শিক্ষার কালজয়ী প্রতিষ্ঠান স্যার আশুতোষ কলেজ

350

চট্টগ্রাম জেলার প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম স্যার আশুতোষ কলেজ। এটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় অবস্থিত। ঐতিহ্যবাহী স্যার আশুতোষ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রেবতী রমণ দত্ত পিতা রসিক চন্দ্র দত্তের জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বোয়ালখালী উপজেলার অন্তর্গত কানুনগোপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। পিতার আয় খুব বেশি ছিল না। পিতার আয় এবং সামান্য ভূ-সম্পত্তির উপর নির্ভর করে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ হতো। পার্শ্ববর্তী ধোরলা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পড়াশুনায় তার মেধা তার জ্ঞাতি ও আত্মীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছাত্র জীবনে তাদের সহায়তার কথা রেবতী বাবু আজীবকৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতেন। প্রাইমারি শিক্ষার সমাপ্তির পর তিনি চট্টগ্রাম শহরে মিউনিসিপ্যাল স্কুলে ভর্তি হন। মেধাবী ছাত্র হিসাবে তিনি স্কুলের শিক্ষকদের আনুকূল্য অর্জন করেন। এই স্কুল থেকেই তিনি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র চট্টগ্রাম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং মাসিক পনেরো টাকার সরকারি বৃত্তি পান। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আই.এ. পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে মাসিক বিশ টাকা সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। এরপর তিনি কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কলিকাতায় ছাত্রাবস্থায় তাঁকে বৃত্তির অর্থ এবং প্রাইভেট পড়িয়ে পড়ার খরচের সংস্থান করতে হতো। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি তিন বিষয়ে অর্নাস সহ বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্রাবস্থায় তিনি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে (১৯০৫-১৯১১) জড়িত হয়ে পড়েন। স্বদেশী যুগের ভাবাদর্শ তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। চট্টগ্রামের খ্যাতনামা মানবসেবামূলক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম এসোসিয়েশনেরও তিনি সদস্য ছিলেন। সে সময়ে চট্টগ্রামের অধিকাংশ নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা এই জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলেন। চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন কেবল মাত্র জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ছিল না, স্থানীয়ভাবে জাতীয় আন্দোলনও এর মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ১৯০৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের বহরমপুর অধিবেশনে যোগদানের জন্য তিনি চিটাগাং এসোসিয়েশন এবং চিটাগং ইউনিয়ন কর্তৃৃক প্রস্তাবিত প্রতিনিধি দলের সদস্য মনোনীত হন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে প্রাদেশিক সম্মেলনসমূহ দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা মঞ্চরূপেই পরিগণিত হতো। এই সম্মেলনসমূহের উপর ব্রিটিশ সরকারের কোন সময়েই সুনজর ছিল না। এ সময়ে রেবতীরমণ দত্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ. শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র ছিলেন রেবতী রমণ দত্ত। স্যার আশুতোষের ইচ্ছা ছিল তিনি যেন অঙ্কশাস্ত্রে গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের পড়াশুনার জন্য তাঁর পক্ষে গবেষণা কাজে যোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। তার এই অর্পূণ ইচ্ছা পরিপূর্ণভাবে সফল করেছিলেন তাঁরই ভ্রাতা উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অঙ্ক শাস্ত্রবিদ ড. বিভূতি ভূষণ দত্ত।
একই বৎসর রেবতী রমণ দত্ত বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং সরকারি চাকুরীতে যোগদান করেন। সম্ভবত পটুয়াখালী তার প্রথম কর্মস্থল ছিল। এস. ডি. ও এবং ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট এই দুই পদের যে কোন একটিতে তিনি কর্মরত ছিলেন। উভয় সরকারি পদই ছিল স্থানান্তর যোগ্য। সুতরাং তাকে বাংলা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করতে হয়েছিল। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিনাজপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত আন্জুমানে ওলামায়ে ইসলামের তৃতীয় অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে তিনি যোগদান করেন। এ থেকে মনে হয় যে এ সময়ে তিনি চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে বরিশালে, ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে রামগড়ে, ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত ঘাটাল মহকুমায় এসডিও এর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাঁকুড়াতে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব ছিলেন।
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের যোগ্য ছাত্র হিসেবে শিক্ষা বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষার স¤প্রসারণে রেবতী রমণ দত্ত বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে পড়েন এবং এক্ষেত্রেই তিনি স্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। তাঁর প্রত্যেকটি কর্মস্থলে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে উদ্যোগী ছিলেন। এ প্রসংগে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। স্বগ্রাম কানুনগোপাড়ায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ড. বিভূতি ভূষণ উচ্চ বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টির নামকরণ করেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা উপমহাদেশের প্রখ্যাত অঙ্কশাস্ত্রবিদ এবং ভাগবৎ ধর্মের অসাধারণ পন্ডিত, সন্ন্যাস-আশ্রমী ড.বিভূতি ভূষণের নামে। তাঁর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তকেশী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। অন্যান্য স্থানে তিনি যে সমস্ত শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন সেগুলি হলো রামগড় উচ্চ বিদ্যালয়, ঘাটাল বিদ্যাসাগর উচ্চ বিদ্যালয়, জলপাইগুড়ি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, বাঁকুরা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, মেদিনীপুরে পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্বগ্রাম বীর সিংহে ঈশ্বর চন্দ্রের মায়ের নামে ভগবতী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, কলকাতার নিকটে হালতু গ্রামে আর্যকন্যা বিদ্যালয় প্রভৃতি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, নারী শিক্ষার উপরই রেবতীরমণ অধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। শহরাঞ্চল অপেক্ষা পল্লী অঞ্চলেই শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠায় রেবতীরমণ অধিক আগ্রহী ছিলেন। দেশের শতকরা পঁচানব্বই জন অধিবাসীকে পল্লী অঞ্চলে অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে সমাজ কোনদিন উন্নত হতে পারে না।
রেবতী রমণ যে সংকল্প নিয়ে অগ্রসর হলেন তার জন্য পরিকল্পনার প্রয়োজন। দেশপ্রেমিক এবং শিক্ষিত সমাজকে বাদ দিয়ে শিক্ষা বিষয়ক পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায় না। এ উদ্দেশ্যে তিনি গ্রামের অন্যান্য সমাজসেবীদের সহযোগিতায় ১৯৩০ এর দশকের গোড়ার দিকে ‘কানুনগোপাড়ার এডুকেশন সোসাইটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। সোসাইটির উদ্দেশ্য ছিল গ্রামে প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে রেবতী রমণ দত্তের সর্বাপেক্ষা বড় কৃতিত্ব ছিল স্বগ্রাম কানুনগোপাড়াতে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলেজ প্রতিষ্ঠা। ‘কানুনগোপাড়া এডুকেশন সোসাইটি’র সহযোগিতায় ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেজের নামকরণ করা হয় তাঁরই পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নামে। উপযুক্ত শিক্ষকের প্রতি কৃতি ছাত্রের এর চেয়ে উৎকৃষ্ট গুরু দক্ষিণা আর কি হতে পারে?
পল্লী অঞ্চলে কলেজ প্রতিষ্ঠা সে সময়কার দিনে এক অভাবনীয় ব্যাপার ছিল। গ্রামে কলেজ পরিচালিত হতে পারে কিনা এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু রেবতীরমণ দত্ত পিছপা হবার লোক ছিলেন না। গ্রামে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে দরিদ্র অথচ মেধাবী ছাত্রদের পক্ষে শহরে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে উঠেনা। এসব মেধাবী ছাত্রদের মেধা যাতে বিকাশ লাভ করতে পারে এ উদ্দেশ্যই কলেজর প্রতিষ্ঠা। (চলবে)

পল্লী অঞ্চলের মেয়েরা যাতে পিতামাতার কাছে থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে পারে প্রতিষ্ঠাতার এটাও উদ্দেশ্য ছিল। ছাত্রজীবন থেকেই রেবতীরমণ দত্ত চট্টগ্রামের খ্যাতনামা জননায়ক যাত্রামোহন সেনগুপ্তের আদর্শের অনুসারী ছিলেন। যাত্রামোহন সেনগুপ্ত পল্লী উন্ন্নে যেমন উৎসাহী ছিলেন তেমনি অন্যান্যদেরও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। সৌভাগ্যের বিষয়, কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়ে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এ. কে ফজলুল হক। রেবতী রমণের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন ফজলুল হক। কলেজ প্রতিষ্ঠায় রেবতী রমণ ফজলুল হকের সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মন্ত্রী সভায় যোগ দিলে অবস্থা আরও অনুকুল হয়। কর্মজীবনে রেবতী রমণ অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তির সাথে পরিচিত ছিলেন। তাঁদের নিকট থেকেও তিনি প্রয়োজনীয় সাহায্য সহায়তা পেয়েছিলেন।
সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা নিয়ে কলেজের নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয়। প্রয়োজনীয় জমি ক্রয় করার পর ভবন নির্মাণের জন্য দ্রব্য সামগ্রী সংগ্রহ করা হলো। সে যুগের তুলনায় এটা একটা বিরাট ব্যাপার ছিল। শ্রমজীবীরা অপেক্ষাকৃত কম মজুরীতে নির্মাণ কাজে সহায়তা করেছিলেন। সৌভাগ্যের বিষয় রেবতী রমণ দত্তের কৃতি ভ্রাতৃবর্গ নিজেদের কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাঁরাই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মহৎ পরিকল্পনার সর্বাত্মক সহায়তা করতে এগিয়ে এলেন। নির্মাণ কাজ রেবতী রমণ নিজেই তত্ত¡বধান করতেন।
চট্টগ্রামের সুসাহিত্যিক অশোক বড়ুয়া কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি তাঁর ‘স্মৃতি চিত্রন’ প্রবন্ধে কলেজে পাঠ দানের শুভ উদ্বোধন এবং কলেজে তাঁর প্রাথমিক দিনগুলির একটা চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর এই বিবরণ কলেজের রজত জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় মুদ্রিত হয়েছে। অশোক বড়ুয়ার বিবরণ অনুসারে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট কলেজে পাঠদানের শুভ উদ্বোধন করা হয়। শ্যামাপদ বাবুর লজিকের ক্লাশ দিয়েই পাঠদানের সূচনা হলো। ক্লাশে একমাত্র ছাত্রীর নাম তিনি উল্লেখ করেন নাই। এই ছাত্রীটি হলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কালিকারঞ্জন কানুনগো এর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা কানুনগো। তিনিই প্রথম আই.ই. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনিই কলেজ থেকে উত্তীর্ণ প্রথম মহিলা গ্রাজুয়েট ছিলেন। অশোক বড়ুয়ার বিবরণ অনুসারে কলেজের ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হবার আগেই পাঠদান শুরু হয়েছিল।
ছাত্র ও শিক্ষকই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান অঙ্গ। রেবতী রমণ দত্ত মনে করতেন উপযুক্ত শিক্ষক ছাড়া উপযুক্ত ছাত্র তৈরি করা যায় না। শিক্ষকের পান্ডিত্য ও গুণাবলী তাঁর শিক্ষাদানের মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে থাকে। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে রেবতী রমণ এই বিষয়টির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। কলেজের প্রথম অধ্যক্ষের পদে যিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি প্রকৃতপক্ষে কাজে যোগদান করেননি। উপাধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন মাখন লাল নাগ। অধ্যক্ষ মহোদয়ের কাজে যোগদানের অপারগতায় তিনিই অধ্যক্ষের পদে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক গিরিজা শস্কর ধর এম.এ. (স্বর্ণ পদক প্রাপ্ত ছিলেন স্কলার), ইতিহাসের অধ্যাপক প্রমোদ কুমার মুখোপাধ্যায়, এম,এ, (প্রথম শ্রেণি), দর্শনের অধ্যাপক শ্যামাপদ চট্টোপাধ্যায়, এম,এ, (প্রথম শ্রেণি), অধ্যাপক সুশীল কুমার মুখোপাধ্যায় এম, এ (স্বর্ণ পদক প্রাপ্ত), ইংরেজির অধ্যাপক প্রকৃতিরঞ্জন বড়ুয়া, আরবি ও ফার্সি বিভাগের অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ ইব্রাহিম, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হরিনারায়ণ চক্রবর্তী। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র অধ্যক্ষ মাখন লাল নাগ অঙ্কশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী ছিলেন। গৌরবর্ণ, সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত যুবক মাখনলাল সহজেই রেবতী রমণের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। এ রকম একজন আদর্শবান কর্মতৎপর ব্যক্তিকেই যেন রেবতী রমণ কলেজের অধ্যক্ষের পদে নিযুক্তির জন্য খুঁজছিলেন। অধ্যক্ষের পদে নিযুক্তি থেকে কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করার (১৯৬৪) পূর্ব পর্যন্ত অধ্যক্ষ মাখনলাল নাগ কলেজের উন্নতির জন্য যেরূপ নিষ্ঠা ও পরিশ্রম প্রদর্শন করেছেন তা একরূপ অতুলনীয়। কলেজে দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি সকল প্রকার কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। কর্মতৎপরতায় তাঁর যুগে তাঁর সমকক্ষ অধ্যক্ষ খুব কমই ছিল। অনেক সময়ে দেখা যেতো কোন অধ্যাপক ছুটিতে গেলে কিংবা পদত্যাগ করলে অন্তর্বর্তী সময়ে ছাত্রদের যাতে অসুবিধায় পড়তে না হয় মাখন বাবু সে বিষয়ে নিজেই ক্লাশ নিতেন। অঙ্কশাস্ত্র তিনি নিজেই পড়াতেন। সেই সূত্রে তিনি আইএসসিতে পদার্থ বিজ্ঞানের ক্লাশও নিতেন। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপকের অনুপস্থিতিতে তিনি বেশ কিছুদিন বি.এ. ক্লাশে রাষ্ট্রবিজ্ঞানও পড়িয়েছিলেন। কোনও কারণে অধ্যাপকের অনুপস্থিতিতে ক্লাশে শিক্ষাদান যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে অধ্যক্ষ মাখন লাল নাগের প্রখর দৃষ্টি ছিল। কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়ে কলেজের অধীনস্থ ভূমির পরিমাণ খুব বেশি ছিল না। অধ্যক্ষ মাখন লাল নাগের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কলেজের অধীনস্থ ভূমির পরিমাণ তিন চারগুণ বৃদ্ধি পায়। স্যার আশুতোষ কলেজ তাঁর প্রাণস্বরূপ ছিল। কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যেই তাঁর ভবন ছিল। সকাল বেলা চা জল খাবার খেয়ে তিনি কলেজ অফিসে চলে আসতেন, দুপুর পর্যন্ত তিনি এক নাগাড়ে কাজে ব্যাপৃত থাকতেন। দুপুরে বাসায় গিয়ে আহার করে খুব বেশিক্ষণ বিশ্রাম নিতেন না , অফিসে ফিরে এসে পুনরায় কাজে মনোনিবেশ করতেন। কলেজের রুটিন মাফিক কাজ কর্ম তাঁরই তত্ত¡াবধানে সমাধা হতো। বলা বাহুল্য, প্রবেশিকা পরীক্ষার সময় কাজের চাপ আরও বেড়ে যেতো। এক সময়ে উত্তরে কোয়েপাড়া থেকে দক্ষিণে ধলঘাট পর্যন্ত সমস্ত স্কুলের প্রবেশিকা পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল স্যার আশুতোষ কলেজ। অনেক সময়ে কলেজের কাজ কর্ম শেষ করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যেতো , বিশ্রাম নেবার সময়টুকু পর্যন্ত তিনি পেতেন না। সারাদিন কলেজে অতিবাহিত করে বাসায় ফিরে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনায় কিছুক্ষণ তদারক করতেন। মনে হয়, রাতের ঘুমটাই তাঁর বিশ্রামের সময় ছিল। কলেজ ছেড়ে তিনি কোথাও বিশেষ যেতেন না। দু’চার বছর অনতর ঢাকার বিক্রমপুরে গিয়ে দেশের বাড়ি দেখে আসতেন। কলেজের জন্যই তিনি যেন আপন জীবন উৎসর্গ করতে কৃতসংকল্প ছিলেন।
একটি আদর্শ জীবন যাপন করে গেছেন অধ্যক্ষ মাখন লাল নাগ। জীবন যাত্রায় সারল্য অতি সহজেই চোখে পড়তো। অধ্যক্ষের পদে নিযুক্তির সময়ে তাঁর মাসিক বেতন সত্তর আশি টাকার বেশি ছিল না। এই বেতনের পরিমাণ তিন অঙ্কের সংখ্যায় পৌঁছতে বেশ কিছু সময় তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অবসর গ্রহণের সময়ে তাঁর বেতন চার অঙ্কের কোঠায় পৌঁছেছিল কিনা সন্দেহ। এই স্বল্প বেতনের আওতার মধ্যে কোনও রকমে জীবন ধারণ করা চলে, বিলাসিতা করা চলে না। কর্মে নিষ্ঠা, আচার ব্যবহারে মাধুর্য, জীবন যাত্রায় সরলতা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। এই আদর্শ থেকে কখনই তিনি বিচ্যুত হননি। কলেজ থেকে অবসর গ্রহণের সময়ে তিনি কলেজের জন্য রেখে গেছেন এক মহান ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্যের স্মারক এবং বাহক হচ্ছেন এই কলেজের কৃতি ছাত্র-ছাত্রীরা।
একটা কৌতুহলের বিষয় হলো কলেজে অধ্যাপকের পদে নিযুক্তির জন্য রেবতী রমণ দত্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিকে দৃষ্টি রাখতেন। যাঁরাই পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেতেন। তাঁদের সাথে কাল বিলম্ব না করেই তিনি যোগাযোগ করে কলেজে অধ্যাপনায় তাঁরা আগ্রহী কিনা জেনে নিতেন। অনেকেই অবশ্য সুদূর চট্টগ্রামের পল্লী অঞ্চলে গিয়ে শিক্ষকতা করতে তেমন উৎসাহ দেখাতেন না। যাঁরা আগ্রহ প্রকাশ করতেন তাঁদেরকেই তিনি একরূপ সাথে সাথেই নিযুক্তি পত্র দেবার ব্যবস্থা করতেন। এভাবেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রদের কলেজে অধ্যাপনায় আকৃষ্ট করতেন।
স্যার আশুতোষ কলেজে কৃতি অধ্যাপকের সংখ্যা ছিল অনেক। তাঁদের সবার কৃতিত্ব নিয়ে আলোচনা করা ন্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। কলেজ প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে যে সমস্ত সম্মানিত অধ্যাপক শিক্ষকতা করছেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের কিছু স্মৃতিমূলক তথ্য উপস্থাপন করা গেল।
কলেজ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই বাংলা সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন এম. এ তে প্রথম শ্রেণি প্রাপ্ত ড. সুবোধ রঞ্জন রায়। অবশ্য তখন তিনি পি.এইচ.ডি ডিগ্রিধারী ছিলেন না। পরবর্তীকালে তিনি কবিবর নবীন চন্দ্র সেনের কাব্যের উপর গবেষণা করে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। গায়ের রং শ্যামল বর্ণের হলেও চোখে মুখে ছিল শাণিত দীপ্তি। ক্লাশে তাঁর পাঠদান ছাত্র ছাত্রীদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কেলিশহর গ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন, কাজেই অর্থাভাব তাঁর ছিল না। এম.এ পাশ করার পর ১৯৩০ এর দশকের শেষভাগে তিনি চট্টগ্রাম শহর থেকে ‘পার্বনী’ নামে একটি মাসিক সাময়িকী অনেকটা নিজের খরচে প্রকাশ করেন। অবিভক্ত বাংলার অনেক কৃতি সাহিত্যিকের রচনা সমৃদ্ধ ছিল এই সাময়িকী। যতদিন সাময়িকীটা চলেছিল ততদিন এটাই ছিল চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সর্বশ্রেষ্ঠ সাময়িকী এবং অবিভক্ত বাংলার অন্যতম সেরা সাময়িকী। সাময়িকীটিতে প্রকাশিত রচনার মান, মুদ্রণ এবং আঙ্গিক সজ্জার উৎকর্ষতা লক্ষ করে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাময়িকীটির প্রশংসা করেছেন। স্যার আশুতোষ কলেজে যোগদানের পর তাঁর পক্ষে ‘পাবর্নীর’ সম্পাদনা করা সম্ভব হয়নি, আর এ সঙ্গে ‘পার্বনী’র অকাল মৃত্যু ঘটে। রচনা শৈলীর দিক দিয়ে সুবোধ রঞ্জন রায় ‘কলোল’ যুগের কবি সাহিত্যিরথীদের সমগোত্রীয় ছিলেন। অবশ্য বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ ‘কলোল’ যুগের কবি সাহিত্যিকদের বয়সের তুলনায় সুবোধ রঞ্জন বয়োঃকনিষ্ঠ ছিলেন। তরুণ বয়সেই তাঁর রচনা পরিপক্কতা লাভ করেছিল। স্যার আশুতোষ কলেজে যোগদানের পর সুবোধ রঞ্জনের রচনা ‘পঞ্চমন্য’ ও অন্যান্য পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর সময়ে চট্টগ্রামে তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় সাহিত্যিক।
পরবর্তী কালে বাংলা সাহিত্য বিভাগের একজন সফল অধ্যাপক ছিলেন অংশুমান হোর। জনপ্রিয় অধ্যাপক অংশমান হোর এর পাঠদান পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল চমৎকার কবিতা আবৃত্তি এবং পাঠদানের ফাঁকে হাস্য পরিহাস বিতরণ। ছাত্রদের নিয়ে রসিকতা করতেও তিনি ছাড়তেন না। তাঁর ক্লাশ কক্ষ ছাত্রে পরিপূর্ণ থাকতো। পরবর্তী সময়ে তিনি কলেজের অধ্যক্ষের পদেও অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
কলেজের আরবি ও ফার্সি ভাষার প্রথম অধ্যাপক নিযুক্ত হন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি প্রাপ্ত মীর মুহাম্মদ ইব্রাহীম। গৌরবর্ণ, ঋজুনাসা, দীর্ঘদেহী সুপুরুষ এই অধ্যাপক অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ এবং সরল প্রকৃতির লোক ছিলেন। তাঁর সমগ্র কর্মজীবনে স্যার আশুতোষ কলেজেই অতিবাহিত হয়। অধ্যাপনা এবং গ্রন্থ পাঠেই তাঁর সমস্ত দিন কেটে যেতো। জ্ঞানে এবং জীবন যাপনে তিনি ঋষিতুল্য ব্যক্তি ছিলেন। সতীর্থদের সাথে হাস্য পরিহাস কিংবা কারও সাথে অযথা কথাবার্তা বলতে তাঁকে দেখা যেতো না। খেলার মাঠ অপেক্ষা অধ্যাত্মিক চিন্তা ভাবনাই তাঁকে অধিক আকৃষ্ট করতো। তাঁর জীবন যাপন প্রণালী দেখে তাঁকে অতীত কালের সুফি সাধকের কথা মনে করিয়ে দেয়। নিষ্ঠাবান এই অধ্যাপকের ছাত্ররা বরাবরই পরীক্ষায় ভাল ফল করতো। আরবি এবং ফার্সি উভয় বিভাগের তিনিই একমাত্র শিক্ষক ছিলেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দীর্ঘদিন তিনি গ্রন্থাগারের দায়িত্বে ছিলেন।
ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম দিককার অধ্যাপক ছিলেন দক্ষিণা রঞ্জন কর। শ্যামবর্ণ এবং কিছুটা খর্বাকৃতির এই অধ্যাপক দৈনিক দিক দিয়ে তেমন আকর্ষণীয় ছিলেন না, কিন্তু তাঁর পান্ডিত্য ছিল অসাধারণ। ক্লাশে ইংরেজি সাহিত্য পড়াতে ইংরেজি ভাষাই ব্যবহার করতেন, পারতপক্ষে বাংলা বলতেন না। যদিও তাঁর বাংলায় কথার্বাতা অত্যন্ত মনোগ্রাহী ছিল। ক্লাশে পড়াবার সময় ওয়ার্ডস ওয়ার্থ, শেলী, কীট্স, বায়রনের কবিতা তাঁর মুখ দিয়ে ঝর্ণাধারার মতো প্রবাহিত হতো। শেক্সপিয়ারের নাটক পড়াবার সময় তিনি নিজেই যেন অভিনয় করতেন। তাঁর পাঠদান ছাত্রদের সহজে হৃদয়ঙ্গম শুধু হতো না কিন্তু ক্লাশ থাকতো নীরব এবং ছাত্র ছাত্রীদের চোখ থাকতো তাঁর দিকে নিবদ্ধ। খেলাধুলায় তিনি খুব উৎসাহী ছিলেন। টেবল্টেনিসে তাঁকে পরাজিত করা একরূপ দুঃসাধ্য ছিল। পরবর্তী সময়ে ইংরেজি ভাষায় তরুণ অধ্যাপক প্রাণকুমার মুখার্জি এবং মাখন লাল দে শিক্ষক হিসাবে সফল ছিলেন। অধ্যাপক প্রাণকুমার মুখার্জির অনর্গল ইংরেজিতে পাঠদান এবং অধ্যাপক মাখন লাল দে’র পড়াবার ফাঁকে হাস্যরস পরিবেশন তাঁদের ছাত্রদের নিকট অবিস্মরণীয়। আরও পরবর্তীকালে ইংরেজির অধ্যাপক নগেন্দ্র লাল দে যথেষ্ট পান্ত্যেডর অধিকারী ছিলেন।
সংস্কৃত ও পালি বিভাগের সুযোগ্য অধ্যাপকের অভাব কোনদিনই হয়নি। পালি ভাষার অধ্যাপকদের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ বড়ুয়ার নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। তিনি ভারত বিখ্যাত পন্ডিত আচার্য বেনীমাধব বড়ুয়ার প্রিয় ছাত্র ছিলেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে এম.এ. পাশ করার পর পরই গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগদান করেন এবং এক বৎসর অন্তরীনাবদ্ধ ছিলেন। ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে তিনি স্যার আশুতোষ কলেজে পালি ও সংস্কৃত সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। চারিত্রিক গুণাবলীর জন্য তিনি ছাত্র ও পরিচিতদের নিকট শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। গান্ধিবাদী ছিলেন বলে তিনি আজীবন খদ্দরের বন্ত্র পরিধান করতেন এবং নিরামিষ আহার করতেন। তিনি সাহিত্যানুরাগী ছিলেন এবং ‘পরশমণি’ নামক একটি নাটিকা রচনা করেন।
অধ্যাপক সুরেন্দ্র নাথ বড়ুয়া অবসর গ্রহণ করলে মুনীন্দ্র লাল বড়ুয়া তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। আচার্য বেনীমাধব বড়ুয়া একটি প্রবন্ধে মুনীন্দ্র বড়ুয়াকে তাঁর ‘প্রিয় ছাত্র’ বলে উল্লেখ করেছেন। তরুণ বয়সেই অধ্যাপক মুনীন্দ্রলাল বড়ুয়া কবিতা রচনায় পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর কবিতাসমূহের মধ্যে ‘সিদ্ধার্থের সাধনা’, ‘করুণা’,‘অঙ্গুলিমাল’, ‘অনোমা’ পাঠকের প্রশংসা অর্জন করেছে। তিনি দীর্ঘদিন এই কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ বাবু এবং তারঁ স্থলাভিষিক্ত অধ্যাপক কৃষ্ণ গোপাল চৌধুরী প্রচুর পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। অধ্যাপনায় ও তাঁেদর কৃতিত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনেক কৃতি অধ্যাপকদের মধ্যে বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর অন্যতম। তবে তিনি খুব বেশিদিন এই কলেজে অধ্যাপনা করেননি। তাঁর প্রিয় ছাত্র কায়কোবাদ আহমদ চৌধুরী তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। দুর্ভাগ্যের বিষয় শিক্ষক অধ্যাপকের আগেই ছাত্র অধ্যাপক পরলোক গমন করেন।
ইতিহাস বিভাগে প্রথম থেকেই কৃতি অধ্যাপকদের অভাব ছিল না। তবে সবচেয়ে অধিক কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন অধ্যাপক বদরুল হায়দার চৌধুরী। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এম.এ. এ পাশ করে তিনি কলেজের অধ্যাপনায় যোগ দেন। এ সময়ে তিনি আইন পরীক্ষা দেবার জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁর ইংরেজি বাচনভঙ্গী ছিল চমৎকার। সুন্দর অবয়বের অধিকারী ছিলেন তিনি। পড়াবার সময় তাঁর দৈহিক সঞ্চালন উপভোগ্য ছিল। প্রথম যৌবনের উচ্ছ¡লতার প্রকাশ পেতো তাঁর কথাবার্তা ও চাল চলনে। বিলাতি পোষাকে তিনি অভ্যন্ত ছিলেন। তাঁর পড়াবার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল ক্লাশ পরীক্ষায় প্রচুর নম্বর দেয়া। ক্লাশের টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় বিশের মধ্যে সাড়ে উনিশ দিতে তাঁর হাত কাঁপতো না। সতেরোর নীচে কেউ নম্বর পেতো না। একজন প্রবীণ ব্যক্তি ছাত্রদের এত নম্বর দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করাতে তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ছাত্রদের উৎসাহ দেবার জন্যই তিনি একটু বেশি নম্বর দিয়ে থাকেন। পরবর্তী জীবনে তিনি পর্যায়ক্রমে উন্নতি করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে কেউই এতটা কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে পারেন নি। আজ তিনি আমাদের মধ্যে নেই। তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি রইল আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম।
১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে কলেজে বাণিজ্য বিভাগ খোলা হয়। বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক নির্মল কুমার সেন ছিলেন তরুণ বয়স থেকেই বিপ্লবী। সূর্য সেনের অন্তরঙ্গতা লাভে ধন্য ছিলেন তিনি। জেলে বন্দী অবস্থাতেই তিনি একের পর এক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পরেই তিনি কলেজের অধ্যাপনায় যোগ দেন। ছাত্রদের সাথে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। কাউকে কোন দিন কট‚ক্তি করেছেন বলে শোনা যায় না। আইএ ক্লাশে তিনি বেশ কিছুদিন সিভিক্্ পড়িয়েছিলেন। মতার্দশে তিনি সমাজতান্ত্রিক হলেও এ বিষয়ে তিনি প্রকাশ্যে আলোচনা করতেন না। অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সে তিনি সংসার জীবনে প্রবেশ করেছিলেন কিন্তু বেশিদিন তিনি সংসার জীবন ভোগ করেন নি। স্ত্রী-পুত্র কলিকাতায় চলে গেলে তিনি একরূপ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। নিঃসঙ্গ জীবনে ছাত্ররাই তাঁর পুত্রবৎ ছিল। ছাত্রদের তিনি প্রাণাধিক ভালবাসতেন, ছাত্ররা ও তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতো।
ছাত্রদের বিজ্ঞান শিক্ষা দানের জন্য ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে স্যার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হয়। বিজ্ঞান ভবন নির্মাণের প্রাথমিক কাজের জন্য জ্যৈষ্ঠপুরা নিবাসী নীরেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত প্রয়োজনীয় অর্থদান করেন। বিজ্ঞানের প্রথম অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন জগৎচন্দ্র চৌধুরী। ইতিপূর্বে তিনি রেঙ্গুন কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুুদ্ধের সময়ে জাপান কর্তৃক ব্রহ্মদেশ আক্রান্ত হলে জগৎ বাবু সপরিবারে রেঙ্গুন থেকে চট্টগ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন। জগৎ বাবু রসায়ন শাস্ত্রে ডিগ্রি প্রাপ্ত হলেও পদার্থ বিজ্ঞান পড়াবার ভার ও তাঁেক দেওয়া হয়। কিন্তু ক্লাশের সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে একা জগৎ বাবুর পক্ষে সমস্ত ক্লাশ নেওয়া সম্ভব ছিল না। তার উপর প্র্যাকটিকেল ক্লাশ তো ছিলই। অগত্যা অধ্যক্ষ মাখন বাবু পদার্থ বিদ্যার ক্লাশ নিতে আরম্ভ করলে জগৎ বাবুর উপর ক্লাশের চাপ কিছুটা হ্রাস পায়। বিজ্ঞান বিভাগ খুলতে অনেক কিছুর প্রয়োজন। লেবোরেটরির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, কেমিক্যাল দ্রব্য, আসবাবপত্র ইত্যাদি আছেই। বিন্তু প্র্যাকটিকেল করতে ছাত্রদের গ্রুপ করতে হয়। গ্রুপের সংখ্যা বাড়লে ক্লাশের সংখ্যাও বেড়ে যায়, অথচ কলেজের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে তাৎক্ষণিক ভাবে ডিমনস্ট্রেটর নিযুক্ত করাও সম্ভব হয়নি। জগৎ বাবু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লাশ নিয়েও সামলে উঠতে পাচ্ছিলেন না। দু’একজন পিয়নের সাহায্য নিয়ে তিনি বছর খানেক কোনক্রমে চালালেন। এরপর পদার্থ বিদ্যা ও রসায়ন বিদ্যার প্র্যাকটিকেল ক্লাশের জন্য পৃথক ডিমনস্ট্রেটর নিযুক্ত হলে অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে পড়ে।
প্রকৃতপক্ষে জগৎ বাবু একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন। বিপুল সংখ্যক ক্লাশ নিয়েও তিনি সর্বদা প্রফুল্লিত ছিলেন। ছাত্রদের শিক্ষাদানেই তাঁর দিন কেটে যেতো। তাঁর ছাত্ররাই বলতে পারবে কি অসামান্য পরিশ্রম তাঁকে করতো হতো। আজকের দিনের শিক্ষকবর্গ তা কল্পনা ও করতে পারবেন না।
আশ্চর্যের বিষয়, কলেজে এত পরিশ্রমের পরেও তাঁর নিজস্ব সখের চর্চা করতে কোন সময়ে কসুর করেননি। তাঁর সখ ছিল নিজের সবজি বাগানের পরিচর্যা করা। তার সবজি বাগানের বৃহদাকারের ফুলকপি, বাধাঁকপি, মুলা, ওলকপি, টমেটো ইত্যাদি রীতিমত দর্শনীয় ছিল। এত বৃহদাকারের ফসল সে সময়ে আর কেউ ফলাতে পারতেন না। তাঁর সবজি বাগান দেখতে অনেকেই যেতেন। এত সবতাঁর প্রয়োজন ছিল না। তাই উদ্বৃত্ত ফসল তিনি তাঁর সতীর্থদের নিকট উপহার স্বরূপ পাঠাতেন। জগৎ বাবুর বুদ্ধিমত্তা ছিল প্রখর। অধ্যক্ষ মাখন লাল নাগ তাঁর পরামর্শের উপর বিশেষ ভাবে নির্ভর করতেন। সাধারণ অবস্থা থেকে বিজ্ঞান বিভাগ খুব তাড়াতাড়ি উন্নত করতে থাকে। বি. এসসি পড়াবার জন্য ভবনটির দোতলা নির্মাণের কাজ খুব দ্রæত সমাপ্ত হয়।
কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে উচ্চ শিক্ষার প্রতি জনগণের আগ্রহে উৎসাহিত হয়ে রেবতী রমণ দত্ত কলেজে অনার্স পাঠক্রম চালু করতে অভিলাষী হয়ে পড়লেন। অর্থনীতি এবং আরও কয়েকটি বিষয়ে অনার্স পড়ানো আরম্ভ হয়। অর্থনীতিতে পরীক্ষায় ছাত্র ছাত্রীরা মোটামুটি ভাল ফল করলো। পরীক্ষার্থীদের সবাই দ্বিতীয় শ্রেণি লাভ করলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় কিছুদিনের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোরতর রূপ ধারণ করে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে জাপানি বোমা বর্ষিত হয়। এর প্রায় সাথে সাথে আরম্ভ হয় তেতালিশের ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ। জনজীবনে অস্তিরতার ছাপ পড়লো শিক্ষা ক্ষেত্রে। ছাত্রদের নিকট থেকে বেতন আদায় অনিশ্চিত হয়ে উঠে। বাধ্য হয়ে অনার্স পাঠদান বন্ধ করে দিতে হলো। বেশ কয়েক মাস যাবৎ অধ্যাপকের মাসিক বেতনও অনিয়মিত হয়ে পড়ে। বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই সাত চল্লিশ খ্রিস্টাব্দে হলো দেশভাগ। অধ্যাপকমন্ডলীর অনেকেই পদত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেলেন। ছাত্র সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পায়। অবস্থা অনুকূল হতে অন্তত বছর তিনেক সময় লেগেছিল।
স্যার আশুতোষ কলেজ চট্টগ্রামের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ বেসরকারি কলেজ ছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত কলেজটি গ্রামাঞ্চলে একটি দর্শনীয় স্থান ছিল। কলেজের ভবনসমূহ, বিশাল খেলার মাঠ, পাকাঘাট সমেত একধিক পুষ্করিনী, আবাসিক ছাত্রদের ছাত্রাবাস এ সমস্তই দর্শকদের চমৎকৃত করে তুলতো। বিশ্বাসই করা যেতো না পল্লী অঞ্চলে কিভাবে এত বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। স্থানীয় এলাকার মাতাপিতার প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁদের ছেলেমেয়েদের এই কলেজে পড়াবার। দুর দুরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে ছাত্র ছাত্রীদের কলেজে আসতো হতো। উত্তরে বেতাগী, কোয়েপাড়া, বাগোয়ান থেকে দক্ষিণে কেলিশহর, ধলঘাট পর্যন্ত সমগ্র।
অঞ্চলের প্রত্যন্ত থেকে ছাত্র ছাত্রীরা কলেজে পড়াশুনার জন্য আসতো। আসা যাওয়া চৌদ্দ পনেরো মাইল রাস্তা তাঁদের দৈনিক অতিক্রম করতে হতো। অনেক ক্ষেত্রে সকাল আটটায় তাদের কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিতো হতো। সকাল বেলা ভাত খেয়ে কলেজে আসা প্রায়ই সম্ভব হতো না। অনেক সময় পান্তা ভাত কিংবা রুটি চিড়ামুড়ি খেয়ে রওনা দিতে হতো। বর্ষাকালে কর্দমাক্ত পথ চলতে ছাত্র ছাত্রীদের কিরূপ কষ্ট হতো আজকের দিনে ছাত্র ছাত্রীর বুঝতে পারবে না। শীতকালে বাড়ি পৌঁছতে অনেক সময়েই সন্ধ্যা হয়ে যেত। রিক্সার তখনও পর্যন্ত প্রচলন হয়নি। কিছু ছাত্র অবশ্য সাইকেল ব্যবহার করতো। কলেজের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত তার ধারে কয়েকটা দোকান নির্মিত হয়েছিল। চা বিস্কিট খেতে অন্তত পক্ষে দু’আনা থেকে চার আনা লাগতো। এত পয়সা ছেলেদের দেওয়া অনেক অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব হতো না। তার উপর দোকানে বসে চা খাওয়া একটা লজ্জার বিষয় ছিল। অভিভাবকের ধারণা ছিল দোকানে বসে চা খাওয়া মানে আড্ডা দেওয়া। তাই পথ চলতে চলতে বিস্কিট কিংবা বাদাম ভাজা খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে হতো। মাঝে মধ্যে দু’একজন ছাত্রকে সিগারেট ফুঁকতে দেখা যেতো। হিন্দু ছেলেরা ধুতি শার্ট ও মুসলিম ছেলেরা পাজমা শার্ট পড়ে কলেজে আসতো এর বেশি মানেই বিলাসিতা। দু’একজন শহুরে ধনীর ছেলে শার্ট প্যান্ট এবং পায়ে সু’ পড়তো। শতকরা আশিভাগ ছাত্র ছাত্রীখালি পায়ে কলেজে আসতো। রাবারের সেন্ডেলের প্রচলন হওয়ার পর তা ছাত্রদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এক জোড়া সেন্ডেলের দাম খুব বেশি হলে দেড় থেকে দু’টাকার মধ্যে, কিন্তু অনেক অভিভাবকের পক্ষে তাও কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। অবশ্য প্রত্যেক ছাত্রেরই এক জোড়া চামড়ার জুতো ছিল কিন্তু সে জুতো জোড়া নিয়মিত ব্যবহার করলে ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনায় সেগুলো তোলা থাকতো কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে ব্যবহার করার জন্য।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ ছাত্রছাত্রীদের মৌলিক চাহিদা মিটাতেও আর্থিক চাপের সম্মুখীন হতো। ছাত্রদের কমন রুমেই অভ্যন্তরীণ খেলার ব্যবস্থা ছিল। শুষ্ক মরসুমে খোলা মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলার সুযোগ মিলত। অনেক অর্থ ব্যয় করে কলেজ পার্শ্ববর্তী ধানী জমিকে খেলার মাঠে পরিবর্তিত করা হয়। সুখের বিষয়, কলেজের নৈসর্গিক পরিবেশ রক্ষায় কলেজ কর্তৃপক্ষ বরাবরই সচেতন। পল্লী অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে হাজারো রকমের প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। এ সমন্ত সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আর্থিক সংস্থান এবং এবং সরকারি অনুদানের বিশেষ প্রয়োজন। অতীত যুগে সরকারি সাহায্যের পরিমাণ ছিল প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। সা¤প্রতিক কালে কলেজটি সরকারি হওয়াতে অবস্থা কিছুটা অনুকূল হয়েছে বলে মনে হয়।
সীমিত সম্পদের মধ্যেও স্যার আশুতোষ কলেজ কর্তৃক পরিবেশিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহ পল্লী অঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি দেখতে দূর দুরান্ত থেকে লোক সমাগম হতো। প্রধানত কলেজের ছাত্ররাই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করতো, তবে অধ্যাপকেরাও অংশগ্রহণ করে ছাত্রদের উৎসাহিত করতেন। হিন্দু হোস্টেলে সরস্বতী পূজা বেশ জাঁকজমকের সাথে অনুষ্ঠিত হতো। পঞ্চাশের দশকের পূর্ব পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বারোয়ারি পূজা এবং পূজা উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের তেমন প্রচলন ছিল না। এ কারণে কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান জনগণের নিকট খুবই উপভোগ্য ছিল।
কলেজ প্রশাসন বিষয়ে পরামর্শ দেবার ব্যাপারে পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রথম কয়েক বছরে যাঁরা পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিখ্যাত ভারততত্ত¡বিদ আচার্য বেনী মাধব বড়ুয়া প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. কালিকা রঞ্জন কানুনগো, খ্যাতনামা অঙ্কশাস্ত্রবিদ ড. আতাউল হাকিম অন্যতম।
কলেজ প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা ব্যক্তি কলেজ পরিদর্শনে এসেছিলেন। কলেজের শুভারম্ভের অল্পকালের মধ্যেই কলেজ পরিদর্শনে আগমন করেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন দার্শনিক ও পরবর্তীকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপলী রাধাকৃষ্ণা। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের অনেকেই তাঁর নামে কলেজটি পরিদর্শনের জন্য ঔৎসুক্য প্রকাশ করেছিলেন। রাজনীতিতে ব্যস্ততার জন্য স্যার আশুতোষের পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পক্ষে চট্টগ্রামে আসা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে স্যার আশুতোষের কন্যা এবং জামাতা ও তৎকালের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ডঃ প্রমথ নাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কলেজের বিজ্ঞান ভবনের দ্বারোদঘাটন উপলক্ষে কলেজে আগমন করেন। একই বৎসর দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেন গুপ্তের পতœী এবং সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলের সভাপতি নেলী সেনগুপ্তা কলেজ পরিদর্শন এবং ছাত্রনেতাদের এক বিরাট সমাবেশে বক্তৃতা করেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান কলেজ পরিদর্শন করেন। কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণার ডিরেক্টর এবং দেশের অন্যতম নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানী ড. কুদরৎ-ই-কুদা কলেজ পরিদর্শন করে এর বিজ্ঞান শিক্ষাদানের উদ্যোগের প্রশংসা করেন। দেশের অন্যতম খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক ও সুসাহিত্যিক এবং তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডীন ড. কাজী মোতাহার হোসেন দু’বার কলেজ পরিদর্শন করেন। একবার তাঁর সঙ্গে কবি বেগম সুফিয়া কামাল কলেজ পরিদর্শন করে নারী শিক্ষা অগ্রগতিতে কলেজের অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তানের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ফজলুল কাদের চৌধুরী কলেজ পরিদর্শন এবং জনসভায় বক্তৃতা করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী এ.কে.খান কলেজে শুভাগমন করেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আণবিক শক্তি কেন্দ্রের প্রধান এবং নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানী ড. আনোয়ার হোসেন কলেজের বিজ্ঞান সেমিনারের উদ্বোধন করেন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে কলেজের রজত জয়ন্তী উৎসবের উদ্বোধন করবার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. এ.আর.মলিক কলেজে শুভাগমন করেন। রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সেমিনারে বক্তৃতা প্রদান করেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এবং পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর এমেরিটাস আব্দুল করিম। একই অনুষ্ঠানে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন মনীষী কাজী মোতাহার হোসেন এবং প্রধান অতিথি ছিলেন কবি জসীম উদ্দীন। বিশিষ্ট অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ।
ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলন এই সমগ্র সময়ে স্যার আশুতোষ কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছিলেন। কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র সুসাহিত্যিক অশোক বড়ুয়া তাঁর স্মৃতিচারণে তাঁর সতীর্থদের মধ্যে একজন বিপ্লবীর উল্লেখ করেছেন। এই বিপ্লবী ছাত্র চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন এবং জালালাবাদ সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করেছিলেন। (অশোক বড়ুয়া বিশেষ কারনে তাঁর নাম উল্লেখ করেননি। সম্ভবত তিনি ছিলেন ফকির সেন) এই বিপ্লবী গোপনে ছাত্র সমাবেশে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনে এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষে রোমাঞ্চকর ঘটনা সমূহ বর্ণনা করতেন। সতীর্থরা রুদ্ধশ্বাসে তা শুনতো। তেভাগা আন্দোলন ও ভারত ছাড় আন্দোলনের সময়েও ছাত্র আন্দোলন উত্তপ্ত হয়ে উঠে। কলেজের অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ বড়ুয়া কংগ্রেস দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ভারত ছাড় আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করে জেলবরণ করেছিলেন। ১৯৪০ এর দশকে কলেজের আঙ্গিনায় না হলেও নিকটস্থ হরিবাড়ির মাঠে ব্রিটিশ বিরোধী জনসভা অনুষ্ঠিত হতো। চট্টগ্রাম জেলার নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকেরা এই জনসভাসমূহে বক্তৃতা করতেন। কলেজের ছাত্ররাও এতে যোগদান করতো। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের সময়ে স্যার আশুতোষ কলেজ উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে শোভাযাত্রা ও জনসভায় মুখরিত থাকতো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সেই সব দিনগুলি। জেনারেল আয়ুব খাঁর মার্শাল ল আইনের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছিল স্যার আশুতোষ কলেজের ছাত্র সমাজ। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম দিকে হরতাল ও জনসভা একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। কলেজ ছাত্রদের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শ্রোতৃমন্ডলীকে উদ্দীপিত করে তুলতো। জনগণের নিকট অস্ত্র সরবরাহ করতে গিয়ে শহীদ হলেন অধ্যাপক দিলীপ কুমার চৌধুরী এবং পাক বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দিলেন অধ্যক্ষ শান্তিময় খাস্তগীর। সমগ্র এলাকার স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্র ছিল স্যার আশুতোষ কলেজ।
শিক্ষার সুযোগ প্রদান একটি সামাজিক দায়িত্ব। বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলে এই দায়িত্ব আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শহরে বসে সার্বজনীন, বাধ্যতামূলক এবং উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে দীর্ঘ বক্তৃতা দেয়া সহজ কিন্তু পল্লী অঞ্চলে গিয়ে তার বাস্তবায়ন করা কঠিন কাজ। স্যার আশুতোষ কলেজ পল্লী অঞ্চলে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের কার্যক্রমে সাফল্যের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড এটা শুধু কথার কথা হলে দেশ কোন দিনই অগ্রগতির পথে যেতে পারেনা। শিক্ষার সুযোগকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ আর এ কাজটা শুরু করেছিলেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রেবতী রমণ দত্ত এবং অনেক বছর পরে ২০০৯-২০১০ শিক্ষাবর্ষে অত্র কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় প্রফেসর দীপক তালুকদার এর চেষ্টায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স কোর্সে চালু করেন ও ২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে একাদশ শ্রেণিতে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ০২টি করে সেকশন করা হয় এবং সফলভাবে চালিয়ে নিচ্ছেন কলেজের কর্তৃপক্ষ ও অধ্যাপকমন্ডলী। যে আদর্শ নিয়ে স্যার আশুতোষ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল সে আদর্শ থেকে কলেজ যেন বিচ্যুত না হয় এটাই আমাদের আন্তরিক কামনা। ইতিহাস ও শিক্ষার ইতিহাসে বোয়ালখালীর কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজ একটি ইতিহাস। এই ইতিহাসে মানুষ জানুক। কারণ একটি ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে আরেকটি নতুন ইতিহাসের জন্ম হবে। স্যার আশুতোষ কলেজের আলো ছড়িয়ে পড়ুক দেশ ও সমগ্র বিশ্বে। এই শুভ কামনা লেখকের।

লেখক : মরমী গবেষক ও প্রাবন্ধিক