, শিপ ইয়ার্ডে সবার আগে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দেই। কোনো ধরনের দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেদিকে আমাদের নজর থাকে। প্রতিটি ইয়ার্ডকে সেটা বলাও আছে। তিনি বলেন, কোনো কারণে দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা হতাহত হলে বিধি মোতাবেক ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়।
হাইকোর্টে দেয়া একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সীতাকুন্ডের জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে গত ১০ বছরে দুর্ঘটনায় অন্তত ২৫০ জন শ্রমিক মারা গেছেন। এই সময়ে এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক আহত হয়েছেন। এসময় এক আদেশে আদালত শিপইয়ার্ডে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অব্যাহত পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিধিমালা তৈরির নির্দেশ দেন।
শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি শিপইয়ার্ডগুলো পরিবেশকেও অনিরাপদ করে তুলেছে বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর। স্ক্র্যাপ জাহাজে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য, অ্যাসবেস্টস, গ্লাসহোল, লুব্রিকেন্ট ওয়েলসহ নানা ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর বর্জ্য থাকে। এসব বর্জ্য পরিবেশসম্মত উপায়ে অপসারণের বিধান থাকলেও শিপইয়ার্ডগুলো সেই বিধান মানছে না বলে অভিযোগ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক (কারিগরি) মুক্তাদির হাসান সম্প্রতি জানান, সীতাকুÐে সর্বমোট ১৮৬টি শিপ ইয়ার্ডের পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। এরমধ্যে গ্রীণ শিপ ইয়ার্ড রয়েছে মাত্র ৬টি। আমরা নিয়মিত সেখানে পরিদর্শন করি। পরিবেশ আইন না মানায় জরিমানও করেছি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে।
এনজিও সংস্থা ওশির তথ্য অনুযায়ী, শিপ ইয়ার্ডে দুর্ঘটনায় ২০১৭ সালে ১৫ শ্রমিক নিহত ও আহত হয় ২২ জন। ২০১৬ সালে নিহত ২৩, আহত ৩১। ২০১৫ সালে নিহত ১৪, আহত ২৭। ২০১৪ সালে নিহত ১৫, আহত ৩৪। ২০১৩ সালে নিহত ২৬, আহত ৪০ জন শ্রমিক। চলতি বছর এ পর্যন্ত ১০ জন শমিক নিহত হয়েছেন।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শিপ ইয়ার্ডে শ্রমিকরা কাজ করছেন। তাদের তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় না। নীতিমালাও মানছে না।
জানা যায়, গতকাল সীতাকুণ্ড উপজেলার শীতলপুরে ম্যাক কর্পোরেশন নামে একটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে তিনজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার আমজাদ ব্যাপারীর ছেলে নান্টু হোসেন (২৪), একই উপজেলার গফফার মাতব্বরের ছেলে মোহাম্মদ রাসেল (২৫) ও কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার আবু তাহেরের ছেলে ছবিদুল (২৬)।