শিক্ষা, নৈতিক মূল্যবোধ ও শিক্ষকের দায়বদ্ধতা

30

ইলিয়াছ হোসেন রানা

 

সভ্যতার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয় গ্রিসে। কালক্রমে তার বিস্তার ঘটতে থাকে বিভিন্ন দেশে। শিক্ষার আলোয় সভ্য হতে থাকে মানুষ। বাহ্যিক জগতের মতো তৈরি হয় আরেকটি জগৎ আর সেটা হলো মানুষের মানসজগৎ। আর এই মানসজগতের ভিত্তিমূলে রয়েছে শিক্ষা তথা জ্ঞানজগৎ। বিশ্বসভ্যতায় তাই শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর এই শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়েই মানুষ হয়েছে মানুষ। তাই আজকের এই জগৎসভ্যতার অগ্রগতি ও প্রগতির মূলে রয়েছে শিক্ষা। বার্ট্রান্ড রাসেল তার শিক্ষা ও সমাজকাঠামো গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন, শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে তিনটি তত্ত¡ রয়েছে। প্রথম তত্ত¡ানুসারে শিক্ষার লক্ষ্য হলো ক্রমোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করা আর ওই সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে এমন প্রভাব দূর করা। দ্বিতীয় তত্ত¡ানুসারে শিক্ষার লক্ষ্য প্রতিটি ব্যক্তিকে সংস্কৃতিবান করে তোলা এবং ব্যক্তির দক্ষতার সর্বোচ্চ বিকাশ। তৃতীয় তত্ত¡ মতে শিক্ষার লক্ষ্য বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি নয়, গোটা স¤প্রদায় এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে কেজো নাগরিক তৈরি করা। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তার শিক্ষার লক্ষ্য প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, ‘মানুষ স্বভাবতই দ্বিজ, অর্থাৎ শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়েই মানুষ দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহণ করে। সে নিজেই নিজেকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করার যোগ্যতা রাখে।’
মূল্যবোধ বলতে বলা যেতে পারে এটি এমন বোধ বা উপলব্ধি যা মানুষকে ভালো, সত্য, ন্যায় প্রভৃতিকে গ্রহণ করতে শেখায়। এটি একদিকে আমাদের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সৎ-অসৎ প্রভৃতির মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়, তেমনি উচিত-অনুচিতের দ্ব›েদ্ব সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে। মূল্যবোধ মানব আচরণের নির্ধারক। ব্যক্তিক ও সামাজিক উভয় জীবনেই এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূল্যবোধ মানুষের আচরণের স্থায়ী মানদÐ তৈরি করে। আমরা বর্তমানে পরস্পরবিরোধী বা স্ববিরোধী একটি পৃথিবীতে বাস করছি। যে পৃথিবীতে একদিকে যেমন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দ্রæত এগিয়ে চলছে, অন্যদিকে বেশিরভাগ সমাজেই আজ নৈতিক, মানবিক, আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। পৃথিবীজুড়েই প্রত্যাশিত মানবিক মূল্যবোধের এক রকম বিলুপ্তি লক্ষণীয়। ¯েœহ, ভালোবাসা, আন্তরিকতা, আতিথেয়তা, সৌজন্যবোধ, সততা, শ্রদ্ধাশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সহযোগিতা, বিশ্বস্ততা, বিশুদ্ধতা, ক্ষমাহীনতা, আধ্যাত্মিকতা, ন¤্রতা, বিনয়, পরার্থপরতা, ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি সর্বজন স্বীকৃত, আকাক্সিক্ষত ও লালিত মূল্যবোধগুলো ভয়ঙ্কর রকমে হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বর্তমান সমাজ, রাষ্ট্র তথা সমগ্র পৃথিবীতে হিংসা, ববর্রতা, দলাদলি, মিথ্যাচার, দুর্নীতি, অসহিষ্ণুতা, স্বার্থপরতা, অতিব্যক্তিকেন্দ্রিকতা প্রভৃতি অপ্রত্যাশিতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে সমাজকে করেছে কলুষিত।
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে প্রায়ই আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে ছাত্রছাত্রী কর্তৃক শিক্ষক নিগ্রহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী নিগ্রহ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, খুনের ঘটনা, পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা বা সন্তান কর্তৃক পিতামাতা হত্যা, পরকীয়ার জেরে পিতামাতা কর্তৃক সন্তান হত্যা, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের পারস্পরিক অকথ্য কুভাষণ, দুর্নীতি, ঘুষ, জুলুম, জবরদখল, বিলাসিতা, খাদ্যে ভেজাল ইত্যাদি অমানবিক বিষয়াবলি। এমন বাস্তবতায় মূল্যবোধের শিক্ষা খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। বলা যেতে পারে, এটি আধুনিক সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা বা প্রয়োজন। মূল্যবোধের এমন সংকটের অন্যতম কারণ হলো গতানুগতিক ও আধুনিক জীবনযাত্রার মধ্যকার সংঘাত। কেননা আধুনিক যুগ জ্ঞান ও ক্ষমতার যুগ। এ যুগে জ্ঞানের ক্ষেত্র দ্রæত পরিবর্তনের কারণে মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ এই দ্রæত পরিবর্তনশীল অবস্থায় কোনো জ্ঞানই স্থায়িত্ব পাচ্ছে না। ফলে জ্ঞানের ক্ষেত্রে এ রকম অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। যার ফলে নানাবিধ সংকট তৈরির মধ্য দিয়ে মানব জীবন হয়ে পড়েছে নিয়ন্ত্রণহীন, অস্থিতিশীল, যা থেকে মুক্তির আশা মানব জীবনের সব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট। এ সংকট নিরসনে শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম।
বর্তমানে মূল্যবোধের সংকট দূর করতে হলে শিক্ষাকে যুগোপযোগী মূল্যবোধ সৃষ্টির দায়িত্ব নিতে হবে। মানুষের জীবনের মূল্যবোধগুলো যদি বর্তমান সমাজ জীবনের উপযোগী হয় তবে সংকট নিরসন হবে। এজন্য উপযুক্ত শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিক্ষাদানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা যেতে পারে। পাশাপাশি শিক্ষায় আবশ্যিকভাবে প্রকৃত ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
শিক্ষার কাজ হলো মানুষের মধ্যে নৈতিক চরিত্র গঠন করা। ব্যাপারটি যদি তাই হয় তা হলে শিক্ষা মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সঞ্জীবনীর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। চরিত্র বলতে শুধু নৈতিক চরিত্রকেই বোঝায় না, যে কোনো মানুষের আচার-ব্যবহারও তার অন্তর্ভুক্ত। যে মানুষ বিচার বিশ্বাস, সততা ও দক্ষতার ওপর নির্ভরপূর্বক প্রতিটি কাজ সম্পাদন করে সেই প্রকৃত চরিত্রবান। বর্তমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দোকান, শিক্ষক দোকানদার এবং শিক্ষার্থী খদ্দেরে পরিণত হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক দোকানের পণ্য কেনাবেচার সম্পর্কে রূপ লাভ করেছে। ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে এখানে স্বার্থের যে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব হয়, তার ফলে মানুষের বিকাশ কখনো সমভাবে হয় না। বিকাশটা হয় অসম, যার ফলে এই ধরনের শিক্ষার মধ্যে স্বার্থপর মানুষ সৃষ্টি হয়। মানুষ পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই আজ প্রয়োজন তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীর নৈতিক জাগরণ। কারণ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যদি নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ না ঘটে তাহলে তাদের দ্বারা এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা সংগঠিত হবে না। ফলে বৈশ্বিক মানবিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক