শিক্ষার্থীরা মেতেছে খেলায় সন্তানের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন অভিভাবকরা

56

ঘড়ির কাঁটা মেনে নির্ধারিত সময়ে ঘণ্টা বাজতেই সুনসান নীরবতায় স্কুলের শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হওয়া- দেশের স্কুলগুলোতে এক সময় এটাই ছিল পরিচিত দৃশ্য। গতকাল রবিবার চট্টগ্রামে হঠাৎ স্কুল পরিদর্শনে আসার আগে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের মনেও হয়তোবা সেরকম দৃশ্যই দেখবেন বলে ধারণা ছিল। কিন্তু পরিদর্শনে গিয়ে তিনি যা দেখলেন তা নিশ্চয় সময়ের ব্যবধানের অজুহাতেও নিজের কল্পনাসীমায় কখনও তিনি আনতে পারেননি। প্রত্যাশা আর বিদ্যমান অবস্থা দেখে যুগপৎভাবে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হলেন দুদক চেয়ারম্যান।
পূর্বঘোষণা ছাড়াই গতকাল রবিবার সকালে চট্টগ্রামে এসে আকস্মিকভাবে তিনটি বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। এর মধ্যে সকাল সোয়া নয়টায় হাজির হন নগরীর কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর যান শহরের নিকটবর্তী সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয় পরিদর্শন শেষে যান একই উপজেলার শীতলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তিনি বিস্মিত হওয়ার পাশাপাশি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এরপর সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ডেকে সতর্ক করেন।
তবে, পরিদর্শনকালে শীতলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে তার মিশ্র অভিজ্ঞতাই হয়েছে। ওই স্কুল পরিদর্শনকালে নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেল করা কোনো শিক্ষার্থীকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ (সেন্ট-আপ) দেয়া হয়নি বলে জানায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি অবহিত হয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন দুদক চেয়ারম্যান। পাশাপাশি নবম শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষায় এক বা একাধিক বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীকে দুই হাজার টাকার বিনিময়ে উত্তীর্ণ দেখিয়ে দশম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দেয়ার ঘটনা জেনে ক্ষুব্ধ হন তিনি। এটা অনৈতিক উল্লেখ করে আগামীতে যাতে আর না ঘটে সে ব্যাপারে সতর্ক করে দেন স্কুল কর্তৃপক্ষকে।
প্রসঙ্গত, দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক চলতি বছর তাদের কার্যক্রমে শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতি দমনকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তারই অংশ হিসেবে দুদক চেয়ারম্যান আকস্মিকভাবে এসব স্কুল পরিদর্শনে আসেন।
দুদক ও স্কুলসংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রবিবার সকাল আটটা ২৫ মিনিটে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ চট্টগ্রাম এসে পৌঁছেন। সকাল সোয়া নয়টায় তিনি হাজির হন নগরীর কর্নেলহাটের অদূরে কাট্টলী নুরুল হক চৌধুরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলের ক্লাস চলাকালীন ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের স্কুলের বাইরে দেখে বিস্মিত হন দুদক চেয়ারম্যান। এরপর যান স্কুলের কার্যালয়ে। গিয়ে দেখেন স্কুলের সর্বমোট আটজন শিক্ষকের মধ্যে শুধুমাত্র ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকই উপস্থিত রয়েছেন। বাকি সাতজনই তখনও স্কুলে আসেননি। ছাত্র-ছাত্রীরা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ও আশপাশে খেলাধূলায় সময় পার করছে। অভিভাবকরা অপ্রতাশিতভাবে দুদক চেয়ারম্যানকে কাছে পেয়ে নিজেদের সন্তানের শিক্ষা ও ভবিষ্যত নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন। কেউ কেউ বিদ্যালয়ের বিরাজমান বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগও করেন তার কাছে।
সবার কথা শোনার পর দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে কাউকেই ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না। যে বা যারা জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মের ক্ষতিসাধন করবেন বা করার চেষ্টা করবেন তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। তাদেরকে অবশ্যই কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে। যে কোনো মূল্যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা নিশ্চিত করা হবে। প্রয়োজনে দুদক দন্ডবিধির ১৬৬ ধারা প্রয়োগ করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনবে।
সেখান থেকে বেরিয়ে দুদক চেয়ারম্যান যান শহরতলীর উপজেলা সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে গিয়ে দেখেন ১১ জন শিক্ষকের মধ্যে দুইজন অনুপস্থিত। এ ব্যাপারে প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি তাদের অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ জানাতে পারেননি। দুদক চেয়ারম্যান ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতির রেজিস্ট্রার পরীক্ষা করে দেখেন। তাতে দেখতে পান, আগের দিন যে সকল শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল তাদের অনেককেই উপস্থিত দেখানো হয়েছে। আবার গতকাল রবিবার সকাল দশটা পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের রোল কলই করা হয়নি। এ বিষয়েও স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। সেখানে স্কুল কর্তৃপক্ষের সবাইকে সতর্ক করেন।
এরপর দুদক চেয়ারম্যান যান একই উপজেলার শীতলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেল করা কোনো শিক্ষার্থীকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় সুযোগ (সেন্ট-আপ) দেয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি অবহিত হয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন দুদক চেয়ারম্যান। তবে, নবম শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষায় এক বা একাধিক বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীকে দুই হাজার টাকার বিনিময়ে উত্তীর্ণ দেখিয়ে দশম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ দেয়ার ঘটনা জেনে ক্ষুব্ধ হন তিনি। এটা অনৈতিক উল্লেখ করে আগামীতে যাতে আর না ঘটে সে ব্যাপারে সতর্ক করে দেন স্কুল কর্তৃপক্ষকে।
এদিকে পূর্বদেশের মিরসরাই প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গতকাল রবিবার মিরসরাই উপজেলার ১৫ নম্বর ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের খাজুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ছোটকমলদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান।
দুদক চেয়ারম্যান সেখানে গিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষর্থীদের সাথে কথা বলেন। এ সময় কোনো শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে কিনা তা জানতে চান। তিনি উপজেলার বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়েরও খবর নেন এবং জানতে পারেন টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করা কোনো শিক্ষার্থীকে এসএসসি পরীক্ষায় সুযোগ দেয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি অবহিত হয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে অনৈতিক কোনো কিছুর স্থান হতে পারে না। যে কোনো মূল্যে শ্রেণিকক্ষে আমাদের সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন, মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহিদুল কবির, ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজ।