শাহ্সূফী আল্লামা কাযী আমিনুল ইসলাম হাশেমী (রহ.)

182

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম অসংখ্য ওলী সাধক বুজুর্গ ব্যক্তিত্বের পিঠস্থান। এখানকার মাটি ও মানুষ ওলী-সাধকদের পদচারণায় ধন্য। তেমনি একজন যুগনন্দিত বরেণ্য বুজুর্গ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হলেন পীর তরিকত আমিনে মিল্লাত ফকিহ বাঙাল আল্লামা কাযী মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম হাশেমী (রহ.)। বড় বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সাদাসিধে নির্মোহ নির্লোভ জীবনাচারের কারণে তিনি সবার মন জয় করেছিলেন। সব শ্রেণি পেশার মানুষ তাঁর কাছে গিয়ে উপকৃত হতেন এবং জাগতিক সমস্যার নিষ্কৃতি পেতেন। তিনি কেবল বুজুর্গ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব নন, মানুষের সর্ববিধ সমস্যার সমাধানেও ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। এটাই তাঁর জীবনের বড় বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব। খানকায় পীর, ময়দানে বীর, ওয়াজ মাহফিলে শ্রেষ্ঠ বক্তা এবং মানুষের সেবা ও কল্যাণে উৎসর্গীত এমন ব্যক্তিত্বের সত্যিই কোনো তুলনা হয় না। চট্টগ্রামসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আয়োজিত ওয়াজ মাহফিলে সারা রাত কাটিয়ে দিয়ে দ্বীনের খেদমতে ব্যাপৃত থাকতেন। নানা সমস্যা ও বিপদ আপদ থেকে মুক্তি পেতে ছুটে আসা ভক্ত মুরিদদেরকে সারা দিন আধ্যাত্মিক ও জাগতিক চিকিৎসাসেবা দিতেন। নিজের আরাম আয়েশ পরিত্যাগ করে সমাজসেবা ও জনকল্যাণে উৎসর্গীত ছিলেন জীবনভর। ফলে সর্বশ্রেণির মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ধন্য ছিলেন। অসাধারণ কর্মকীর্তির কারণে তাঁকে মহান রাহবার পথ নির্দেশক বা আধ্যাত্মিক দিশারী হিসেবে মান্য করেন অগণিত মুরিদ ও ভক্ত জনতা। জীবদ্দশায় যেমন ফরিয়াদি মানুষের দিশারী ছিলেন, তেমনি লোকান্তরিত হয়েও অসীম আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় এখনো ভক্ত জনতাকে নানাভাবে কৃপাধন্য করে আসছেন। মানুষের সেবা ও কল্যাণকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। ‘সেই সর্বোত্তম যে মানুষের উপকার করে’Ñ মহানবীর (দ.) এ পবিত্র হাদিসের নির্দেশনা আল্লামা কাযী আমিনুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) নিজে যেমন মেনে চলতেন, তেমনি ভক্ত জনতাকেও মানুষের সেবায় উৎসর্গীত হবার সতত তাগিদ ও নির্দেশনা দিতেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেনÑমানবসেবাই সর্বোত্তম ইবাদত। এজন্য মানুষকে ঘিরে তাঁর সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। মানুষের উপকার করাই ছিল তার ধ্যান ও জ্ঞান। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসাখানকাহ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি দাতব্য চিকিৎসালয়ও প্রতিষ্ঠা করে মানবসেবার অনন্য দৃষ্টান্ত রাখেন। আলেমদের মাঝে এ ধরনের বহুমুখী গুণ-কর্ম বৈশিষ্ট্য সাধারণত চোখে পড়ে না। দ্বীন-সুন্নিয়ত প্রচারে তিনি সাংগঠনিক উদ্যোগও নিয়েছিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বহু ইসলামী আদর্শিক ও সেবামূলক সংগঠন। তাঁর উত্তরাধিকারী সাজ্জাদানশীন ও সাহেবজাদাগণ এই সংগঠনগুলোর মাধ্যমে দ্বীন প্রচার, তরিকতের খেদমত ও মানবসেবায় নানামুখী প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।
সম্ভ্রান্ত হাশেমী বংশে তাঁর জন্ম: আল্লামা মুফতি কাযী আমিনুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) এর জন্ম ও বংশধারাও অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রমী। বংশীয় ঔজ্জ্বল্য ও কর্মজীবনে তাঁর নানামুখী সাফল্যকীর্তিগাথা দেখে বিস্ময় জাগে। ১৯৩৮ সনের ২৭ জুলাই বুধবার দিনগত রাতে চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ থানাধীন জালালাবাদ কুলগাঁও গ্রামে তাঁর জন্ম। সুলতানুল ওয়ায়েজিন খ্যাতিমান আলেমে দ্বীন আল্লামা কাযী মুহাম্মদ আহছানুজ্জামান হাশেমী (রহ.) তাঁর পিতা। আরেক বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব আল্লামা কাযী মুহাম্মদ আবদুর রহিম হাশেমী (রহ.) তাঁর পিতামহ এবং আল্লামা আবদুর রহমান হাশেমী (রহ.) তাঁর মাতামহ। যিনি কিংবদন্তি মুহাদ্দিস ও আধ্যাত্মিক সাধক সীতাকুন্ডের আল্লামা সফিরুর রহমান হাশেমী (রহ.) এর সহোদর। পিতামাতা উভয় দিক থেকে হাশেমী বংশধারা আল্লামা কাযী আমিনুল ইসলাম হাশেমীর (রহ.) পবিত্র শোণিতধারায় বিদ্যমান।
আল্লামা আমিনুল ইসলাম হাশেমীর (রহঃ) বহুমাত্রিক পদক্ষেপ: আল্লামা কাযী আমিন হাশেমীর (রহ.) সাংগঠনিক প্রজ্ঞা-দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা ছিল অসাধারণ। তিনি বিশ্বাস করতেন যেকোনো মহৎ লক্ষ্য অর্জনে সাংগঠনিক উদ্যোগের বিকল্প নেই। তাই তিনি ১৯৮০ সনে প্রতিষ্ঠা করেন আনজুমানে আশেকানে মোস্তফা (দ.) বাংলাদেশ এবং এই সংগঠনের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে দ্বীন-সুন্নিয়ত-তরিকত প্রচার ও জনসেবামূলক কাজ ত্বরান্বিত করতে একে একে প্রতিষ্ঠা করেন আনজুমানে ইখওয়ানে তরিকত, আশেকানে মোস্তফা (দ.) তরুণ পরিষদ (প্রতিষ্ঠাকাল ২০০০ সন), শাহ্ আমিনিয়া ফাউন্ডেশনসহ নানা সংস্থা সংগঠন। চট্টগ্রামসহ সারা দেশে বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা তাঁর অনন্য কীর্তি। যাদুল মুমেনীন, নাফেউল মুসলেমীন, তকবিলুল ইবহামাইন, ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.), হেদায়তুস সালেকীন সহ বহু মৌলিক চিন্তাধারা ও আক্বিদাভিত্তিক গ্রন্থ প্রণেতা তিনি। দ্বীন ও সুন্নিয়ত প্রচারের লক্ষ্যে এক সময় আল হক্ব নামে একটি নিয়মিত স্মরণিকাও তিনি প্রকাশ করেন। এছাড়া বহু সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
অলৌকিক কর্মকীর্তি: ‘আমার এই ছেলে মাতৃগর্ভের অলি, তাঁর বেলায়তের মাধ্যমে অসংখ্য আল্লাহর বান্দাহ উপকৃত হবেন’ বুযুর্গ পিতা কর্তৃক বাল্যকালেই তিনি অলিয়ে কামেল হবার সুসংবাদ প্রাপ্ত হন। অলৌকিক ক্ষমতায় রোগ নিরাময়, বিনা অপারেশনে রোগীর সুস্থতা, অভাবী একজন রাখাল ছেলেকে একটি ফাজিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা বানানো, রোগের কথা বলতেই আরোগ্য লাভ, হাতের ইশারায় টিউমার সারানো, নিজের ইন্তেকাল সংবাদ আগেই জানিয়ে দেওয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে তেলবিহীন গাড়ি চালিয়ে চট্টগ্রাম শহরের বাড়িতে ফিরে আসা, সময়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ইন্তেকালের পর ৩০ ঘণ্টা পর্যন্ত হুযুর কেবলার (রহ.) কফিন সতেজ থাকা তাঁর অলৌকিক শক্তির প্রমাণ মেলে। বায়েজিদ ওয়াজেদিয়ার বাসিন্দা মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান। ৬ জুন ১৯৯৮ সনের ঘটনা। তাঁর ভাগিনি জামাই মুহাম্মদ মফিজুর রহমান (আমানবাজার, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) আবুধাবিতে ইন্তেকাল করেন। সেখান থেকে লাশ আনার সময় মুজিবুর রহমান নিজের পাসপোর্টসহ ভাগিনি জামাই মফিজুর রহমানের পাসপোর্ট এয়ারপোর্টে একসাথে জমা দেন। তখন ভুলবশত মৃত মফিজুর রহমানের পাসপোর্টে ক্যানসেল সিল না মেরে মুজিবুর রহমানের পাসপোর্টে ক্যানসেল সিল মেরে দিলে বড় বিপদে পড়ে যান তিনি। তখন এয়ারপোর্ট কর্মকর্তা আরবিতে একটি জবাব লিখে দিয়ে বললেন, আপনার কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাওয়ার সময় বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট কর্মকর্তা পাসপোর্টে ক্যানসেল সিল মারা দেখলে তাঁর বিদেশ যাওয়া অসম্ভব বলে জানালেন। তখন চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। এমন সময়ে একদিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (রা.) মাজার শরিফ জেয়ারত করার পর সেখানে হঠাৎ করে দেখা পান আল্লামা আমিন হাশেমী (রহ.) কেবলার। মন খারাপ দেখে হুজুর তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে। তিনি বিপদের কথা হুজুরকে জানালেন। অভয় দিয়ে হুজুর আরবিতে একটি চিঠি লিখে তাঁকে দিলেন। বললেন, তুমি চিন্তা করো না বিদেশ যেতে পারবে। এই চিঠি বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট কর্মকর্তার হাতে দেবে। সত্যি সত্যি হুজুরের চিঠি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার হাতে দেয়ার পর তিনি মুজিবুরকে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। এভাবে আল্লামা কাজী আমিন হাশেমীর (রহ.) বহু কারামাতের ঘটনা উল্লেখ করা যায়। হাটহাজারী আমানবাজার নিবাসী মুহাম্মদ খায়রুল বশর প্রকাশ কালু কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে অর্শ্ব রোগে কষ্ট পাচ্ছিলেন। স্বপ্নযোগে তাঁকে একটুকরা অমর গাছের পাতা ধরিয়ে দিলেন হুজুর কেবলা (রহ.)। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে দেখতে পেলেন গাছের টুকরোটি তাঁর হাতে। এতে তিনি বিস্মিত হন। এই গাছকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে নিজে উপকার পেয়েছেন। হুজুরের নির্দেশনা মতো এই ওষুধ ব্যবহার করে বহু অর্শ্বরোগী উপকৃত হচ্ছেন এখনো। আমানবাজার নিবাসী মুহাম্মদ সেলিম স্ট্রোক করে প্যারালাইসিসে ভুগছিলেন। ২০০৭ সনে একদিন হুজুর কেবলার (রহ.) মাজার শরিফে ছুটে এলেন। মাজার শরিফে জিয়ারত করার সময় তাঁর শরীরে কম্পন আরম্ভ হল। অবশ থাকা তাঁর শরীরের ডান পাশ হঠাৎ করে সুস্থ হয়ে গেল। মুহাম্মদ সেলিম এভাবে হুজুরের বহু কারামতের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আছেন। হাটহাজারী থানাধীন বালুচরার মুহাম্মদ গোফরান ও শফি কন্ট্রাটর ২০০৬ সনে হুজুরের ইন্তেকালের একবছর পর মাজার শরিফে জেয়ারতে এলেন। সেদিন বাড়ি ফিরে গিয়ে তাঁরা দুইজনই স্বপ্নে দেখলেন হুজুরকে। হুজুর বললেন, তোমরা কুরআন তেলাওয়াতে ভুল করছো কেন? শুদ্ধভাবে কুরআন তেলওয়াত করবে। রাউজান আধারমানিকের সৈয়দ নেছারুদ্দিন বর্ণনা করলেন একটি অলৌকিক ঘটনা।
ব্যতিক্রমী সেবাধর্মী কর্মসূচির মাধ্যমে ওরস উদযাপন: আল্লামা কাযী আহছানুজ্জামান হাশেমী (রহ.) এর ৫২তম এবং আল্লামা কাযী আমিন হাশেমী (রহ.) এর এবার ১৫তম ওরশ শরীফ উপলক্ষে ৩ থেকে ৫ এপ্রিল (২০২১) বায়েজিদ জালালাবাদস্থ আল আমিন হাশেমী দরবার শরীফে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দ্বীনি কর্মসূচি ছাড়াও গরিব দুস্থ অসহায় মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা, খৎনা ক্যাম্প ও ফ্রি ওষুধ বিতরণ, না’তে রাসূল (দ.) প্রতিযোগিতা, শাহ আমিন হাশেমী (রহ.) স্মৃতি বৃত্তিসহ বহুমুখী জনসেবা ও দ্বীনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ফ্রি চিকিৎসা সেবা ক্যাম্প আয়োজনে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে। আর এর আয়োজনে আছে আনজুমানে আশেকানে মোস্তফা (দ.) বাংলাদেশ ও আশেকানে মোস্তফা (দ.) তরুণ পরিষদ। ২০০৬ সনের ৫ এপ্রিল এই মহান কীর্তিমান আধ্যাত্মিক মনীষীর পার্থিব জীবনাবসান ঘটলেও তাঁর কর্মকীর্তিই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগ যুগ ধরে। মহান কীর্তিমান আধ্যাত্মিক মনীষী আল্লামা আমিনুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) দিব্যদৃষ্টিতে আমাদের গøানিময় জীবন সমৃদ্ধ ও আলোকিত হোক।
লেখক : সাংবাদিক