শিক্ষাক্রম ইতিবৃত্ত

321

সৈয়দ আবু সুফিয়ান

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার লক্ষ্যে মূল্যায়ন ও পড়াশোনার ধরনের বড় পরিবর্তন এনে নতুন শিক্ষাক্রম এই বছর থেকে বাস্তবায়ন শুরু করেছে সরকার। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন শিক্ষাক্রম এই বছর থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণিতে চালু হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। ২০২৪ সালে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হবে। ২০২৫ সালে চালু হবে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে। উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে চালুর মধ্য দিয়ে পুরোপুরিভাবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক- প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দশটি শেখার ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ১. ভাষা ও যোগাযোগ ২. গণিত ও যুক্তি ৩. জীবন ও জীবিকা ৪. সমাজ ও বিশ^ নাগরিকত্ব ৫. পরিবেশ ও জলবাযু ৬. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ৭. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ৮. শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ৯. মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ১০. শিল্প ও সংস্কৃতি।
আমাদের এই পাঠের উদ্দেশ্য নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানা নয়। আমাদের উদ্দেশ্য সহজ ভাষায় শিক্ষাক্রম সম্পর্কে জানা। প্রথমেই জানবো শিক্ষাক্রম কি? শিক্ষাক্রমের ইংরেজি পরিভাষা ‘পঁৎৎরপঁষঁস। এটি ল্যাটিন শব্দ ‘ পঁৎৎবৎব ’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘পড়ঁৎংব ড়ভ ংঃঁফু’ অর্থাৎ ‘পাঠ্যবিষয়’। শিক্ষাক্রম বলতে পূর্ব নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিচালিত কোর্সকে বুঝায়। আক্ষরিত অর্থে যাই হোক না কেন শিক্ষাক্রম শব্দটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং যুগের পরিবর্তনের সাথে বিবর্তিত হচ্ছে। আমেরিকায় শিক্ষাক্রমের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায় ১৮২০ সাল থেকে। তখন আমেরিকাতে শিক্ষাক্রম বলতে ‘পড়ঁৎংব ড়ভ ংঃঁফু’ বা কতগুলো পাঠ্যবিষয়কে বুঝাত, যা অনুসরণ করে শিক্ষক শ্রেণিতে পাঠদান করতেন। সে সময় শিক্ষাক্রমের মূল ফোকাস ছিল শিশুর মানসিক ও জ্ঞানের বিকাশ। যেটা ছিল শিক্ষাক্রম সম্পর্কে প্রাচীনপন্থী শিক্ষাবিদদের ধারণা। ১৯৩০ সালের পর শিক্ষাক্রমের প্রাচীন ও সংকীর্ণ ধারণার পরিবর্তন হয়ে শিক্ষাক্রমের ধারণার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। আধুনিককালে কোন শিক্ষা কার্যক্রম কী উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, কোন বিষয়বস্তু পাঠের মাধ্যমে উদ্দেশ্যসমূহ অর্জিত হবে, কোন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা তা শিখবে এবং শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে- এ সম্পর্কিত সকল নির্দেশনার সমষ্টিই হল শিক্ষাক্রম।
প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাক্রম হচ্ছে একটি ব্যাপক ধারণা যার মধ্যে রয়েছে জাতীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি থেকে শুরু করে বর্তমান ও ভবিষ্যত মানবসম্পদ গড়া ও শিক্ষার্থীদের কর্মে নিয়োজিতকরণের একটি সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনার দিক নির্দেশনা। নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়। শিক্ষাক্রমের নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য নেই তবে, কোন রাষ্ট্রের জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্যই শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। শিক্ষাক্রমের এই লক্ষ্য নির্ধারিত হয় কোন সমাজ বা রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনের চরম চাওয়ার উপর। অর্থাৎ একটি জাতি তার শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে কীভাবে গড়ে তুলতে চায় তাই হলো ঐ জাতির শিক্ষা বা শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য। একটি দেশের শিক্ষাক্রমের ভিত্তি হচ্ছে ঐ দেশের জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কোন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রধান উৎস ঐ দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের উপর ভিত্তি করে নির্ণীত হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল দেশে দ্রæত সামাজিক বিবর্তন ঘটছে। এ বিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে চলার জন্য কী ধরনের শিক্ষার দরকার তা নিয়ে ক্রমাগত গবেষণা হচ্ছে। ফলে বিশে^র সকল রাষ্ট্রই নিয়মিতভাবে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, পরিমার্জন, উন্নয়ন এবং বাস্তবায়ন করে থাকে।
শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের কাজটি বহু ধাপে সম্পন্ন হয়ে থাকে।
প্রথম ধাপ : শিক্ষাক্রম প্রণয়নের প্রথমেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষামূলক চাহিদা নিরূপণ করা হয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট স্তর বা কোর্সের শেষে তারা কী জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অর্জন করবে তা ঠিক করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপ : শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য (ধরস), অভীষ্ট (মড়ধষ) এবং উদ্দেশ্য (ড়নলবপঃরাব) চিহ্নিত করতে হয় এবং এগুলো অর্জনের জন্য কী কী বিষয় শিখবে তা নির্ধারণ করা হয়।
তৃতীয় ধাপ : প্রত্যেকটা বিষয়ের পাঠের শেষে শিক্ষার্থীরা কী কী যোগ্যতা (পড়সঢ়বঃবহপু) অর্জন করবে বলে আশা করা হয় তা চিহ্নিত হয়।
চতুর্থ ধাপ : চিহ্নিত যোগ্যতা অর্জনের জন্য কী কী বিষয়বস্তু পড়ানো হবে এবং কী ধরনের শিখন কার্যক্রমের (ষবধৎহরহম ধপঃরারঃরবং) মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিখবে তা নির্ধারিত হয়।
পঞ্চম ধাপ : যৌক্তিক ও মনোবিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বিভিন্ন বিষয়ের শিখন অভিজ্ঞতার দিকগুলো (শিখন-কার্যক্রম,বিষয়বস্তু,রিসোর্স) পর্যায়ক্রমিকভাবে বিন্যাস (ংবয়ঁবহপব) করা হয়। এবং দিকগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের মাধ্যমে শিক্ষাক্রমে এগুলোকে যথাযথভাবে সংগঠিত (ড়ৎমধহরুব) করা হয়।
ষষ্ঠ ধাপ : শিক্ষার্থীরা শিক্ষাক্রমে চিহ্নিত যোগ্যতা কতটুকু অর্জন করতে পারছে তা জানার জন্য শিক্ষার্থীর শিখন পরিমাপ ও মূল্যায়নের উপায় নির্ধারণ করা হয়।
সপ্তম ধাপ : শিক্ষাক্রম বিস্তরণ কর্মসূচি আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের নতুন শিক্ষাক্রম ও তার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করতে হয়। অতঃপর শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। শিক্ষাক্রম কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে দেখতে হয়। প্রাপ্ত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষাক্রম পরিমার্জিত হয়। শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও উন্নয়ন কাজটি বিভিন্ন তাত্তি¡ক মডেলের সাহায্যে সম্পন্ন করা হয়। যেমন: শিক্ষাক্রম উন্নয়নের রৈখিক মডেল এবং শিক্ষাক্রম উন্নয়নের বৃত্তাকার মডেল। রৈখিক মডেলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাফ টাইলার মডেল, হিলডা তাবা মডেল, কার মডেল আর বৃত্তাকার মডেল গুলো হলো হুইলার মডেল, নিকলস মডেল, প্রিন্ট মুর মডেল। এই মডেল গুলো ছাড়াও শিক্ষাক্রম উন্নয়নের জন্য আরো কিছু মডেল রয়েছে সেগুলো হলো ইউনেস্কো মডেল, ইরাট ইটাল মডেল, ওয়াকার মডেল। রাফ টাইলার সর্বপ্রথম ১৯৪৯ সালে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন মডেল উপস্থাপন করেন।
আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম উন্নয়নের কাজটি করে থাকে। শিক্ষাক্রম উন্নয়নে এনসিটিবি উদ্দেশ্য-শিখনফল মডেল অনুসরণ করে। উদ্দেশ্য- শিখনফল মডেল (ড়নলবপঃরাব সড়ফবষ) অনুসারে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ উন্নয়ন করা হয়েছে। এটিকে ফলভিত্তিক মডেলও (ঢ়ৎড়ফঁপঃ সড়ফবষ) বলা হয়। এ মডেল অনুসারে শিক্ষার লক্ষ্য ও সাধারণ উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে উদ্দেশ্য অর্জন উপযোগী বিষয় ও বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়। বিষয়ভিত্তিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য স্তরভিত্তিক প্রান্তিক শিখনফল নির্ধারণ করা হয়। প্রান্তিক শিখনফলকে শ্রেণিভিত্তিক শিখনফলে বিভাজন করা হয়েছে। শ্রেণিভিত্তিক শিখনফলকে বুদ্ধিবৃত্তীয়, আবেগীয় ও মনোপেশিজ-এ তিন ভাগে বিভাজন করা হয়েছে। শ্রেণিভিত্তিক শিখনফলকে ভিত্তি করে শ্রেণি উপযোগী বিষয়বস্তু, শিখন-শেখানো কার্যক্রম ও মূল্যায়ন কৌশলসহ যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়। আজকের বিশে^ বহু দেশ উদ্দেশ্যভিত্তিক মডেল অনুসরণে শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করে থাকে। তথ্য সূত্র: শিক্ষাক্রম উন্নয়ন-বাউবি, শিক্ষা কোষ- এসডিসি।

লেখক : শিক্ষাকর্মী ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, বাঁশখালী