শিক্ষকতা-কতটুকু আকর্ষণীয় ?

52

বাসুদেব খাস্তগীর

শিক্ষকতাকে বলা হয় মহান পেশা। আবার অনেকেই বলেন পেশার চাইতে বড় বিষয় শিক্ষকতা হচ্ছে একটি ব্রত। শিক্ষকতা পেশাটি মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে এগিয়েছে তার আপন গতিতে। সত্যিকার অর্থে শিক্ষকতার মত মহৎ ও মহান পেশা আর দ্বিতীয়টি নেই। শিক্ষকতা হচ্ছে অন্যসব পেশা তৈরির সূতিকাগার। শিক্ষা ব্যবস্থাকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলার জন্য প্রয়োজন আদর্শবান সুশিক্ষক। যিনি নীতি নৈতিকতা মূল্যবোধ ও জ্ঞানে গরিমায় অপর দশজনের চাইতে আলাদা। মা-বাবার পরেই একজন শিক্ষকের স্থান। একজন মানুষের জীবনের পরতে পরতে শিক্ষকের অবদান। শিক্ষকের শিক্ষা নিয়েই মানুষ তার জীবন গঠনের জন্য প্রয়াসী হন। সে মানুষ স্বপ্ল শিক্ষিত হোক বা উচ্চশিক্ষিত হোক। শিক্ষকের অবদানকে অস্বীকার করে এমন লোককে খুঁজে পাওয়া পাবেন না। মা বাবা তার সন্তানকে পরম স্নেহে আগলিয়ে রেখে মানুষ গড়ার জন্য সচেষ্ট থাকেন, ঠিক তেমনি করে শিক্ষকরাও তাদের শিক্ষার আলো দিয়ে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতকে আলোকিত করার চেষ্টা করে যান প্রতিনিয়ত। শিক্ষক মানুষের জীবনে প্রদীপ শিখা প্রজ্বলিত করে তার জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলেন। এখানেই একজন শিক্ষকের বিশেষত্ব। শিক্ষক ছাত্রকে তার পিতামাতার মত যেমনি স্নেহ করেন তেমনি শাসনও করেন। স্নেহ মায়া মমতা শাসনের মাধ্যমেই একজন ছাত্রের জীবন ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। শিক্ষকের কাছে পড়াশুনা করা শৈশবের স্মৃতি অনেকের মনে এখনো দাগ কেটে আছে। শিক্ষককে নিয়ে আছে যেমন ভয়ের গল্প তেমনি আছে অনেক অ¤ø মধুর স্মৃতিও। ছোটবেলায় একসময় কোনো কোনো শিক্ষককে মনে হতো শাসন করার কারণে ঐ শিক্ষক নিতান্তই মন্দ একজন লোক। কিন্তু জীবনের এক প্রান্তে এসে অনেকেরই মনে হয় আসলেই ঐ শিক্ষকের কঠোরতাই ছিলো তার সুন্দর জীবন গঠিত হবার অন্যতম কারণ। এক সময় এসে সে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। সেই সব শিক্ষকের অনেকেই আজ প্রয়াত। ইচ্ছে করলেই আর তাঁদের সেই স্নেহ ভালোবাসার দেখা মেলবে না। আর পরিণত বয়সের পড়াশুনা করা অনেক শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীর সম্পর্কও কখনো কখনো মনকে রাঙিয়ে দেয়। শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্ক সবসময় মধুর। এ মধুর সম্পর্ক যতই কাছাকাছি হয় সেখানে জ্ঞান অর্জনের জোয়ার বয়ে যায়। একসময় এদেশে খুব বনেদী পরিবার বা খুব ভালো পড়াশুনা জানা লোকেরা শিক্ষকতা পেশায় আসতো। তাঁদের শিক্ষাদান পদ্ধতি, জ্ঞান বিলানোর নিরন্তর প্রচেষ্টায় ছাত্ররা বিমোহিত হয়ে থাকতো। অর্থ-বিত্ত বা নানা প্রাপ্তির বিষয়টি তেমন মুখ্য ছিল না। আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খোঁজ নিলেই দেখা মিলবে অনেক শিক্ষকের নাম এখনো লোক মুখে ফেরে। বাংলা, গণিত, ইংরেজি কিংবা বিজ্ঞান পড়ানো সেই সব প্রবীণ শিক্ষকের কাছে যারা শিক্ষা লাভ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সেই শিক্ষকদের অনেকেই আজ প্রয়াত। কিন্তু তাঁদের পাঠদান পদ্ধতি সেই শিক্ষার্থীদের কাছে এখনো অমলিন। সময়ের বিবর্তনে সেইসব শিক্ষকরা অনেকেই অবসরে বা অনেকেই প্রয়াত। কিন্তু কথা হচ্ছে সেই জ্ঞানী শিক্ষককের জায়গাগুলো সত্যি কি পূরণ হচ্ছে ? এ প্রশ্নের জবাব দিতে প্রসঙ্গক্রমে অনেক কিছুই এসে যায়। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় নানামুখী ব্যবস্থায় শিক্ষকদের মধ্যে পার্থক্যতো তৈরি হচ্ছেই- পার্থক্য তৈরি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও। তখনকার সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থা এমন বহুদা বিভক্ত ছিল না। শিক্ষকতাকে ব্রত হিসাবে নিয়েই অনেক মেধাবী শ্রেণির মানুষ এ পেশায় আসতো এবং তাঁরা তাদের শিক্ষাদান ও নীতি নৈতিকতার গুণে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠতেন। সেই জায়গায় যদি বর্তমানকে দেখি তাহলে বলবো শিক্ষকতা অনেকটা আকর্ষণীয় পেশার জায়গায় নেই। ফলে শিক্ষকতায় অনেকে আসেন যেন অগত্যা প্রয়োজন থেকে। এখানে দেশে বিরাজমান সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তুলনামূলক চিত্রে আমি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দিকটা বিবেচনায় নিয়েই আলোকপাত করতে চাই। কারণ এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ৯৫ ভাগেরও বেশি বেসরকারি ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রিত। আগেকার সময়ে শিক্ষককতায় এসে যাঁরা মনে প্রাণে এখনো অনেক লোকের মনের মণিকোঠায় স্থান নিয়ে আছেন- সেই দিনের সেই শিক্ষকের শিক্ষকতার প্রেক্ষাপট এখন বিদ্যমান নেই। সেই শিক্ষকের ছাত্ররাও আজ প্রবীণের দলে। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে সমস্ত মেধাবী শিক্ষকের বিচরণক্ষেত্র ছিলো সে সব স্থানে সে ধরনের শিক্ষক মিলছে না – তা অনেক ক্ষেত্রে সত্য। ঢালাওভাবে কথাটা সত্য না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্র তা সত্য বটে। কারণ সেই সময় যাঁরা শিক্ষকতায় আসতেন তাঁরা সে পেশা আকর্ষণীয় কিনা, শিক্ষকতা পেশায় জীবনকে কিভাবে উপভোগ করবেন তা তেমন বিবেচনায় আনতেন না। বাড়ির কাছেই সে সময়ের মেধাবীরা এক ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এ পেশায় জড়িয়ে যেতেন এবং এ পেশায় তাদের মেধা মননশীলতার কারণে তাঁরা হয়ে উঠতেন সমাজের সকলের শ্রদ্ধারজন। এখন এসময়ে মেধাবীরা এ পেশায় আসবে কিনা শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের কতটুকু আকর্ষণ করে কাছে টানতে পারছে তা বিবেচনার দাবী রাখে। আর দাবী রাখে বলেই এখনকার ছেলেমেয়েরা এ পেশায় আসার আগে এখন অনেক হিসাব নিকাশ করে। কারণ প্রতিযোগিতার এ যুগে অনেক হিসেব নিকাশ করে চলতে হয়। তা না হলে পৃথিবীর সাথে তাল মেলানো যাবে না। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে এদেশে অনেক পেশার মধ্যে শিক্ষকতা আকর্ষণীয় পেশার প্রথম দিকে মোটেও নেই। পেশাকে প্রার্থীর মধ্যে যদি আকর্ষণীয় করে তুলতে পারা না যায় তাহলে সেখানে ‘শ্রম ঘূর্ণায়মানতা’ সৃষ্টি হবেই। আর ‘শ্রম ঘ‚র্ণায়মানতা’ হচ্ছে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাবার প্রবণতা। এই প্রবণতা সৃষ্টি হয় পেশায় প্রাপ্তি বা সুযোগ-সুবিধার অপর্যাপ্ততার কারণে। সা¤প্রতিক প্রেক্ষাপটে একটু সুক্ষèভাবে বিষয়টাকে বিশ্লেষণ করলে তা স্পষ্টভাবে তা দৃশ্যমান হবে। দেখা যায় অনেকের কাছে আকষর্ণীয় পেশায় ঢোকার সোনার হরিণটি হাতের নাগালে না আসা পর্যন্ত শিক্ষকতা পেশাটিকে আঁকড়ে থাকেন। এদের কাছে ভাবনাটা এরকম ‘ভালো কোথাও চান্স পেলে চলে যাবো।’ তার মানে শিক্ষকতা তেমন ভালো পেশা নয়। এটি বর্তমান একশ্রেণির মানুষের একেবারে বদ্ধমূল এক বিশ্বাস বা ধারণা। এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে অনেকদিন থেকে। স্কুল কলেজের চাকরি ছেড়ে অনেকেই তো ব্যাংকে যোগ দিয়েছেন। এমন উদাহরণ অনেক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনেক ভালো মানের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে যোগদান করছেন। কিন্তু তারা কি আরো ভালো সুযোগ পেলে থাকছেন? তার মানে শিক্ষকতা পেশায় ভালো সুযোগ বা ভালো আকর্ষণের আকাল দেখছেন তারা। এটি অতীব একটি সত্য কথন। কিছুদিন পর দেখা যায় শিক্ষকতা পেশায় আসা সেসব নতুন শিক্ষকরা নতুন পেশার খোঁজে হন্য হয়ে ছুটছেন। সুযোগ পেলেই চলে যাচ্ছেন আর কেউ কেউ সুযোগ না পেয়ে হয়তো হতাশা নিয়েই থেকে যাচ্ছেন। বেসরকারি মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগের যে প্রক্রিয়া তা প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সে নিয়োগ প্রক্রিয়া চ‚ড়ান্ত রূপ পেতে পেতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। আর এখানে দেশের বিভিন্ন জায়গা প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানে যে মেধাবী শিক্ষকদের যোগদান করতে বলা হয় তাদের বদলী ব্যবস্থা না থাকা সহ নানা জটিলতায় অনেককেই নিয়োগ পেয়েও যোগদান করতে চান না। এ সময়ের শিক্ষার্থীরা অনেক হিসেব নিকেশ করেই পেশায় আসতে চান। মেধাবীরা যদি এখানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করেন তাহলে ভালো ছাত্র তৈরি হবে না। এক সময়ের যে মেধাবী শিক্ষকরা চলে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে সে স্থান সে ধরনের শিক্ষক দিয়ে প‚রণ হচ্ছে না। একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি যে কলেজে শিক্ষকতা করি সে কলেজে একটি শূন্যপদে এনটিআরসিএ থেকে নিয়োগ দেয়া হয়। ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স করা। নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন করার জন্য কলেজ একদিন এসে সমস্ত কাগজপত্র উপস্থাপন করে। কিন্তু পরে আর যোগদান করেনি। তার একাডেমিক ক্যারিয়ার দেখলাম চমৎকার। দূরের কোন এক জেলায় তার বাড়ি। তার কাছে যে কারণেই হোক কলেজে চাকরির মত সোনার হরিণের বিষয়টি এখানে অত্যন্ত আকর্ষণহীন মনে হয়েছে। সারা দেশেই এই চিত্র। শিক্ষকতা পেশায় ভালো মেধাবীদের আনতে না পারলে মেধাবী জাতি গঠন সুদূর পরাহত। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় লেবেল পর্যন্ত শিক্ষক হবার একটি সঠিক মানদÐ তৈরি করে তাদেরকে এ পেশায় ধরে রাখার পরিকল্পনা নিতে হবে। নতুবা এখানে ‘শ্রমঘূর্ণায়মানতা’ ঘটতেই থাকবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই শিক্ষকতা অন্যতম একটি আকর্ষণীয় পেশা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এ দেশে অধিকাংশ শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণকারী বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়নি। ফলে মেধাবীরা এটাকে পছন্দের তালিকায় রাখেন না। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি।
শিক্ষকতায় মেধাবীদের না আসা এবং এলেও বেশি দিন না থাকার যে কারণ তা বিশ্লেষণ করতে হবে গভীরভাবে। সমস্যার গভীরে যেতে না পারলে বা প্রকৃত সত্য অনুধাবন না করলে সমস্যা যে তিমিরে আছে সে তিমিরেই থেকে যাবে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার প্রত্যেক স্তরে উচ্চতম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের আগমন আজ খুব বেশি প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া, শিক্ষকদের আচার আচরণ, প্রশিক্ষণসহ শিক্ষার উন্নয়নে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক ধ্যান-ধারণার প্রয়োগ ঘটানো দরকার। শিক্ষকদের যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তা, পেশাগত স্বাধীনতা ও সুযোগ সুবিধা, জবাবদিহিতা,পর্যবেক্ষণ ও ম‚ল্যায়ন, শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ, কার্যকর শিক্ষাদানের পরিবেশ, সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা এবং একটি নীতি নৈতিকতা ও মানবিক ম‚ল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক তৈরির কথা জাতিকে ভাবতে হবে। একটি জাতির মান নির্ধারণ হয় তার দেশের নাগরিকরা চিন্তা চেতনায় কেমন অগ্রসরমান তার ওপর। আর নাগরিকদের এ মান নির্ভর করবে সে দেশের শিক্ষকরা কেমন মানের বা কেমন গুণাবলিসম্পন্ন তার ওপর। কারণ শিক্ষকের শিক্ষার ওপর নাগরিকের ভিত তৈরি হবে। পেশাকে শতভাগ মনে প্রাণে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে না পারলে সেখানে প্রকৃত শিক্ষা অর্জিত হবে না। কারণ দক্ষ ও আন্তরিক শিক্ষকই জাতি গঠনের প্রকৃত কারিগর। শিক্ষায় একজন শিক্ষককে নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক হবার জন্য তার সে পেশায় মনে প্রাণে নিবেদিত হবার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে শিক্ষকতা অন্য দশটি পেশার মত নয়। তাকে অন্য পেশার সাথে গুলিয়ে ফেললেই সমস্যা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম