শিক্ষকদের উপযুক্ত মান্যতা প্রদানের দিন

44

 

জৈবিক মানুষকে নৈতিক , সমাজমুখি, প্রগতিমুখি তথা মানবীয় রূপে গড়ে তোলার কারিগর হলেন শিক্ষক। বন্যতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, মানুষ হয়ে জীবকুলে এগিয়ে থাকার, এগিয়ে যাওয়ার জন্য, প্রতিনিয়ত সময়ের সাথে নিজেকে অতিক্রম করার পথ দেখান, সাহস যোগিয়ে যিনি যান তিনি হলেন শিক্ষক। সভ্যতা, সংস্কৃতিকে ইতিবাচকতার দিকে নিয়ে গিয়ে মানুষের জীবনকে শিল্পময়,আনন্দময় অর্থবহ করে তোলেন শিক্ষক। তিনি মানুষের হৃদয় আলোকিত করে যান, যে কোন মাধ্যম দিয়ে । কন্ঠ, পট, ছন্দ, সুর, জ্ঞান, দক্ষতা ইত্যাদি নানা মাধ্যমে, নানা ভাবে নানা কৌশলে মানসিক-শারীরিক শ্রম দিয়ে যান। তাঁর সেই শ্রমের ফসল এই সভ্য সমাজ, উন্নত সমাজ। এমন কোন সমাজ নেই, পাওয়া যাবে না, যে সমাজে শিক্ষকের অবদান নেই। অর্থ ও সম্পদকে অর্থবহ ও কল্যাণমুখী করে তোলেন এই শিক্ষক। সমাজে যার যত বেশি প্রয়োজন, যার অবদান যত বেশি, তাকে মর্যাদায়, ক্ষমতায় সামনে রাখা হয়। তাঁদের অবস্থান সমাজের প্যারামিটার প্রকাশ করে। একটি জাতির সূচিপত্র হল সেই জাতির শিক্ষকের সামাজিক, আর্থিক ও মর্যাদার অবস্থান। বই এর সূচিপত্র যেমন বই এর ভেতরের কথা জানান দিয়ে দেয়, শিক্ষকের মান মর্যাদার ক্ষমতার অবস্থানও সেই সমাজের মনন্নাচির কথা জানিয়ে দেয়। আর শিক্ষকের অবস্থান অগ্রগতিতে না থাকা মানে জাতিতে স্থবিরতা থাকা, পশ্চাৎপদতা থাকা । এই বিষয়টি যে জাতি যত গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা,আর্থিক মর্যাদা, তাঁর সক্ষমতার ক্ষেত্র প্রসস্থ রাখে সে জাতি তত এগিয়ে থাকে। তা যে সত্যি তা তো আমাদের আশেপাশের দেশগুলোর অবস্থা দেখলে বোঝা যায়। বিশেষ করে শিক্ষা সূচকে আমাদের আবস্থান তলানিতে পড়ায় তাতে পরিষ্কার বোঝা যায়। যা সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তোলে।
শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকরা বলেন, একজন শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি গুণ থাকতে হয়। এক,শিক্ষকতা বৃত্তির প্রতি প্রীতি ও শ্রদ্ধাবোধ। দুই,শিক্ষার্থীর প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব। তিন, শিক্ষাণীয় বিষয়ের প্রতি অনুরাগ এবং নিষ্ঠা। এই তিনটি গুণ শিক্ষকের আছে বলেই নানা প্রতিকূলতার মাঝেও শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করা এদেশে সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু আর্থ সামাজিক অবস্থা ও মূল্যবোধ ক্রমবিকাশমান বলে সময়ের চাহিদা শুধু মনন-অনুভূতি দিয়ে মিটাতে পারে না। শিক্ষক শিক্ষার্থীর মাঝেই শুধু থাকেন না, তিনি পরিবার, সমাজ নিয়েও থাকেন। ব্যক্তি মননে একক শিক্ষক হিসাবে কবি কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ নামের কবিতার শিক্ষকের মত মনে মনে আওড়াতে পারেন আর পরিতৃপ্তি পেতে পারেন এই চরণ উচ্চারণ করে আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষা গুরুর শির / সত্যি তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর। তাঁকে তো শিক্ষার্থীদের সামনে থেকে,মাঝ থেকে বাইর হয়ে আসতে হয়। পরিবারের চাহিদা মিটাতে বাজারে যেতে হয়, সন্তানসন্ততির লেখাপড়ার খরচ যোগাতে হয়। অন্য দিকে সামাজিক নানা কর্মকাÐে তাঁকে জড়িত হতে হয়। তখন তাঁর আর্থিক অবস্থা ও মর্যাদার অবস্থার, নেতৃত্বের অবস্থার দৈনতা প্রকাশ পায়। তখন তাঁর ‘শিক্ষাগুরু শির’ উচু রাখা অসম্ভব হয়ে উঠে। গলার জোর কমে যায়। তার মানসিক সামর্থ্য, সক্ষমতা ভেঙ্গে পড়ে। নানা দৈনতা এসে তাঁকে গ্রাস করে নেয়। এসব বৈরীতায় আর যাই হউক শিক্ষা তথা দক্ষতা সঞ্চালনের মত সৃজনশীল কাজ, শিল্পীর কাজ মানসম্মত হয় না। এই মানের না হওয়ার জন্য শিক্ষাদান অর্থবহ হয়ে উঠে না। ফলে বিজ্ঞ জনদের বলা উপর্যুক্ত শিক্ষকের গুণ তিনটির প্রাবল্য বাড়ানো যায় না,ধরে রাখা যায় না। শিক্ষাকতা তো শুধু কায়িক শ্রম দিয়ে ভবন নির্মাণের জন্য ইট টানার মত না। এখানে সফল ও কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য শিক্ষকের সৃজন, মনন ও শৈল্পিক চেতনার স্বতঃস্ফূর্ত চর্চা ও প্রয়োগের জন্য প্রেষণা থাকা চাই, তাড়না থাকা চাই। সে প্রেষণা ও তাড়না আসবে তখনই যখনই তাঁর আর্থিক ও চাকরির নিরাপত্তা থাকবে, সামাজিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। এই সবে অপূর্ণতা থাকায়, ঘাটতি থাকায় আমাদের শিক্ষার বেহাল অবস্থা। শিক্ষা সূচকে আমরা পিছনে পড়ে থাকছি। এখান থেকে উত্তরণের পথ তো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করার শুাতেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি শিক্ষাকে জাতীয়করণে হাত দিয়েছিলেন। তাঁর উপদেশনায় করা, ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে বাজেটে শতকরা সাত ভাগ বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও বাজেটে সাত ভাগ দূরে থাক,তিন ভাগও বরাদ্দ দিতে পারেনি রাষ্ট্র। দেবে কেন, রাষ্ট্র এখনও শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে স্বীকৃতি পুরো না দিয়ে ব্রত হিসাবে দেখে যাচ্ছে। যার জন্য আজকে রাষ্ট্রের, সমাজের অনুভূতিতেই শুধু শিক্ষক থাকেন, চেতনায় থাকেন না। ভাবাবেগ দিয়ে জীবনের বাস্তবতা মোকাবেলা করা যায় না। মানননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর শিক্ষক এমেরিটাস প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামানকে লাল গালিছা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে না হেঁটে প্রফেসরকে হাটঁতে দিয়ে শিক্ষককূলকে সম্মানিত করলেন। সে সম্মানে আমরাও বাদশাহ আলমগীরের পুত্রের শিক্ষককের মত হয়ত বলে উঠেছি ‘উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির’, এটা তো আমরা শ্রেণিকক্ষে আওড়ায়। না আওড়ালে আমরা শিক্ষার্থীর সামনে এত সজীব থাকতে পারতাম না। কিন্তু ঐ যে বললাম শিক্ষক সত্তা শুধু শিক্ষার্থীর মাঝে বা শ্রেণিকক্ষে থেকে না। তাঁর পারিবারিক ও সামাজিক সত্তাও রয়েছে। সেই সত্তায় সে টিকে থাকার জন্য তাঁকে যদি অহর্নিশ যাতনা কষ্ট সহ্য করে যেতে হয় তা হলে সেই শিক্ষক কতটুকু কতদিন ধরে শিক্ষাকতার গুণাবলী প্রকাশে সক্ষমতা দেখাতে পারেন, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। উঠতে পারে বলে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে জাতীয় আয়ের সাত ভাগ বররাদ্দের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই কমিশনের বিজ্ঞ সদস্যরা বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু গাড়ি উন্নতমানের করলে হয় না,ড্রাইভারের জীবন-মান উন্নত করা দরকার। তা না হলে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা থাকে না, ড্রাইভারের জীবন-মান উন্নত না থাকলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, লক্ষ্যচ্যুত হতে পারে। তাই তারাঁ সাত ভাগ বাজেট বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করছিলেন। আজ নানা উন্নয়নের সফলতা দেখে সচেতন মানুষের মনে সাধারণ শিক্ষকের জীবন-মান উন্নয়নের প্রশ্নটা জোরালোভাবে সামনে তোলা অস্বাভাবিক না। জাতি উন্নয়নের চাবিকাঠি কোথায়, কোথায় বিনোয়োগে জাতির স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব তা বোঝার জন্য দূরদর্শিতার প্রয়োজন। বিদগ্ধ জনের সম্পৃক্ততার ভাগ, সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়া দরকার। দিন দিন সেই প্রত্যাশা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। না হয় মেগা মেগা প্রকল্প, ঝুঁকি নিয়ে, হাতে নিয়ে ও বাস্তবায়ন করে বিশ্বকে অবাক করে দিচ্ছি যে জাতি, সে জাতির রক্ত প্রবাহ, শিক্ষার গুণগতমান আরও এগিয়ে নেয়ার জন্য, শিক্ষকের জীবন-মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের বহুদিনের দাবি শিক্ষা জাতীয়করণ করা যাচ্ছে না কেন। শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে,বেতন ও পূর্ণভাতা সরকারিভাবে নিশ্চিত হলে, শিক্ষকদের জীবন-মান বাড়বে, শিক্ষকরা পূর্ণ পেশাদারি দক্ষতার প্রকাশ ঘটাতে পারবে। এই জন্য শিক্ষার মান বাড়াতে ও শিক্ষকের জীবন-মান বাড়াতে শিক্ষাকে জাতীয় করণ জারি। বিষয়টি রাষ্ট্রের কেন্দ্রিয় চেতনার নীতিনির্ধারকরা যতই আগে অনুধাবন করতে পারবেন,তা বাস্তবায়ন করবেন শিক্ষা ও শিক্ষকের দূর্দশা তত তাড়াতাড়ি লাগাব হবে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর যদি প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বঙ্গবন্ধু জাতীয়করণ না করতেন তা হলে শিক্ষার এতটুকু অগ্রগতি হত না। তিনি ক্রমান্বয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা, কলেজ স্তর পর্যন্ত জাতীয়করণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। করারও কথা, তিনি তো তখন শুধু বাঙালির নেতা নন, বিশ্ব নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন শিক্ষায় বেশি বাজেট বরাদ্দের কারণে কিউবা ( এখন বাজেট, জাতীয় আয়ের প্রায় ২০%) কেমন করে শক্তিশালী ও উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, শ্রীলঙ্কা কেমন করে এগিয়ে যাওয়ার পথ ধরেছে। পাশের দেশগুলো কিসের শক্তিতে এগিয়ে যেতে পারার সম্ভাবনা তৈরি করে যাচ্ছিল। তিনি তা অনুধাবনে আনতে পেরেছিলেন বলে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশেও এতগুলো প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের স্হাস দেখাতে পেরেছিলেন। তাঁর সময়ের শিক্ষা কমিশনে সাত ভাগ শিক্ষা বাজেটের কথা কমিশন বলতে পেরেছিলেনন। শিক্ষক সমাজের দুর্ভাগ্য আজ, স্বাধীনতা বিরোধী চক্রান্তকারিরা নির্মম ভাবে তাঁকে হত্যা করায় বাঙালি জাতি বিকাশের পথে,অগ্রগতির পথে অন্ধকার নেমে আসে। তাঁকে হত্যা করার পর, পঁচাত্তর পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে তেমন বড় ধরনের কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে অন্য কিছুর চেয়ে সর্বস্তরের শিক্ষা জাতীয়করণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে শিক্ষাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতেন। শিক্ষা জাতীয়করণ হলে শিক্ষার সংকট ও শিক্ষকদের বেদনায় ভরা শিক্ষক দিবসটি হত না।
শিক্ষকদের অবদানকে সম্মান দেখানোর জন্য, স্বীকৃতিদানের জন্য ইউনেস্কো ৫ অক্টোবর দিনটি শিক্ষকদের জন্য উৎসর্গ করে। আসুন আজ আমরা শত দুঃখ যাতনার মাঝেও আমাদের নিজ নিজ প্রিয় শিক্ষকের পাশে গিয়ে দাঁড়াই, তাঁকে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রকাশ করি।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজচিন্তক