শিক্ষকদের কাজ ছাত্রছাত্রীদের জীবনমুখি করে তোলা আশ্রয়চ্যুত করা নয়

14

মেহেরুন্নেছা মেরী

এ পি জে আব্দুল কালাম বলতেন, আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীতে শিক্ষকের চেয়ে সমাজের জন্য মহান আর কোনও পেশা নেই। ‘দেশের আদর্শ নাগরিক হিসেবে ছাত্রদের গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে শিক্ষকরা নিজেদের মতো করে পথ চলেন। দেখিয়ে দেন সঠিক, আর বেঠিকের রাস্তা। জাতির শক্তি বৃদ্ধি করতে, বিশ্বকে আরও বলিষ্ঠ করতে শিক্ষকদের অবদান অতুলনীয়। শিক্ষকের স্থানের সঙ্গে অন্য কারোর স্থানের তুলনা হয় না। জীবনের চলার পথে অভিভাবক হিসাবে মা বাবার গুরুত্ব যতটা, ততই শিক্ষকের গুরুত্ব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন যা ঘটছে তা যেমন কলঙ্কজনক ঠিক তেমনি উদ্বেগেরও বিষয়।
শিক্ষক লাঞ্ছনা শিক্ষক প্রহারের ঘটনা আমাদের মানবিক চেতনাকে যেমন নাড়া দিয়েছে যখন আমরা বখে যাওয়া কিশোরদের জন্য নষ্ট পারিপার্শ্বিক সমাজ কাঠামোকে দায়ী করে সমাজের দিকে আঙুল তুলছি, ঠিক সে সময় ঠিক তার উল্টো বৈপরীত্যের কিছু কথা বলতে চাই। আর তা হলো শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের সাথে শিক্ষকদের উদ্যত আচরণ এবং ক্লাসে সকল ছাত্রছাত্রীদের সামনে অপমান করা, বেত্রাঘাত করা,মা বাবাকে হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলা। আমাদের স্কুল কলেজের শিক্ষকগণ এখনও নিজেরা সৃজনশীল পদ্ধতি বুঝে উঠতে পারছেন বলে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে অথচ তারা সেই দায় চাপিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের ওপর। শিক্ষকদের হিংস্রতা সইতে না পেরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের আত্মহননের কথা আমরা জানি। এই সংখ্যার চেয়ে বহু গুণিতক হলো আতঙ্কে স্কুল ছেড়ে দেওয়া। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনৈতিক আচরণের ঘটনা তো এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এ বিষয় নিয়ে ও সচেতনতা দরকার আছে।
শিক্ষা আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, শ্রেণিকক্ষে কোন শিক্ষার্থীকে শিক্ষক কর্তৃক কোন শারীরিক শাস্তি কিংবা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। শারীরিক শাস্তি বলতে আমরা বুঝি যে কোনো ধরনের দৈহিক আঘাত করা যেমন- শিক্ষার্থীদেরকে হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, চক বা ডাস্টারজাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেয়া ও চিমটি কাটা, কামড় দেওয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেওয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেনসিল চাপা দিয়ে মোচড় দেওয়া , ঘাড় ধাক্কা দেয়া, কান টানা বা ওঠবস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাটু গেড়ে দাঁড় করে রাখা, রোদে দাঁড় করে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে এমন কোনো কাজ করানো যা শ্রম আইনে নিষিদ্ধ।আমি আজকের লেখায় এই শারিরীক শাস্তির চেয়েও মানসিক শাস্তির পরিণাম নিয়ে ভাবছি।
মানসিক শাস্তি বলতে আমরা বুঝি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে এমন কোন মন্তব্য করা যেমন- মা-বাবা, বংশ পরিচয়, গোত্র, বর্ণ, ও ধর্ম সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করা, অশোভন অঙ্গভঙ্গি করা যা শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। শ্রেনি কক্ষে শিক্ষকদের চলমান বৈরী আচরণ এবং এর প্রভাবে ঘটে যাওয়া দু একটি বাস্তব ঘটনা এখানে তুলে ধরছি-
এক.
একজন ব্যাংকার স¤প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরেছেন রাজধানীর বনশ্রী জুনিয়র আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষকদের হিংস্রতার কথা। তার ছেলে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। একবার সহপাঠীকে শিক্ষকের দেওয়া শাস্তি দেখে ভয়ে স্কুলে যাওয়া নিয়েও তার মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। ক’দিন বাদে সে নিজেই আক্রান্ত হলো শিক্ষক দ্বারা। অপরাধ ছেঁড়া কাগজ ডাস্টবিনে ফেলতে যাচ্ছিল ছেলেটি। আবার জ্বর এসেছে তার। বাবা শিক্ষকের মারের চিহ্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে দিয়েছেন। এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিভাবকরা অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার সাহস করেন না। প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। পৌঁছালেও বলেন সন্তানকে স্কুল থেকে সরিয়ে নিতে। তথাকথিত নামি স্কুলের শিক্ষকদের আচরণ আরো ভয়াবহ। অভিভাবকরা তাদের কাছে জিম্নি। কারণ এ প্রকারের স্কুলে ভর্তি করাতে পারা যুদ্ধ জয়ের সমান। সঙ্গে আছে ডোনেশনের চাপ। তাই তারা সয়ে যান রয়ে যান।
দুই.
ময়মনসিংহ নগরীর রয়েল মিডিয়া কলেজে ক্লাসে পাঠ্যবই না আনার কারণ জানতে চেয়েছিলেন শিক্ষক ঐ সময় অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন ছাত্র, দাবি করেন শিক্ষক। এর শাস্তি হিসাবে ছাত্রকে বেতের আঘাত করেন শিক্ষক। এখন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেন ঐ ছাত্র। বৃহস্পতিবার ৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগটি মামলা হিসাবে গ্রহণ করেন পুলিশ। মামলা করা শিক্ষার্থী ঐ কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। শিক্ষক অত্র কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। গত ৩১ আগস্ট বাংলা ক্লাস চলছিল। এই সময় কারা কারা ব্যাকারণ বই আনেন নি জানতে চান শিক্ষক। তখন ঐ ছাত্র (আসিব) বই আনেন নি বলে জানালে শিক্ষক তাকে বেত দিয়ে পিটান।বিষয় টি এখানে শেষ নয়, ভুল হলে শিক্ষক শাসন করতেই পারেন। পিতা মাতার পরেই তো শিক্ষক। এই শাসন যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়,উদ্দেশ্য প্রনোদিত হয় তাহলে এ দায় কি শিক্ষকের নয়? এ প্রসঙ্গে ছাত্রের অভিভাবক ও ছাত্রের বক্তব্যের মূল বিষয়বস্তু এ রকম ছিল- কলেজ ঐ শিক্ষকের লেখা একটি বই পাঠ্য হয়েছে। কোন শিক্ষার্থী বইটি না কিনলে ভয়ভীতি দেখানো হতো এবং ক্লাসে এসে শিক্ষক মা,বাবা সহ আত্মসম্মানে লাগার মতো করে গালিগালাজ করেন।যারা তার বই কিনেন নি তাদের কে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গালাগাল করে বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এমন ঘটনার প্রমাণ আমার চট্টগ্রাম শহরের প্রায় কলেজেও রয়েছে। আমার এক ছাত্র জানালেন তাদের (ইন্টার) আই সি টি স্যার ক্লাসে এসে বলেছেন তার লেখা বই যদি না কিনে তাহলে কাউকে পাস করাবে না। এবং শেষ সংলাপটা এমন ছিলো- ‘তোমরা কি বস্তি থেকে উঠে এসেছো যে একটা বই কিনতে পারবে না’!
তিন..
পরীক্ষা চলাকালে শিক্ষক অরিনীত্রর কাছে মোবাইল ফোন পায়। মোবাইলে নকল করছে এমন অভিযোগে অরিত্রিকে তার বাবা-মাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। একটি সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা নিষেধ। তাই অরিত্রীর ব্যাগে যখন মোবাইল ফোন পাওয়া যায়, তখনই তাঁর বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ আনা হয় এবং সূত্র মতে অভিযোগটি প্রমানিত হয়নি। শুধুমাত্র মোবাইল ফোন থাকার অপরাধে নকল করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।
অরিত্রী যখন তাঁর বাবা মাকে নিয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে আসে, তখন তাঁর বাবা মাকেও অপমান করা হয়। এক পর্যায়ে রুম থেকে বের করে দেয়া হয়। অরিত্রী তার শাস্তিস্বরূপ ‘ট্রান্সফার’ আদেশ বদলাতে বাবার সামনে প্রিন্সিপালের কাছে অনুনয়-বিনয় করে ক্ষমা চেয়েছিল। কিন্তু তাঁর কথা কেউ শুনেনি। প্রিন্সিপালের কাছে গিয়েও অরিত্রী এবং তাঁর বাবাকে একই অপমানের মুখোমুখি হতে হয়। পরিশেষে কি ঘটলো আমরা সবাই জানি।
শিক্ষা মহান পেশা।শিক্ষককে পিতামাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। কোচিং বানিজ্য, সাবজেক্ট দাম্ভিকতা অনেক সময় শিক্ষককে স্বৈরাচারী হতে দেখেছি। কোন ভাবেই শিক্ষকের এ ধরনের আচরণ আমি শিক্ষক ও অভিভাবক হিসাবে প্রত্যাশা করিনা। একজন মহৎ শিক্ষকের কাজ ছাত্রছাত্রীদেরকে জীবনবাদী করে তোলা। ক্লাসে প্রচুর ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে একজন ছাত্র কিংবা ছাত্রীকে অপমানিত করে আশ্রয়চ্যুত করা নয়, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া নয়।
লেখক : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক