শাহ্সূফী সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী (ম.জি.আ.) সুন্নিয়ত ও মাইজভান্ডারী দর্শন প্রচারে তাঁর ত্যাগ ও অবদান

554

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াছাল্লামার মাধ্যমে নবুয়ত ও রেসালত যুগের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু ইসলামের দাওয়াতি তথা প্রচারের মিশন কোনো কালেই মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেনি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াছাল্লামার জাহেরি হায়াতের পর এবং সাহাবাদের যুগ অতিবাহিত হবার পর ইসলামের প্রচার-প্রসার বহমান রাখেন আল্লাহর নৈকট্যধন্য ও অনুগ্রহপ্রাপ্ত আধ্যাত্মিক সাধক ব্যক্তিত্ব আউলিয়ায়ে কেরাম। তাঁদের উসিলায় ও অবদানে ইসলাম বিশ্বজনীন ব্যাপ্তি লাভ করেছে। তাই, ইসলামের বিজয় নিশান বিশ্ব জনপদে প্রসারিত হবার পেছনে আল্লাহর ওলীদের ত্যাগ ও অবদানকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। কেয়ামত পর্যন্ত বেলায়তের রাস্তা খোলা। শানে বেলায়ত তথা আউলিয়ায়ে কেরামের আধ্যাত্মিকতার বদৌলতে যুগে যুগে মানুষ ইসলামের দিকে ফিরে আসছে। পথহারা লক্ষ্যভ্রষ্ট দিশাহীন মানুষের আধ্যাত্মিক রাহ্বার তথা দিশারীই হলেন আউলিয়ায়ে কেরাম। তেমনি ঊনবিংশ শতকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্বদেশী ঘরানার-ভাবধারার একটি ত্বরীকা প্রবর্তন করেন গাউছুল আ’যম আল­ামা শাহ্সূফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী কাদ্দাছাল্লাহু ছিররাহুল আজিজ। সকল ত্বরীকা ও ইসলামী দর্শনের নির্যাস ত্বরীকায়ে মাইজভাÐারীয়ার মাধ্যমে দিশাহীন মানবজাতিকে আলোকিত পথের সন্ধান দেন তিনি। তাঁরই পদাংক অনুসরণ করে তাঁর রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকার শায়খুল ইসলাম হযরত গাউছুল ওয়ারা শাহ্সূফী মাওলানা সৈয়দ মইনুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী ওয়াল হোসাইনী আল্-মাইজভান্ডারী কাদ্দাছাল­াহু ছিররাহুল আজিজের মাধ্যমে ত্বরীকায়ে মাইজভান্ডারীয়ার প্রচার-প্রসার বিশ্বজনীন রূপ লাভ করে। দীর্ঘ বর্ণাঢ্য সফল কর্মময় জীবনে হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ মইনুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী কাদ্দাছাল্লাহু ছিররাহুল আজিজ অসীম আত্মত্যাগের মাধ্যমে মাইজভান্ডারী ত্বরীকা ও দর্শন সর্বত্র প্রসারিত করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমায় ত্বরীকায়ে মাইজভান্ডারীয়ার আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতা বহুমাত্রিক রূপ পায়। এর ধারাবাহিকতায় হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ মইনুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী কাদ্দাছাল্লাহু ছিররাহুল আজিজের প্রদর্শিত ও অনুসৃত সুন্নিয়ত, ত্বরীকত ও মানবসেবার মিশন জারি রেখেছেন তাঁরই পবিত্র শোণিতধারা ও একমাত্র খেলাফতপ্রাপ্ত স্থলাভিষিক্ত আওলাদ শাহ্সূফী হযরত মাওলানা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী মাদ্দাজিল­ুহুল আলী। বুজুর্গ পিতা ও আপন মুর্শিদের পদাংক অনুসরণ করে তিনি কেবল বাংলাদেশে নয়; বিশ্বের নানা দেশে কষ্টসাধ্য সফর করে মাইজভান্ডারী ত্বরীকা ও দর্শনকে বিশ্ব পরিমন্ডলে সর্বোত্তম উপায়ে তুলে ধরে আসছেন। নিজ পিতা মুর্শিদে বরহককে তাঁর জীবদ্দশায় এ মহান উত্তরাধিকারী ছায়ার মতো অনুকরণ করতেন। শরীয়ত-ত্বরীকতের মহান জিম্মাদারি ও খেলাফতের দায়িত্ব ন্যস্ত করতে বুজুর্গ পিতা দীর্ঘকাল ধরে আপন পুত্রকে কাছে রেখে নকশ কদমে চলতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম যেভাবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’য়ালা আলাইহি ওয়াছাল্লামার সান্নিধ্য- সোহবতে কাটিয়ে দিয়ে কামালিয়তের উপযুক্ততা অর্জন করতেন; ঠিক তেমনি বুজুর্গ পিতার পাশে ও কাছে প্রতিমুহূর্ত অতিবাহিত করে এবং পিতার খেদমতে নিজেকে সঁপে দিয়ে আধ্যাত্মিকতার ছবক নিয়েছিলেন হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী মাদ্দাজিল্লুহুল আলী।
পিতা কর্তৃক অনুগ্রহধন্য হয়ে এবং ফয়জ-বরকত লাভ করে মাইজভান্ডারী ত্বরীকা ও সিলসিলার যথাযথ খেদমত আন্জাম দিচ্ছেন তিনি। তাঁর প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বিচক্ষণতা, দূরদর্শীতা, ধীশক্তি, ইলম ও আমলের ক্ষেত্রে অনন্য সাধারণ গুণের কথা সর্বজন বিদিত। শরীয়ত-ত্বরীকতের জিম্মাদারি তিনি পরিপূর্ণভাবে পালন করে আসছেন। ভক্ত জনতাকে শরীয়ত-ত্বরীকতের দিশা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সুন্নতি জীবনাচার, অতুলনীয় চরিত্র মাধুর্য, অনুপম আচার ব্যবহার ও ভক্ত মুরিদের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও আবেদন আজ প্রশ্নাতীত। ভক্ত ফরিয়াদি জনতার দুঃখ-দুর্দশা অভাব অভিযোগ মোচনে হুজুর কেবলা মাদ্দাজিল্লুহুল আলীকে সব সময় অগ্রবর্তী ভূমিকায় দেখা যায়। আশেক ভক্তদেরকে তিনি শুধু জাগতিক সমস্যা থেকে নিকৃতির পথ দেখান তা নয়; বরং আধ্যাত্মিকভাবে সবাইকে পরিশুদ্ধ নির্মল নিষ্কলুষ জীবনের পথ দেখিয়ে আসছেন এ সুন্নি জনতার শিরোমণি। মাইজভাÐারী ত্বরীকা ও দর্শন তিনি সাংগঠনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে দেশে-বিদেশে সার্থকভাবে তুলে ধরে তিনি অনন্য কীর্তির স্বাক্ষর রাখছেন।
আল্লাহর ওলীদের কল্যাণে বিশ্বজুড়ে আজ ইসলামের বিজয় কেতন উড়ছে। তেমনি বাংলাদেশসহ উপমহাদেশেও ইসলামের ভিত্তিসৌধ গড়েন আউলিয়ায়ে কেরাম। মাইজভান্ডার দরবার শরীফের সাধক ব্যক্তিত্বরাও সর্বোত্তম উপায়ে মানবিক গুণ-মাধুর্যে সুন্নিয়ত ও ত্বরীকতের খেদমতে আত্মোৎসর্গীত ছিলেন। তাঁদের পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে সুযোগ্য আউলাদ ও উত্তরাধিকারীগণ ইসলাম ও মাইজভাÐারী দর্শনের বিকাশে নিজেদের নিবেদিত রেখেছেন। অনুরূপভাবে শাহজাদায়ে গাউছুল আ’যম মাইজভান্ডারী হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী মাইজভান্ডারী মাশায়েখে কেরামের প্রদর্শিত পথে, বিশেষত আপন বুজুর্গ পিতা ও মুর্শিদ কেবলার অসমাপ্ত দ্বীন ও মাইজভান্ডারী দর্শনের দাওয়াতি মিশন বহমান রেখেছেন। এ লক্ষ্যে তাঁর ত্যাগ, কর্মকীর্তি ও অবদান অসামান্য। লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি সুদৃঢ়, কর্মপদ্ধতি তাঁর সূক্ষ, চিন্তাধারা তাঁর স্বচ্ছ ও গভীর, গন্তব্যে পৌঁছতে তাঁর সাধনা অত্যন্ত নিখাদ। এজন্যই তাঁর খ্যাতি ও কীর্তির কথা আজ সর্বমহলে ছড়িয়ে পড়েছে। কর্ম ও ব্যক্তিত্ব গুণে তিনি সুন্নিয়ত আকাশের ধ্রুব নক্ষত্র হিসেবে নিজের অবস্থান সমুজ্জ্বল করেছেন।
দেশের সীমানা পেরিয়ে দ্বীন, সুন্নিয়ত ও ত্বরীকতের মিশন তিনি সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। বছরে একাধিকবার আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংগঠনের আমন্ত্রণে তিনি বিশ্বের নানা দেশে গমন করে ইসলামের শান্তি-সম্প্রীতি ও গণকল্যাণের বাণী বিশ্ব সভায় উপস্থাপন করছেন। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিদগ্ধ সমাজে তাঁর বক্তব্য ও আহবান বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। তিনি হয়ে উঠেছেন বিশ্ব শান্তিমিশনের অগ্রদূত। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়াস্থ ‘হেভেনলি কালচার ওয়ার্ল্ড পিচ রেস্টোরেশন অব লাইট’ এর উদ্যোগে ১৭-১৯ সেপ্টেম্বর (২০১৪) দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আন্তঃধর্মীয় ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হয়। এইচডব্লিউপিএল নামে বৈশ্বিক এ সংগঠনের আমন্ত্রণে অন্যতম প্যানালিস্ট ও বিশেষ অতিথি হিসেবে ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আন্তঃধর্মীয় ডায়ালগ সম্মেলনে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন। হযরত সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী মাদ্দাজিল্লুহুল আলী বলেন, ইসলামসহ সকল ধর্মের মূলবাণী ও শিক্ষাই হচ্ছে শান্তি, স¤প্রীতি, সহাবস্থান ও গণকল্যাণ। ধার্মিক ব্যক্তি সব সময় মানুষের কল্যাণ কামনা করে। প্রকৃত ধার্মিক কখনো অন্য মানুষের কিংবা অন্য ধর্মাবলম্বী লোকের প্রতি রুষ্ট আচরণ করতে পারে না। ধর্মের নামে বিশৃংখলা, অরাজকতা, হানাহানি, সংঘাত, রক্তপাত ও বিভেদ-বিভাজনের সুযোগ নেই। তিনি ধর্মের মূল শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, গোঁড়ামি, ধর্মীয় উগ্রতা, হিংসা বিদ্বেষ ও সংঘাতের পথ থেকে সরে এসে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় সব দেশকে একযোগে কাজ করতে হবে। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের জন্য মডেল বলে তিনি দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেন। ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, কাশ্মির, মিয়ানমার ও ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিরীহ মুসলমান ও অসহায় মানবতার ওপর চরম দমন নিপীড়নের প্রসঙ্গ উলে­খ করে তিনি বলেন, যুদ্ধের ভয়াবহতা ও সংঘাতের বীভৎস পরিস্থিতি থেকে নিরপরাধ নারী-শিশুকে রক্ষায় বিশ্ব নেতৃত্বকে সোচ্চার ভূমিকা রাখতে হবে। বিশ্বের যেখানে যারাই মানুষের শান্তি-স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছে; এই মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তিনি বিশ্ব নেতৃত্বের জোরালো ভূমিকা কামনা করেন। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ, ওআই সি, আরব লীগসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন দেশে পরিচালিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চরম অত্যাচার ও নির্যাতন বন্ধে তিনি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি ত্বরীকায়ে মাইজভান্ডারীয়ার অসাম্প্রদায়িক মানব প্রেমের দর্শন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার আহবান জানান এবং মাইজভান্ডার দরবার শরীফ পরিদর্শন করার অনুরোধ জানান। দক্ষিণ কোরিয়া সরকারসহ শান্তি সম্মেলনে আগত সকল প্রতিনিধি ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে বাংলাদেশের সাথে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করার এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একযোগে কাজ করার আহবান জানান হযরত সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী মাদ্দাজিল্লুহুল আলী। আন্তঃধর্মীয় ডায়ালগ সম্মেলনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। বহু বরেণ্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সেখানে বৈঠক করেন এবং মতবিনিময়ে অংশ নেন তিনি। অনুষ্ঠানের বাইরে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আরব আমিরাত, সিরিয়া, লেবানন, মিশর, লিবিয়া, বসনিয়া হার্জেগোভেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও রাষ্ট্রীয় প্রধানদের সাথে তিনি সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে ১৭০টি দেশের প্রায় দুই লক্ষ মানুষ আন্তঃধর্মীয় ডায়ালগ সম্মেলনে অংশ নেন। সম্মেলন শেষে বিশাল শান্তি শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রার পুরোভাগে ছিলেন বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধিত্বকারী হযরত শাহ্সূফী সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী মাদ্দাজিল্লুহুল আলী। এভাবে নানা দেশ সফর করে ইসলামের গণমুখী দর্শন এবং মাইজভান্ডারী ত্বরীকার কথা তুলে ধরছেন হযরত শাহ্সূফী সাইফুদ্দীন আহমদ আল্-হাসানী (ম.জি.আ.)। এ মহান সূফী ব্যক্তিত্ব ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ফেব্রুয়ারি (১২ ফাল্গুন) মাইজভান্ডার দরবার শরীফে শুভাগমন করেন। এবছর ২৪ ও ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর ৫৪ তম খোশরোজ শরীফ মাইজভান্ডার দরবার শরীফে বর্ণাঢ্য আনুষ্ঠানিকতায় উদ্যাপিত হচ্ছে। আমরা তাঁর কৃপাদৃষ্টি কামনা করছি।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট