‘শিক্ষাই কি জাতির মেরুদন্ড’?

227

ছোটবেলা থেকে আমরা একটা কথা শুনে এসেছি ‘শিক্ষা জাতির মেরুদÐ’। একটা জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে হলে সেই জাতিকে শিক্ষিত হতে হবে। কিন্তু আসলেই কি শিক্ষা জাতির মেরুদÐ? আমরা কয়েকটা ধাপে শিক্ষা গ্রহণ করি। আর এই ধাপগুলো আমরা অতিক্রম করি শুধু একটি ভালো সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য। আর সেই সার্টিফিকেট দিয়ে একটা ভালো চাকরি পাবো সেই আশায়। কিন্তু কখনো পাঠ্যবইয়ের বাইরে জ্ঞান রাখি না। আমাদের শিক্ষাগুলো হয় পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পর চাকরির জন্য ছোটাছুটি করি। কিন্তু কপালে চাকরি জোটে না। জুটবেই বা কেন আমার তো পাঠ্যবইয়ের বাইরে নৈতিক কোনো জ্ঞান নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তো সুশিক্ষার উপযুক্ত নয়। এরপর আমি হয়ে যাই সমাজের জন্য বোঝা। সমাজের কারও কাছে আমার গুরুত্ব থাকে না। একদিকে মনের মতো চাকরি পাই না অন্যদিকে নিম্নমানের কাজ করতে আমার বিবেক বাধা দেয়, কারণ আমি তো শিক্ষিত। জীবিকার তাগিদে চলে যায় অন্ধকার জগতে। আমার শিক্ষা তখন আমার কাছে সবচেয়ে বড় শত্রæ হয়ে যায়। সুশিক্ষার অভাবে চুরি, ডাকাতি, মারামারি, খুন, অন্যায়, ধর্ষণ, নির্যাতন, শোষণ ইত্যাদিতে লিপ্ত হয়। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদÐ’। এ কথাটা বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের জন্য সঠিক। বাংলাদেশের জন্য এ প্রবাদটা সঠিক নয়। আজ আমাদের দেশে যেদিকে তাকাবেন সেদিক থেকেই হতাশ হতে হবে আপনাকে। কি হচ্ছে এই দেশে? আমাদের দেশে এখনো ভালো মানুষ আছে, কিন্তু তার সংখ্যা তো খুবই কম তারা তো খারাপদের সঙ্গে টিকে থাকতে পারছে না।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের অবস্থা একটু চিন্তা করুন। তখন তো শিক্ষাব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। তাহলে তাদের সমাজ আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল কীভাবে? ভালো তো থাকার কথা এখন। এখন তো আমরা শিক্ষিত হচ্ছি আধুনিক হয়ে গেছি। তারপরেও আমাদের উন্নতি হচ্ছে না। সব জায়গায় দুর্নীতি আর দুর্নীতি। অনার্স মাস্টার্স শেষ করেও যখন চাকরি হয় না, তখন বিদেশ গিয়ে কারিগরি জ্ঞানের অভাবে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে। আবার যারা বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা নিয়েও দেশে মূল্যায়ন পাচ্ছে না তারাও চলে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। নেই আমাদের মধ্যে কোরআন-হাদিসের জ্ঞান। ফলে যে কোনো অন্যায় কাজ করতে বিবেক বাধা দেয় না। যখন স্কুলে পড়তাম, পড়া না পারলে কোনো কোনো শিক্ষক শাস্তিত্ম দিত। তবুও তার পড়া শেখা হতো না। কিন্তু কোনো এক শিক্ষক আছে পড়া না শিখলে যিনি মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো পড়া শেখোনি কেন বাবা? বাবা এভাবে পড়া না শিখলে তুমি তো জীবনে ভালো কিছু করতে পারবে না। তুমিই তো একদিন এই দেশ চালাবে, তুমি যদি পড়া ফাঁকি দাও তাহলে তো তোমার দ্বারা সে কাজ হবে না। তোমার বাবা-মা তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এরকম আরও অনেক কথা বলে বোঝাতো। তখন মন-মানসিকতা হয়ে যেত পরিবর্তন। পড়তে বসলে ওই শিক্ষকের পড়াই আগে শেখা হতো। এটা বলার কারণ হচ্ছে আমাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। আর একজন মানুষের মন-মানসিকতা পরিবর্তন হতে পারে নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে। শুধু শাস্তি দিয়ে অন্যায়কে প্রতিহত করতে পারবেন না। আপনি একজন মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দেন তার ভিতর মূল্যবোধের সৃষ্টি করেন দেখবেন তার জন্য অন্যায়ের দরজা তালা মারা।
নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সচেতনতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এগুলো আসে পরিবার তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এগুলো কতটুকু সংযুক্ত আছে তা দেখলে অবাক হতে হয়। বর্তমানে যতটুকু যুক্ত তা যথেষ্ট নয়। আরও বহুগুণে এ ধরনের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রয়োজনে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নৈতিক শিক্ষা নামে আলাদা বিষয় যুক্ত করতে হবে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি কোরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। উচ্চশিক্ষিত হয়েও কোরআনের একটা আয়াত পড়তে পারে না তাহলে এই শিক্ষা দিয়ে কি লাভ হবে? সুশিক্ষা না পেয়ে নিজের পিতা-মাতাকে পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসে। যে পিতা-মাতার জন্য এই পৃথিবীর আলো দেখছে সেই পিতা-মাতাকেও তখন মূল্য দেয় না। অন্যায় দেখলেও প্রতিহত করে না। আচার-ব্যবহার হয় অশিক্ষিত লোকের মতো। আজকাল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশের উন্নতি তো এদের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু এরা কীভাবে দেশকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে? পত্রিকা খুললেই প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে ধর্ষণের খবর। স্কুল প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের হাতে ছাত্রী ধর্ষণ হয়। যে শিক্ষক পিতা-মাতার সমতুল্য সেই শিক্ষকের কাছে এখন ছাত্রীরা নিরাপদ নয়। কারণ ওইসব শিক্ষক শিক্ষিত কিন্তু সুশিক্ষিত নয়।
শুধু শিক্ষিত হলেই চলবে না, সুশিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষার কোনো শেষ নেই। এজন্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, যে শিক্ষায় চরিত্র গঠন হয়, মনের শান্তি বৃদ্ধি পায়, বুদ্ধির বিকাশ হয়, নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে পারে, সেই শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। সুতরাং শিক্ষা নয়, সুশিক্ষাই জাতির মেরুদÐ। দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সে জাতিকে অবশ্যই সুশিক্ষিত হতে হবে।