শিক্ষা-উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ জরুরি

86

হাসান মেহেদী

স¤প্রতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে জনঅসন্তোষের বিষয়টি প্রচার মাধ্যমে উঠে এসেছে। এ নিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল দুয়েক দিন মাঠে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছিলো। ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোকেও নিদেনপক্ষে ব্যানার হাতে রাস্তায় দাঁড়তে দেখা গেছে। তবে শিক্ষা উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে সব পক্ষেরই যেনো একরকম গা-ছাড়া ভাব।
ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে সব মহল মোটামুটি সরব থাকলেও খাতা, কলমসহ সকল শিক্ষা উপকরণের মূল্য যে লাগামহীন বাড়ছে সেদিকে না আছে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি, না আছে ছাত্র সংগঠনগুলোর কোন তৎপরতা। বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষা উপকরণের দাম। পরিতাপের বিষয় সে দিকে যেনো সকলেই ভ্রæক্ষেপহীন। বর্তমান বাজারে সকল শিক্ষা সামগ্রীর দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ গুণ, ক্ষেত্রবিশেষে তা ৫০ গুণ পর্যন্ত। কিন্তু নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ, যাদের সন্তানরাই মূলত এদেশে পড়াশোনা করে করে, তাদের আয় বাড়েনি বলতে গেলে। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাসিক বেতনও বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মানুষেরা তাদের আয়ের সঙ্গে বর্ধিত মূল্যের সমন্বয় করতে খাচ্ছেন হিমশিম। তার উপরে ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধি যেনো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। অন্যদিকে, মহামারী করোনার ধকল এখনও সামলে উঠতে পারেনি সাধারণ মানুষ।
করোনার আঘাতে আয় কমেছে শ্রমজীবী মানুষের। স্বাভাবিকভাবেই তার ছাপ পড়েছে শিক্ষাখাতে। অনেক ক্ষেত্রে পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেছে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়ের। নানাবিধ প্রতিকূলতার মাঝেও যারা এখনও ঝরে পড়েনি তাদের জন্যও দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে এই শিক্ষাউপকরণের মূল্যবৃদ্ধি। বই-খাতা-কলমসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের নিয়ন্ত্রণহীন দাম বাড়ার কারণে যারা শত প্রতিকূলতা কাটিয়ে শিক্ষালাভের স্বপ্ন দেখে এসেছে, তাদের করছে হতাশাগ্রস্ত বিষয়টি শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আশংকিত করে তুলবে।
শংকার কথা, অল্প সময়ের ব্যবধানেই কয়েক গুণ বেড়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া কাগজের দাম। কাগজের সাথে তাল মিলিয়ে বাজারভেদে বিভিন্ন ধরনের তৈরিখাতার দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। একই কারণে কয়েকগুণ বেড়েছে সব ধরনের বইয়ের দামও। চিকিৎসাবিদ্যা, প্রকৌশল শিক্ষা ও আইনের বইয়ের দাম এমনিতেই তুলনামূলকভাবে বেশি। অসচ্ছল শিক্ষার্থী যারা ফটোকপি করা বইয়ে নির্ভর করতো, তারাও চোখে শর্ষে ফুল দেখছে। কলম, পেন্সিল, মার্কার, কালি, চক, স্লেট, ক্যালকুলেটর, জ্যামিতি বক্স, কলম বক্স, স্কেল, পরীক্ষার ক্লিপবোর্ড, রাইটিং বোর্ড,
ফাইলসহ কোনটির দামই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নাগালে নেই। বলতে গেলে অনেকটা অযৌক্তিকভাবেই বাড়ানো হয়েছে সবধরনের শিক্ষা উপকরণের দাম। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় আমদানিকৃত কাগজের দাম কিছুটা বাড়তে পারে, তবে অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়ানোর কোন যুক্তি আছে বলে মনে করি না। একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে যে করোনার গত প্রায় দেড় বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষাসামগ্রীর ব্যবহার অনেকটাই কমে গিয়েছিলো। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর অনেক সুযোগ সন্ধানী অসাধু ব্যবসায়ী দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার অনেকের কাছেই গত বছরের খাতা মজুত থাকলেও এখন তারাও আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে বাড়তি দামে খাতা কাগজ বিক্রি করছে, এমনও গণমাধ্যমে এসেছে।
এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের অনগ্রসর শিক্ষাখাত যে আরও পিছিয়ে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন অবস্থা কেবল যে শিক্ষার্থীর ঝরেপড়াকে ত্বরান্বিত করবে তা নয়, বরং সরকারের উন্নয়ন অভীষ্টকে করবে বাধাগ্রস্ত। আশঙ্কা থেকেই যায়, শিক্ষা উপকরণের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মানুষেরা তাদের সন্তানের পড়াশোনা চালাতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বেন। ফলে সরকারের চলমান শিক্ষা কার্যক্রম যে বিঘ্নিত হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি নিরুপায় হয়ে পড়াশোনা বন্ধ করার মতো সিদ্ধান্তও নিতে পারেন অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর পরিবার। যা রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের শিক্ষার মৌলিক অধিকারকে করবে হুমকির সম্মুখীন। যা অন্যান্য উন্নয়নসূচকের অন্তরায় সৃষ্টি করবে, তৈরি করবে নানান সামাজিক সমস্যা।
আমাদের মনে রাখতে হবে- করোনায় শিক্ষার্থীদের অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে। করোনাকালে তারা আক্ষরিক অর্থেই শিক্ষা-কার্যক্রম থেকে দূরে ছিলো। এসময় অভিভাবকদেরও যে ক্ষতি হয়েছে, তাও সহজে অনুমেয়। বেশিরভাগ অভিভাবককেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও যথারীতি মাসিক বেতন ও সেশন ফি যথারীতি পরিশোধ করতে হয়েছে। এই দ্বিমুখী ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার নয়।
এ কারণেই বর্তমানে শিক্ষার প্রধান উপকরণ বই-খাতা-কলমের দাম যাতে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, সেদিকেই এখন নজর দেয়া জরুরি। পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষা উপকরণের দাম কমানো, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ বরাদ্দ প্রদানসহ, শিক্ষার্থীদের প্রণোদনা দেওয়া সময়ের দাবি। অন্যথায় সরকারের উন্নয়ন অভিযাত্রাকে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক