শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লম্বা ছুটি কেমন আছে আমাদের শিশুরা ?

51

এমরান চৌধুরী

আমাদের শিশুদের কাছে ছুটি শব্দটা খুব প্রিয়। শুধু ছোটদের নয়, বড়দের কাছেও এই শব্দটা সমান প্রিয়। তবে স্কুলের ছুটি, স্কুলের বন্ধ ব্যাপারটায় আলাদা একটা আবেগ থাকে যা একজন মানুষকে সারাজীবন পুলকিত করে, হয়ে ওঠে স্মৃতি রোমন্থনের অন্যতম অনুষঙ্গ। ছোটবেলার স্কুল ছুটির ঢং ঢং ঘণ্টা ধ্বনি এখনো হাতছানি দেয়, মনকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় সেই শৈশব-কৈশোরে। স্কুল ছুটির পর বই-খাতা বগলে চাপিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে বাড়ি ফেরার দৃশ্য এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। বাড়ি ফিরতে গিয়ে কত কৃষকের ধান,পাট, সর্ষে, আখ, আলুক্ষেত যে মাড়িয়েছি তার কোনো সীমা নেই। সময়ের পরিবর্তন হয়েছে, কাদায় পিচ্ছিল রাস্তা পাল্টে হয়েছে পিচ ঢালা পথ। হারিকেনের নিভু নিভু সলতের জায়গায় এসেছে আলো জ্বলমলে বাতি। লুঙ্গি পরা শিক্ষার্থীদের পরনে এখন অনেক দামি জামা-জুতো। আমি আজ কানাই মাস্টারের জায়গায় এসেছে হ্যান্ডসাম টিচার। গ্রীষ্মকালে টিনের ফুটো ভেদ করে রোদের তাপ, বর্ষায় ছাদ ছুঁয়ে বৃষ্টি আর শীতের শিশির স্নাত স্কুল এখন রূপ নিয়েছে আলীশান দালানে। একবই বাঁধাই করে একই পরিবারের ভাইবোনেরা তিন চার বছর পড়ার বদলে আজিকার শিশুরা পাচ্ছে বছরের শুরুতে নতুন নতুন বই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদার সমান্তরাল রেখায় সব কিছুতে পরিবর্তন আসলেও একটা বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আসেনি তাহলো ছুটি। ছাত্র -ছাত্রী মাত্রই ছুটির কথা শুনলেই লাফিয়ে ওঠে ঘাস ফড়িঙের মতো। আর আপন মনে গাইতে থাকে, ‘আজ আমাদের ছুটি, ও ভাই আজ আমাদের ছুটি।’ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ কবিতাটি একবারের জন্যেও আওড়াইনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
বাংলা সাহিত্যে ছুটি নিয়ে কত সংখ্যক ছড়া কবিতা, গল্প লেখা হয়েছে তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। তবে শিশুমন মাত্রই ছুটি প্রিয়, স্বাধীন। আকাশে ডানা মেলে যেমন ইচ্ছে ডিগবাজি খাওয়া পাখির মতো প্রত্যেক মানব শিশু। তারা বাঁধনহারা। শিশুকিশোরদের মনে নিয়ত ইচ্ছে জাগে বেরিয়ে পড়ার। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিশুমনের এই স্বাভাবিক প্রবণতাকে তুলে ধরেছেন তাঁর সংকল্প কবিতায় বহুমাত্রিক চিত্রকল্পে অপূর্ব ছন্দের হিন্দোলে— ‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে/ কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।’ এভাবে আমাদের শিশুরা ছুটে বেড়াতে চায়, তার জন্যে চাই ছুটি। ছুটি পেলেই বেড়ানো যায় মামার বাড়ি। আর এজন্যই হয়তো সেই অনেক আগে থেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রয়েছে গ্রীষ্মের ছুটি। আর ছুটি মানে মজা। ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা/ফুল তুলিতে যাই/ ফুলের মালা গলায় দিয়ে/ মামার বাড়ি যাই/ ঝড়ের দিনে মামার দেশে / আম কুড়াতে সুখ/ পাকা জামের মধুর রসে/ রঙিন করি মুখ।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কালজয়ী ছোটগল্পের নাম ‘ছুটি’। গ্রামের আলো বাতাসে মায়ের স্নেহের আঁচলে বেড়ে ওঠা এক কিশোর চরিত্রের নাম ফটিক। মায়ের নিষেধ মানা না মেনে গ্রামকে মাথায় তুলে দাপিয়ে বেড়ানো এই কিশোর মামার সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে ক’দিনে মধ্যে হাঁপিয়ে ওঠে। ফলে সে নিজের বাড়িতে ফিরে আসার জন্যে অস্হির হয়ে ওঠে। মামা তাকে স্কুল বন্ধ হলে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। শেষ পর্যন্ত গ্রামের চির চেনা দূরন্তদের প্রতীক কিশোর ফটিক যে ছুটি পায় তা তার কাঙ্খিত ছিল না। স্কুলের ছুটির বদলে তার হয়ে যায় জীবনেরই ছুটি,’ আমার ছুটি হয়েছে মা, আমি বাড়ি যাচ্ছি।’
মানুষ জীবনে অনেক ঘটনা দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় তার জন্যে কোনো মানুষই আগে থেকে তৈরি থাকে না। বর্তমানে যে বৈশ্বিক মহামারী চলছে তার জন্যে বাংলাদেশের মানুষতো বটেই পৃথিবীর কোনো প্রান্তের মানুষ তৈরি ছিল না। এই মহামারী থেকে বাঁচাতে পৃথিবীর অন্যদেশের মতো বাংলাদেশেও সকল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এইচ এস সি পরীক্ষা স্হগিত করা হয়েছে। আগামী ৩১ মে পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে এই বন্ধ কতদিন নাগাদ চলতে পারে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে এ কথা নিশ্চিত যে করোনা ভাইরাস পরিস্হিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সম্ভাবনা নেই। তাই অবস্থাদৃষ্টে এটা স্পষ্ট যে আমাদের শিশুরা অনাকাক্সিক্ষত দীর্ঘ ছুটিতে পড়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ৪৯ বছরের মধ্যে এই প্রথম এমন এক অনাকাক্সিক্ষত লম্বা ছুটিতে পড়েছে আমাদের শিশুরা যাকে ছুটি না বলে বলা যেতে পারে গৃহবন্দী জীবন। ছুটি মানে মজা। যেখানে মজাই নেই সেখানে ছুটি বলে আর কিছুই থাকতে পারে না। ফলে করোনা ভাইরাসজনিত মহামারীর কারণে বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও ইতিমধ্যে হাঁপিয়ে ওঠেছে।
বর্তমানে আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের হার দিন দিন বেড়ে চলেছে। আমাদের এক একটা দিন যাচ্ছে এক একটা বছরের মতো। বড়দের যেখানে এই অবস্থা সেখানে শিশুরা কতটা ভালো আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেদিন ছোট শিশুদের নিয়ে করা করোনাকালের একটি ভিডিও দেখছিলাম। মা চাকুরিজীবী। চাকুরি করেন জরুরি সার্ভিসের আওতায়। বাসায় দুটো যমজ শিশু সামলাতে হয় বাবাকে। বাবা একটু চোখের আড়াল হলে শিশু দুটো পরস্পরের মধ্যে এটা ওটা নিয়ে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেয়। বাবা এই মিটমাট করে দিলো তো পরক্ষণে শুরু করে একই খেলনা নিয়ে টানাটানি। এমনকি একজন আরেকজনকে টেনে খাটের নিচে নিয়ে যায়। এরকম হাজার শিশু নিয়ে বিপাকে আমাদের অভিভাবকরা। যাদের স্কুলে সময় কাটানোর কথা, স্কুল বন্ধ বলে স্কুলে যাওয়া হচ্ছে না। বাইরে বেরুবে বাসাবাড়িতে এরকম জায়গা নেই বললেই চলে। পাশের বাসার ছেলেমেয়েদের সাথে খেলবে এই সুযোগও কেড়ে নিয়েছে করোনা। প্রত্যেক বাসার অভিভাবকরা নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে যার যার ছেলেমেয়েদের নিজেদের হেফাজতে রাখছে। এই অবস্থায় শিশুরা মোটের ওপর ভালো নেই। এ অবস্থায় অভিভাবকদের নিজ নিজ ছেলেমেয়েদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। করোনা যাতে আমাদের শিশুদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে নজর রাখা এ মুহূর্তে সবচে বেশি জরুরি। করোনা শিশুদের স্কুল, ছোটাছুটি, আনন্দ ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখাশোনার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করলেও মা-বাবাকে সার্বক্ষণিক কাছে পাওয়ার একটি বিরল সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা বন্ধের দিন এবং কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া ছাড়া খুব একটা হয়ে উঠত না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লম্বা ছুটিকালীন আমাদের শিশুরা যাতে শারীরিক, মানসিকভাবে সুস্থ থাকে, তারা যাতে কোনো মানসিক চাপের মুখোমুখি না হয়, তারা যাতে কোনো অস্হিরতার মুখে না পড়ে, তাদের আবেগের যাতে ভারসাম্য বজায় থাকে সেজন্য নিম্নোক্ত কাজগুলো করা জরুরি:
অভিভাবকদের টিভিতে প্রচারিত খবর এবং নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যতটা সম্ভব পরিহার করতে হবে। কারণ করোনার নানা খবর, ফেসবুকের স্ট্যাটাস শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পরিবারের বড়দের মধ্যে নানা বিষয়ে তিক্ত কথাবার্তা হয়ে থাকে। এই সময়ে তা এড়িয়ে চলতে হবে। পাশের বাসাবাড়িতে কেউ করোনা আক্রান্ত হলে সে বিষয়ে শিশুদের সামানে কথা না বলাই ভালো। এতে শিশুর কোমল মনে ভীতির সঞ্চার হতে পারে। পরিবারের সদস্যদের একটা নির্দিষ্ট সময়ে শিশুদের নিয়ে বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম দেখতে হবে। শিশুরা টিভি অন করলে তাদের বকাবকি না করে তারা কি দেখছে তাদের পাশে বন্ধুর মতো বসে পরখ করতে হবে। যদি তারা কার্টুন, সুস্থ বিনোদন বা জিওগ্রাফিক্যাল কোনো চ্যানেল দেখতে থাকে অভিভাবকদেরও আগ্রহভরে সেই অনুষ্ঠান দেখতে হবে। এতে শিশুরা খুশি হবে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তারা সে অনুষ্ঠান দেখতে অভ্যস্ত হবে। স্কুল পড়ুয়া শিশুদের তাদের স্কুলের আদলে একটা রুটিন করে দিতে হবে। রুটিনে ঘুম থেকে ওঠা, প্রাতরাশ, সকালের পড়া, বিশ্রাম, গোসল, দুপুরের খাবার, বিশ্রাম, শারীরিক ব্যায়াম, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আড্ডা, রাতের খাবার ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অনেক শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতা রয়েছে, যেমন কেউ ছবি আঁকতে, কেউ গান বা নাচতে ভালোবাসে। রুটিনে তা অন্তর্ভুক্ত করে একটা নির্দিষ্ট সময়ে তা করতে দিতে হবে। সম্ভব হলে শিশুকে তার প্রিয় বন্ধুর অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করে টেলিফোনে বা ভিডিও কলের মাধ্যমে আলাপ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এতে ঘরবন্দী জীবনে স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে কুশল বিনিময় করে উভয় পরিবারের শিশুরা উৎফুল্ল হবে।
শিশুকে ব্যস্ত রাখতে নিজের রুম, পড়ার টেবিল, ডেস্ক পরিষ্কার করা, বিছানা গোছানোর মতো ছোট ছোট কাজ করতে উৎসাহ দিতে হবে। আমাদের অনেক পরিবারে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু রয়েছে, এই সময়ে তাদের প্রতি বেশি বেশি যতœ নিতে হবে। এসব শিশুদের মান অভিমান, আবেগ স্বাভাবিক শিশুদের চাইতে বেশি। স্বাভাবিক শিশুদের বর্তমান সমস্যার কথা যতটা সহজে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব ওদের বেলায় তা ততটাই কঠিন। এজন্যে অভিভাবকদের বেশ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা চলমান সময়ের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রেখে আমরা যদি একটা শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলি এবং শিশুদের চলতে সহায়তা করি তাহলে এমন বৈরী সময়েও সবাই ভালো থাকতে পারি।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক